৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭, শনিবার, ৮:১১

মহাবিপর্যয়ে চামড়া শিল্প

টাকার অভাবে চামড়া ক্রয় করতে পারছে না ট্যানারি মালিকরা। কোন টাকা ছাড়াই চামড়া লুটে নিচ্ছে মজুদদাররা। স্বাধীনতার ৪৫ বছরেও চামড়ায় এত বড় মহাবিপর্যয় দেখা যায়নি। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ ভারতে প্রতি বর্গফুট চামড়ার দাম (১০৫ রুপি) প্রায় ১৩৫ টাকা। বাংলাদেশে প্রতি ফুটের দাম মাত্র ৫৫-৬০ টাকা। প্রতি ফুট চামড়ায় দামের পার্থক্য ৮০ টাকা। তার পরেও চামড়া বিক্রি করতে হচ্ছে বাকিতে। এতে করে বাধ্য হয়ে চামড়া পাচার করছে সীমান্তের ব্যবসায়ীরা। তাহলে চামড়া পাচারের দায় কার। ট্যানারি এসোসিয়েশন চামড়া পাচারের আশঙ্কা করলেও ঋণের টাকায় তৈরি করছেন কারখানা।

জানা গেছে, সারা দেশে প্রায় ৬০ লাখ গরু আর ৭৫-৮০ লাখ ছাগল কুরবানি করা হয়ে থাকে। সারা দেশের চামড়ার ফড়িয়ারা তা সংগ্রহ করে লবণ দিয়ে বিক্রি করে থাকেন মজুদ কিংবা আড়তদারের কাছে। এসব আড়তদাররাও ফড়িয়াদের কাছ থেকে চামড়া কিনে থাকেন বাকিতে। একইভাবে সারা বছর তাদের থেকে চামড়া ক্রয় করে থাকেন ট্যানারি মালিকরা। তারাও চামড়া কিনে থাকেন বাকিতে। তারপরেও তারা চামড়ার প্রকৃত মূল্য পায় না। আর এ কারণেই সীমান্তে কোনভাবেই চামড়া পাচার রোধ করা যাচ্ছে না।

বাংলাদেশ ট্যানারি এসোসিয়েশন সাংবাদিক সম্মেলনে জানানো হয়, মওসুমী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সরকার নির্ধারিত দামেই চামড়া কিনবেন ব্যবসায়ীরা। এজন্য সঠিক প্রক্রিয়ায় চামড়া সংরক্ষণ করে অপেক্ষা করার পরামর্শ দিয়েছে ট্যানারি এসোসিয়েশন।
এবারের ঈদে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে কম দামে চামড়া বিক্রি করেছেন মওসুমী ব্যবসায়ীরা। এজন্য তারা সিন্ডিকেটসহ ট্যানারি মালিকদের অভিযুক্ত করছেন। কিন্তু লবণ দিয়ে সংরক্ষণ করার পরেও প্রতি ফুট চামড়ার দাম পড়েছে মাত্র ৬৫-৭০ টাকা। এসব চামড়া ক্রয়ে তারা নগদ টাকা না দিয়ে বাকিতে চামড়া কিনতে চাচ্ছেন। কিন্তু বাকিতে তারা কোনভাবেই চামড়া বিক্রি করতে রাজি নয় ।

ব্যবসায়ীদের হিসাবে, এবছর তারা ৭৫ লাখ চামড়া ক্রয়ের টার্গেট নির্ধারণ করেছে। পাঁচ দিনে প্রায় ১০শতাংশ চামড়া সংরক্ষণ করেছেন তারা। এর বাইরে পশুর মাথা থেকে সংগ্রহ করা চামড়া পরিষ্কার করে খোলা জায়গায় রাখছেন শ্রমিকরা। ঠিকমতো সংরক্ষণের সুযোগ নেই অভিযোগ করে ক্ষোভ জানিয়েছেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা।
ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা আরও অভিযোগ করেছেন, সাভারে জায়গা না পেয়ে হাজারীবাগের রাস্তার উপরে চামড়া রাখায় ক্ষতির মুখে পড়ছেন তারা।

সংগ্রহে দেরি হওয়ার কারণে গত বছর ৩০ শতাংশ চামড়া সীমান্ত দিয়ে পাচার হয়েছে জানিয়ে ট্যানারি এসোসিয়েশন বলেছে, এবার আরও বেশি চামড়া পাচার হতে পারে। এজন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
চলতি মওসুমে সবমিলিয়ে ৭৫ লাখ পিস চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে। এমন দাবি করেছেন, বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশন বিটিএর সভাপতি শাহিন আহমেদ।

এবছর অন্যান্য মওসুমের চেয়ে বেশি চামড়া পাচার ঠেকাতে আগামী ১ মাস সীমান্তে কড়া নজরদারির অনুরোধ জানান তিনি। এদিকে, রাজধানীর পোস্তার পাশাপাশি সাভারের শিল্পনগরীতেও সীমিতভাবে চলছে চামড়া প্রক্রিজাতকরণের কাজ। সাভারের চামড়া শিল্পনগরী। প্রস্তুতির খোলস ছেড়ে পুরো বের হতে পারেনি এখনো।

তবে যে কয়টি কারখানা বা প্রস্তুত হয়েছে তাতেও দেখা যাচ্ছে না কুরবানি ঈদের ব্যস্ততা। চামড়া প্রক্রিয়াজত নিয়েই সময় কাটছে শ্রমিকদের। এগুলো এসেছে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গা থেকে। সারা দেশ থেকে চামড়া আসতে সময় লাগবে আরো কটা দিন। তবে তা নিয়ে শঙ্কাই জানালেন ব্যবসায়ীরা। এ বছর অন্যান্য মওসুমের চেয়ে বেশি চামড়া পাচারের আশংকা করছে বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশন বিটিএ।
প্রশ্ন হলো সারা দেশে গরু-ছাগল মিলে কুরবানি পশুর সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ। এবারের ঈদের চামড়া কিনার টার্গেট ৭৫ লাখ। বাকি ৬৫ লাখ চামড়ার কি হবে। এসব চামড়া পাচারের সুযোগ করা হয়েছে কার স্বার্থে। যদি পাচারই না হয় তাহলে কি হবে এসব চামড়ার।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ যদি চামড়ার দাম না পাওয়া যায় তাহলে পাচার হতে বাধ্য। সরকার কোনভাবেই পাচার রোধ করতে পারবেনা। সীমান্তে যতই কড়া নজরদারি করা হউক না কেন। তাদের অভিযোগে ভারতে প্রতি ফুট চামড়ার দাম ১৩৫ টাকা। আর বাংলাদেশের তার মূল্য মাত্র ৬৫ টাকা। প্রতি ফুট চামড়ায় দামের পার্থক্য ৮০ টাকা। তাহলে সরকার কিভাবে পাচার ঠেকাবে আমাদের বুঝে আসে না।
তাছাড়া গত দুই বছরের বকেয়া টাকাও পায়নি তারা। তাহলে কিভাবে এবছরও তারা চামড়া বাকিতে বিক্রি করবে। আর চামড়া পাচার করতে কোন বাকি নেই। নগদ টাকা পাওয়া যায়। দামও পাওয়া যায় দ্বিগুণ। তাহলে কেন তারা চামড়া পাচার করবে না। এমন প্রশ্নও করেন ব্যবসায়ীরা।
তবে চামড়া পাচারের এই দায় নিতে রাজি নয় ট্যানারি মালিকরা। তারা বলছেন,সরকার কোন কারন ছাড়াই সাভারে ট্যানারি স্থনান্তর করছেন। অনেকে কারখানা তৈরি করতে ব্যাংক ঋণ নিচ্ছেন। অনেকে আবার চামড়া কিনতে পাওয়া ঋণে র টাকায় উন্নয়ন কাজ করছেন। তারা বলেন,এ শিল্পকে বাচাতে হলে সাভারে পুরোদমে উৎপাদনে যেতে হবে। তা না হলে এ শিল্প টিকিয়ে রাখা যাবে না।
তাদের অভিযোগ প্লট বরাদ্দে কাজ না পাওয়াতে অনেকেই ব্যাংক ঋণ পাচ্ছে না। আর এ কারনেই বকেয়া টাকা পরিশোধ করতে পারছে না ট্যানারি মালিকরা। এর দায়ভার সরকারকেই নিতে হবে। সারা দেশের ক্ষুদ্র ব্যবসাযীরা বলছেন,আমরা দায়ভার বুঝিনা টাকা পেলেই চামড়া বিক্রি হবে। বাকিতে আর চামড়া বিক্রি হবে না। আমাদের পিট দেয়ালে ঠেকে গেছে।
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ অগ্রিম টাকা না পাওয়ার কারণেই এবছর চামড়া কিনার ফড়িয়ার সংখ্যা ছিল খুবই কম। সারা দেশে প্রায় ১ লাখ ফড়িয়া চামড়া কিনে থাকলেও এবছর এ কাজ করেছে মাত্র ২০ হাজার লোক। এতে করে অনেকেই চামড়া বিক্রি করার সুযোগও পায়নি।
জানা গেছে, কোরবানির চামড়ার কিনতে দেয়া ঋণের টাকা খুব একটা কাজে আসেনি। ব্যাংক ঋণের টাকায় চামড়ার বকেয়া পরিশোধ না করে চলছে সাভারের ট্যানারি পল্লি উন্নয়ন কাজ। এতে করে চামড়া কিনে হতাশ হয়ে পড়ছেন সারা দেশের ক্ষুদ্র চামড়ার ব্যবসায়ীরা। আর ট্যানারি মালিকরা বলছেন,এখনও ৫০ ভাগ চামড়া অবিক্রিত রয়ে গেছে। উন্নয়ন কাজ চলায় নতুন করে বেশি চামড়া তারা কিনতে পারছে না। এ অবস্থায় চামড়া পাচারের আতঙ্ক করছে ব্যবসায়ীরা।
জানা গেছে, সরকার প্রতি বছরই চামড়া কিনতে নতুন করে ব্যাংক ঋণ দিয়ে থাকেন। সে টাকায় সারা দেশের ক্ষুদ্র চামড়া ব্যবসায়ীদের পাওনা পরিশোধ করা হলে সে টাকায় কাচা চামড়া কিনেন তারা। লবণজাত করে সে চামড়া সংরক্ষন করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। পরে ট্যানারি মালিকর া তাদের চাহিদা মত সে চামড়া ক্রয় করে থাকেন।
কিন্তু এ বছর অবস্থা ঠিক তার উল্টো। ব্যাংক ঋণের টাকা বকেয়া পরিশোধ না করে সাভারের ট্যানারি পল্লিতে কারখানা তৈরি করছে মালিকরা। তারা বলছেন,আমাদের রফতানি অর্ডার বাতিল হওয়াতে গত বছরের চামড়াই অবিক্রিত রয়ে গেছে। নতুন চামড়া কিনে কি হবে। তা ছাড়া এ বছর অনেকে ব্যাংকের আগের ঋণ পরিশোধ করতে পারেনি। আর যারা পরিশোধ করতে পারেনি। তারা নতুন করে ঋণ পায়নি। আর এ কারনেই তারা নতুন চামড়া কিনতে পারছে না। একইভাবে বকেয়াও পরিশোধ করতে পারছে না।
এবারও প্রায় ৮০০ কোটি টাকা ঋণ দেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে তারা। তবে এই ঋণ খুব একটা কাজে আসেনি বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা। তারা এ টাকায় বকেয়া পরিশোধ না করে অন্য কাজে ব্যয় করছেন। তাহলে আমরা ক্রয় করা চামড়া কি করবো। চামড়ার এই মহা বিপর্যয়ের জন্য কে দায়ী এ ব্যাপারে সরকার নিরব দর্মকের ভুমিকা পালন করছে। তাদের মতে ঋণের টাকায় যারা চামড়া কিনছে না তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিৎ। তা না হলে চামড়া পাচার হবেই। অথচ সরকারের পক্ষ থেকে কোন ধরনের বাজার মনিটরিং নেই।
বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, ট্যানারির বর্তমান যে অবস্থা সেটি শতভাগ চামড়া প্রক্রিয়াকরণের জন্য পর্যাপ্ত নয়। এখনও অনেক কিছু ঘাটতি আছে। সেগুলো সম্পন্ন হওয়ার পর বলা যাবে শতভাগ চামড়া প্রক্রিয়াকরণে কতটা সময় লাগবে। এছাড়া এ বছরই প্রথম চামড়া প্রক্রিয়াকরণের জন্য সাভারের ট্যানারি পল্লী ব্যবহার করা হবে।
তিনি বলেন,প্রতি বছরই ২০ ভাগ চামড়া পাচার হয়ে থাকে। এবছর একটু বেশি হওয়ার আশঙ্কা করছি। কারণ হিসেবে তিনি বলেন,এবছর ট্যানারি মালিকদের কাছে তেমন টাকা নেই। এখনও আমরা বকেয়া পরিশোধ করতে পারিনি। তাহলে কিভাবে নতুন চামড়া ক্রয় করবো। আমাদের চামড়া কিনতে একটু সময় লাগবে। আর একারনেই সরকারকে সীমান্তে পাচার ঠেকাতে হবে।
চামড়ার ব্যবসায়ী দেলোয়ার হোসেন সাফ জানিয়ে দিয়েছেন বকেয়া তারা এ বছর পরিশোধ করতে পারছে না। একইভাবে তারা নতুন করে খুব বেশি চামড়াও কিনতে পারছেন না। তাহলে কি হবে চামড়া ব্যবসায়ীদের। এই ব্যবসায় এখন টিকে থাকাই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়িয়েছে।
তিনি আরও বলেন,সরকার যদি এগিয়ে না আসে তাহলে এ শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে। চামড়া পাচার হয়ে যাবে প্রতিবেশি দেশে। যা আমাদের কারো কাম্য নয়। সরকার যদি কাঁচা চামড়ার ব্যবসায়ীদের ক্ষুদ্র ঋণ দিয়ে পারে তাহলেই কেবল এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব।
সীমান্ত পথে চামড়া ভারতে পাচারের কোনো শঙ্কা আছে কিনা-এ প্রসঙ্গে চামড়া ব্যবসায়ী ইউসুফ আলী বলেন, এ আশঙ্কা এ বছর আরও বেড়েছে। এবার বড় সঙ্কট হলো অর্থ। চামড়ার প্রকৃত মূল্য না পেলে তা পাচার হবেই। কোনভাবেই তা ঠেকানো যাবে না। অর্থ সংকটের কারণে ভারতীয় টাকা এবার চামড়া কিনতে হবে। এবং তা পাচার হতে বাধ্য।

http://www.dailysangram.com/post/298949