৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭, শনিবার, ৮:০৪

বিচার বিভাগের ক্ষমতা

আত্মপক্ষ

এবনে গোলাম সামাদ

আমাদের দেশে এখন এমন অনেক বিষয় নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে, যা নিয়ে আসলে কোনো বিতর্ক হওয়া উচিত ছিল না। কেননা এসব ব্যাপার নিয়ে ইউরোপে অনেক আলোচনা হয়েছে। আমরা আমাদের গণতন্ত্রের ধ্যান-ধারণা লাভ করেছি বিলাতের কাছ থেকে। বিলাতে হাইকোর্ট অব দি পার্লামেন্ট বলতে বোঝায়, রাজা বা রানি, লর্ডস সভা এবং কমন্স সভা সমন্বয়ে গঠিত পার্লামেন্টকে। বিলাতে কখনো বিচার বিভাগ পার্লামেন্ট বা আইনসভা থেকে আলাদা ছিল না। এখনো বিলাতে হাউজ অব লর্ডসের কাছে সে দেশের নাগরিকেরা বিচারের জন্য আবেদন করতে পারে। অন্য দিকে হাউজ অব কমন্স ও লর্ডস যদি কোনো বিচারপতিকে অযোগ্য অথবা অসদাচরণের জন্য দায়ী করে, তবে তাকে পদচ্যুত হতে হয়।

বিলাতে পার্লামেন্ট হলো সর্বোচ্চ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। বিলাতের রাজা অথবা রানীকে মেনে চলতে হয় তার নির্দেশ। বিলাতে মন্ত্রিপরিষদ নির্ভর করে আইনসভার ওপর। কোনো মন্ত্রিপরিষদ যদি আইনসভার বেশির ভাগ সদস্যের সমর্থন হারায়, তবে তাকে পদত্যাগ করতে হয়। কিন্তু আমাদের দেশে এখন বোঝানোর চেষ্টা হচ্ছে, বিচার বিভাগ পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রে একটি স্বাধীন পৃথক বিভাগ। যেটা বিলাতের ইতিহাসে সত্য নয়। সত্য হতেও পারে না। কেননা, তাহলে পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র অচল হয়ে পড়বে। পার্লামেন্ট আর সার্বভৌম প্রতিষ্ঠান থাকতে পারবে না। বিচার বিভাগ সরকারের মধ্যে হয়ে উঠতে চাইবে একটা পৃথক সরকার।
ভারতে চলেছে পার্লামেন্টারি ব্যবস্থা। ভারতে সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের বিচারপতিদের সে দেশের পার্লামেন্ট অযোগ্যতা এবং অসদাচরণের জন্য বরখাস্ত করতে পারে। তবে এই বরখাস্ত করতে হলে রাজ্যসভা ও লোকসভায় ওই বিচারপতির বিরুদ্ধে কম করে থাকতে হয় দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের ভোট। যারা বলছেন ভারতে বিচারপতিরা পার্লামেন্টের অধীন নন, তারা তাই যা বলছেন তার বাস্তব ভিত্তি নেই। ভারতেও পার্লামেন্ট বা আইনসভার সার্বভৌমত্ব স্বীকৃত। কেননা প্রত্যেক গণতন্ত্রের ভিত্তি হলো সে দেশের নাগরিকদের অভিমত। তাদের বাদ দিয়ে গণতন্ত্র সচল হতে পারে না।

ব্রিটেনে গণতন্ত্র সফল হতে পেরেছে, এর কারণ সে দেশে গণতন্ত্রকে সমর্থন করেছে সে দেশের নাগরিকেরা। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সাফল্য নির্ভর করবে বাংলাদেশের নাগরিকেরা কতটা গণতান্ত্রিক মনোভাবের পরিচয় বহন করবেন, তার ওপর। গণতন্ত্রের ভিত্তি হলো জনমত। জনমত, রাজনৈতিক দল ও মুক্ত অবাধ নির্বাচন এনে দেয় একটি দেশের গণতন্ত্রের সাফল্যকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হলো প্রেসিডেন্ট-নির্ভর গণতন্ত্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যদি মার্কিন আইনসভা বা কংগ্রেসের নি¤œকক্ষ বা হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভ অভিযোগ আনে, কোনো প্রেসিডেন্ট প্রেসিডেন্ট থাকার যোগ্য নন এবং তার সেই অভিযোগ যদি মার্কিন আইনসভার উচ্চকক্ষ বা সিনেটে কম করে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য সমর্থন করে, তবে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে পদচ্যুত হতে হয়। একইভাবে মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে যদি অযোগ্যতা অথবা অসদাচরণের অভিযোগ ওঠে হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভে এবং তা সিনেটে কম করে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের ভোটে স্বীকৃত হয়, তবে ওই বিচারককে হতে হয় চাকরিচ্যুত।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সুপ্রিম কোর্ট খুবই শক্তিশালী। কেননা সুপ্রিম কোর্ট যদি বলে কোনো আইন মার্কিন সংবিধান সম্মত নয়, তবে সেই আইন মার্কিন আইনসভা কর্তৃক প্রণীত হলেও তা বাতিল হয়ে যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চেষ্টা করা হয়েছে প্রেসিডেন্ট, আইনসভা ও বিচার বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখার। মার্কিন প্রেসিডেন্ট তার নিজের উপদেষ্টাদের নিজের পছন্দমতো গ্রহণ করেন। তিনি এ জন্য মার্কিন আইনসভার ওপর নির্ভরশীল নন। যদিও এ ক্ষেত্রে তাদের কিছুটা অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। কিন্তু আমাদের দেশ অনুসরণ করতে চাচ্ছে পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র। পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রে আইনসভা হলো সার্বভৌম। পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র সেখনেই সাফল্য লাভ করে, যেখানে জনমত থাকে তার পক্ষে। কিন্তু আমরা যেন এই মোটা কথাটাকে ভুলে যেতেই চাচ্ছি। ফলে সৃষ্টি হতে চাচ্ছে রাজনৈতিক সঙ্কট। আমরা যদি আমাদের দেশে পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র চাই, তবে আইনসভার সার্বভৌমত্ব মেনে নিতে হবে। আর যদি বিচার বিভাগকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো ক্ষমতাধর করতে চাই, তবে মার্কিন গণতন্ত্রকে অনুসরণ করাই হবে শ্রেয়। ত্যাগ করতে হবে পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র।

আমি আমাদের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির অনেক আচরণে বিস্মিত না হয়ে পারিনি। বাংলাদেশ একটা মুসলিম অধ্যুষিত দেশ। এ দেশের মানুষ সাধারণভাবেই মূর্তি পূজাবিরোধী। কিন্তু তিনি হাইকোর্টের চত্বরে স্থাপন করতে চাইলেন গ্রিক বিচারের দেবীর মূর্তি। কিন্তু তিনি কেন এটা করতে চান, সেটা আমার কাছে থেকে গিয়েছে খুবই রহস্যময়। নান্দনিক দিক থেকেও এ রকম মূর্তি স্থাপন বর্তমান হাইকোর্টের চত্বরে অসঙ্গতিপূর্ণ। বর্তমান হাইকোর্টের স্থাপত্য হলো, ইন্দো-সারাসেনিক। এতে মূর্তি খাপ খায় না। যা খাপ খায়, তা হলো ফোয়ারা ও ফুলের বাগান। এখন তিনি তুলছেন বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা। কিন্তু পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রে বিচার বিভাগকে মেনে চলতে হবে আইনসভার সিদ্ধান্ত। বিলাতেও পার্লামেন্ট পারে যেকোনো ব্যক্তির সাজা মওকুফ করে দিতে। রাজা বা রানীর সেই ক্ষমতা আছে। রাজা অথবা রানী এখন সব সিদ্ধান্তই গ্রহণ করতে বাধ্য পার্লামেন্টের নির্দেশে। কেননা ব্রিটেনে চলেছে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র। রাজা বা রানীর নিজস্ব কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা আর নেই।
আমাদের বর্তমান প্রধান বিচারপতি বিচার বিভাগের যে ধরনের স্বাধীনতা দাবি করছেন, সেটাকে তাই কোনোভাবেই মেনে নেয়া চলে না। যদিও আমাদের দেশকে চলতে হয় জনমত-ভিত্তিক হয়ে। আমাদের বর্তমান প্রধান বিচারপতি গুরুত্ব দিচ্ছেন আইনের সার্বভৌমত্বকে। কিন্তু আধুনিক গণতন্ত্রে গুরুত্ব পায় জনগণের সার্বভৌমত্ব। এ দিক থেকে বলতে হয়Ñ আমাদের প্রধান বিচারপতির চিন্তা-চেতনা আধুনিক গণতান্ত্রিক ভাবধারার সাথে মোটেও সঙ্গতিপূর্ণ নয়। প্রধান বিচারপতির অনেক বক্তব্য হয়ে উঠেছে বিশেষভাবেই রাজনৈতিক। তাতে মনে হয়, তিনি যতটা না বিচারপতি, তার চেয়ে অধিক হলেন রাজনীতিক। তিনি হয়ে উঠেছেন তাই বিতর্কিত।

আমি কোনো দিন আইনের ছাত্র ছিলাম না। আইন-আদালত থেকে ছিলাম অনেক দূরে। যদিও বা মামলা-মোকদ্দমা একেবারেই এড়াতে পারিনি। তবে আমার জীবনের একটা লক্ষ্য থেকেছে আইন-আদালত থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকার চেষ্টা করা। তবে বিশেষ কারণে আমার কিছুটা পরিচিত হওয়ার সুযোগ ঘটেছিল এককালের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের সাথে। আমি তাকে একজন জ্ঞানী ব্যক্তি বলে শ্রদ্ধা করতাম। মনে পড়ছে, তিনি একবার বলেছিলেন, বিচারকরাও মানুষ, তারা অতিমানব নন। তাদের বিচারেও ভুল হতে পারে এবং হয়েও থাকে। একটি গণতান্ত্রিক দেশের মানুষের তাই অধিকার থাকা উচিত বিচারকদের বিচারের সমালোচনা করার। এই সমালোচনার মাধ্যমে বিচারব্যবস্থার উন্নতি হওয়া সম্ভব। একে তাই দোষনীয় ভাবা যুক্তিযুক্ত নয়। আদালত অবমাননা করা হচ্ছে বলেও মনে করা উচিত হবে না।
কোনো দেশেই আদালতের রায় দিয়ে ইতিহাস তৈরি হয়নি। বিলাতের ইতিহাস পড়লে দেখি, অলিভার ক্রমওয়েল রাজার বিরুদ্ধে ঘটিয়েছিলেন অভ্যুত্থান। বিলাতে প্রথম রাজার মাথা কাটা যায় প্রজাদের হাতে। ক্রমওয়েলের অভ্যুত্থানের পর আবার বিলাতে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায়। কিন্তু রাজার সাবেক কর্তৃত্ব আর ফিরে আসে না। পার্লামেন্ট হয়ে ওঠে সার্বভৌম। ক্রমওয়েল ছিলেন পিউরিটান খ্রিষ্টান। ক্রমওয়েলের মৃত্যুর পর বিলাতে পিউরিটান খ্রিষ্টানরা হতে থাকেন বেশকিছুটা নির্যাতনের শিকার। বিলাত থেকে কিছু পিউরিটান খ্রিষ্টান এসে উপনিবিষ্ট হন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। যারা পরে গ্রেট ব্রিটেনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে গড়েন বর্তমান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আজকের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূলে আছে পিউরিটানদের প্রজাতন্ত্রের ধারণা। এখন বলা হচ্ছেÑ জঙ্গিবাদ বর্জনীয়। কিন্তু বিলাতের ইতিহাসে জঙ্গিবাদ রাজার স্বৈরাচার কমাতে সহায়ক হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ স্বাধীন হয়েছে যুদ্ধের মাধ্যমে। মানুষের ইতিহাসে যুদ্ধ বিরল ঘটনা নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যুত্থান ছিল প্রজাতান্ত্রিক, যা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ফরাসিরা করেছিল ফরাসি বিপ্লব।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/250167