৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭, শনিবার, ৮:১৪

প্রশাসনের আস্থাভাজনদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বেড়েই চলেছে

ভেঙে পড়ছে চেইন অব কমান্ড নষ্ট হচ্ছে ভারসাম্য

প্রশাসনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বেড়েই চলেছে। সরকারের আস্থাভাজন কর্মকর্তারা অবসরের পরও চাকরিতে বহাল থাকছেন। এতে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও প্রশাসনের শীর্ষপর্যায়ের পদগুলোতে পদোন্নতি হচ্ছে না অনেকের। এতে কর্মকর্তাদের একটি অংশ পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অন্য দিকে পদোন্নতির পরও প্রশাসনে বিপুল কর্মকর্তাকে আগের পদেই কাজ করতে হচ্ছে। এর ফলে এক দিকে যেমন প্রশাসনের চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ছে, অন্য দিকে নষ্ট হচ্ছে প্রশাসনের ভারসাম্য। এতে বাড়ছে বিশৃঙ্খলা, ব্যাহত হচ্ছে সরকারের দাফতরিক কাজকর্ম। সরকারও চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ব্যাপারে আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

সংশ্লিষ্টদের অভিযোগÑ সরকারের উচ্চ পদগুলোতে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের প্রক্রিয়া তো থামেইনি, উল্টো বেড়েছে। চলতি মাসেই শুধু সচিবপর্যায়ে দু’জন সচিবকে আবার চুক্তিতে নিয়োগ দিয়েছে সরকার। বর্তমানে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরির বয়স ৫৯ বছর, আর মুক্তিযোদ্ধাদের অবসরের বয়স ৬০ বছর। বিশেষায়িত ও কারিগরি পদের ক্ষেত্রে যেখানে দক্ষ লোকের সংখ্যা খুবই কম সেখানে শুধু চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া যেতে পারে। কিন্তু দেখা গেছে, যাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে তারা কেউই ওই সব পদে অপরিহার্য নন।

চলমান চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বিরোধিতা করে ২০১৪ সালের ১ মার্চ জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমাত আরা সাদেকের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের জন্য একটি নীতিমালা প্রণয়নের তাগিদ দিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টায়নি, বরং এ প্রক্রিয়া আরো বেড়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে প্রশাসনে ৪৬০ জন অতিরিক্ত সচিব, ৮০২ জন যুগ্মসচিব ও এক হাজার ৫৫৫ জন উপসচিব রয়েছেন। যদিও অতিরিক্ত সচিবের স্থায়ী পদের সংখ্যা এক শ’র কিছু বেশি। আর যুগ্মসচিবের নিয়মিত পদের সংখ্যা সাড়ে ৪০০ ও উপসচিবের নিয়মিত পদ সাড়ে আট শ’র মতো।

অবসরে যাওয়ার পর গত ১৭ আগস্ট চুক্তিতে আরো দুই বছরের জন্য গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে নিয়োগ পান মো: শহীদউল্লাহ খন্দকার। একই দিন দুই বছরের জন্য আবারো চুক্তিতে নিয়োগ পান স্থাপত্য অধিদফতরের প্রধান স্থপতি গোলাম নাসির। এর আগে ৭ আগস্ট চুক্তিতে দুই বছরের জন্য নিয়োগ পান আইন ও বিচার বিভাগের সচিব আবু সালেহ শেখ মো: জহিরুল হক। এ নিয়োগ উচ্চ আদালত স্থগিত ঘোষণা করলেও চেম্বার জজ তা দুই মাসের জন্য স্থগিত করেছেন। এ ছাড়া গত ২৮ জুন সচিব পবন চৌধুরীর অবসরোত্তর ছুটি (পিআরএল) বাতিল করে দুই বছরের জন্য তাকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) নির্বাহী চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। গত ২৮ ফেব্র“য়ারি অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব মাহবুব আহমেদের চুক্তির মেয়াদ ২০১৯ সালের ৮ মার্চ পর্যন্ত বাড়ানো হয়। ৭ ফেব্র“য়ারি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান সম্পাদক আবুল কালাম আজাদের চুক্তির মেয়াদ তিন বছর বাড়ানো হয়। ১ ফেব্র“য়ারি চুক্তিতে এক বছরের জন্য বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) চেয়ারম্যান হন অবসরোত্তর ছুটিতে থাকা মেজর জেনারেল মঈন উদ্দিন। একই দিন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহাম্মেদ খানের মেয়াদও চুক্তিতে দুই বছর বেড়েছে। আলী আহাম্মেদের পিআরএল বাতিল করে এ নিয়োগ দেয়া হয়। এর আগে ২৫ জানুয়ারি চুক্তিতে আরো এক বছরের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিনিয়র সচিব নিয়োগ পান অবসরে যাওয়া সুরাইয়া বেগম। চলতি বছরের ৩১ মে অতিরিক্ত সচিব হোসনে আরার পিআরএল বাতিল করে চুক্তিতে তাকে দুই বছরের জন্য বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (সচিব পদমর্যাদায়) নিয়োগ দেয়া হয়। এ ছাড়া চলতি বছর অবসরোত্তর ছুটিতে থাকা অতিরিক্ত সচিব তরুণ কান্তি ঘোষকে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয়া হয়। পেট্রোবাংলার কর্মকর্তা জামিল আহমেদ আলিমের অবসরোত্তর ছুটি বাতিল করে এক বছরের জন্য পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইন্স) পদে চুক্তি ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া হয়। গত ৩১ মে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিসের (বিআইআইএসএস) বোর্ড অব গভর্নসের চেয়ারম্যান পদে মুন্সী ফয়েজ আহমেদ আবারো দুই বছরের জন্য নিয়োগ পান।

এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেছেন, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের স্পিরিটটা হলোÑ যেখানে কর্মকর্তার উপযুক্ত রিপ্লেসমেন্ট পাওয়া যাচ্ছে না, বিশেষ করে টেকনিক্যাল পদগুলোর ক্ষেত্রে, সেখানে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া যায়। কিন্তু এখন সরকারের নীতি হলো ফেভার ডিস্ট্রিবিউন, যাকে পছন্দ হয় চুক্তিতে রেখে দিই, যাকে পছন্দ হয় না বিদায় করে দিই। টেকনিক্যাল পোস্টে কর্মকর্তা পাওয়া যায় না, এসব চিন্তা করে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয় না। তিনি বলেন, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বহুবিধ ক্ষতিকর প্রভাব রয়েছে। এখন চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মূল শর্ত হলো দলীয় মনোভাব, দলীয় আনুগত্য। এটা প্রশাসনের ভারসাম্য নষ্ট করে। অনেকের প্রমোশনের পথ বন্ধ হয়ে যায়, যা কর্মকর্তাদের হতাশ করে।

এ দিকে সরকার বিভিন্ন সময় বড় ধরনের পদোন্নতি দিলেও এখনো প্রশাসনে বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তা পদোন্নতি বঞ্চিত রয়েছেন। পদোন্নতির বঞ্চনা প্রশাসন ক্যাডার ছাড়া অন্যান্য ক্যাডারে বেশি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিবের দায়িত্ব পালন করছেন এমন একজন কর্মকর্তা বলেন, আমার ব্যাচের ২০ জনকে পদোন্নতি দিলেও সেখানে আমার নাম থাকার কথা। কিন্তু অতিরিক্ত সচিব পদে দুই-তিন দফা পদোন্নতি হলো, কিন্তু আমি বঞ্চিত হলাম। আমার অপরাধ কী তা আমার জানা নেই। আরেক যুগ্মসচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা বলেন, ২০০৪ সাল থেকে উপসচিব হিসেবে প্রায় ১২ বছর একই পদে কাজ করেছি। সম্প্রতি তিনি পদোন্নতি পেয়ে যুগ্মসচিব হয়েছেন। তার ব্যাচমেটদের অনেকেই অতিরিক্ত সচিব, কেউ কেউ আবার সচিবও হয়েছেন। আবার জুনিয়র ব্যাচের কেউ কেউ অতিরিক্ত সচিব হয়েছেন। এসব কথা বলতে গিয়ে তিনি অনেকটাই আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, আমার অপরাধ আমি নাকি বিএনপি মনোভাবাপন্ন। এটাই কি পদোন্নতির ক্রাইটেরিয়া। আমার যোগ্যতা এখানে কোনো সাবজেক্ট নয়। তথ্য ক্যাডারের একজন সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা বলেন, আমার ব্যাচের প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বেশির ভাগই যুগ্মসচিব। কিন্তু আমার পদোন্নতি হয়নি, সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তায় আটকে আছি। আমার পদমর্যাদা সিনিয়র সহকারী সচিবের সমান। এটা খুব হতাশ করে। এতে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে নিজেকে অসহায় মনে হয়।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, বিগত সময়ে পদোন্নতির কারণে এখন প্রশাসনে নির্ধারিত পদের চেয়ে কর্মকর্তার সংখ্যা অনেক বেশি। পর্যাপ্ত পদ না থাকায় পদোন্নতির পর বেশির ভাগ কর্মকর্তাকেই আগের জায়গায় কাজ করতে হচ্ছে। ফলে একেক মন্ত্রণালয়ে প্রয়োজনের চেয়েও বেশি উপসচিব, যুগ্মসচিব ও অতিরিক্ত সচিব রয়ে গেছেন। কোনো কোনো মন্ত্রণালয় ও বিভাগে একটি মাত্র অতিরিক্ত সচিবের স্থায়ী পদ থাকলেও সেখানে তিন-চারজন অতিরিক্ত সচিব দায়িত্ব পালন করছেন। এতে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে প্রশাসনে।

অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে পদগুলোর পুনর্বিন্যাস করা হয়। আগে উপসচিবেরা যে পদে দায়িত্ব পালন করতেন, সেটিকে এখন উপসচিব বা যুগ্মসচিব বলা হচ্ছে। আর যুগ্ম সচিব পদের বেলায় করা হয়েছে যুগ্মসচিব বা অতিরিক্ত সচিব। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মাধ্যমে প্রশাসনের এ বিশৃঙ্খলাকে আরো বাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোজাম্মেল হক খান বলেন, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হন, অনেকেই মন খারাপ করেন। জুনিয়ররা খুবই মন খারাপ করেন। কিন্তু যিনি কন্ট্রাক্ট (চুক্তিতে নিয়োগ) পান তিনি খুশি হন। কন্ট্রাক্টের জন্য যিনি তদবির করে তিনি লাভবান হন। তবে সরকার কারো কারো ক্ষেত্রে মনে করে তার কিছু কোয়ালিটি আছে, সরকারের কাজে লাগবে। এ জন্য হয়তো সরকার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বিষয়টি বিবেচনা করে। এভাবে যে নিয়োগ দেয়া হয় সেটি আমি সমর্থন করি। তবে কন্ট্রাক্টের জেনারেল প্রিন্সিপালকে আমি ব্যক্তিগতভাবে অপছন্দ করি। এ ব্যাপারে বাইরের সাধারণ মানুষের যে মতামত তাতে মনে হয় তারাও এটা অপছন্দ করেন।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/250196