নাফ নদীর শাহপরীর দ্বীপ পয়েন্টে রোহিঙ্গাবোঝাই একটি নৌকা ডোবার পর স্বজনের খোঁজে আসা এক নারীর আহাজারি। ছবিটি গতকাল সকালে তোলা
৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭, শুক্রবার, ৪:১২

টেকনাফ সীমান্তে রোহিঙ্গাদের লক্ষ্য করে মিয়ানমার বাহিনীর গুলি

১০ রোহিঙ্গার মৃত্যু : আরো ১১টিসহ এক সপ্তাহে ৮৪টি লাশ উদ্ধার; অসহায় রোহিঙ্গাদের টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার কেড়ে নিচ্ছে দুর্বৃত্তরা

মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের তুমব্রু সীমান্তের বিভিন্ন স্থানে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের লাশ পাওয়া যাচ্ছে। অনেক লাশ পচেগলে বাতাসে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এ দিকে টেকনাফের নাফ নদীর উলুবুনিয়া সীমান্তে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের লক্ষ্য করে বেপরোয়া গুলিবর্ষণ করেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। তাদের ছোড়া কিছু গুলি নাফ নদী পেরিয়ে এপারের উলুবুনিয়ায় বাংলাদেশীদের গ্রামে এসে পড়েছে। এতে সীমান্ত এলাকার লোকজন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। এ দিকে টেকনাফের নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগরের বিভিন্ন পয়েন্টে ১১ জন রোহিঙ্গা নারী ও শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। গত এক সপ্তাহে কক্সবাজারে এ নিয়ে অন্তত ৮৪ রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার হয়েছে। এ ছাড়া টেকনাফে আশ্রয় নেয়া আহত ও অসুস্থ তিন রোহিঙ্গার মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে এবং বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি ও উখিয়ার বালুখালী সীমান্তে মিয়ানমার থেকে মাইন বিস্ফোরণে আহত হয়ে আসা সাত রোহিঙ্গা মারা গেছেন।

সীমান্তের উলুবুনিয়া এলাকার ইউপি সদস্য হাজী জালাল আহমদ জানান, বুধবার দুপুরে হঠাৎ ব্রাশ ফায়ারের শব্দ শোনা যায়। পরে জানা গেছে, হোয়াইক্যং ইউনিয়নের উলুবুনিয়া সীমান্তে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের লক্ষ্য করে বেপরোয়া গুলি বর্ষণ করেছে। তবে বাংলাদেশী কোনো নাগরিক আহত হননি। অনেকে সেই বুলেট সংগ্রহ করেছেন। অপর দিকে বুধবার একই সময় নাফ নদীর ওপারে ঢেঁকিবনিয়ার বেশ কিছু রোহিঙ্গা বসতবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেছে সেনারা।
তিনি বলেন, আরকানের বুচিডং এলাকা থেকে পাহাড়ি পথে পালিয়ে আসার সময় নৌকায় নাফ নদী হয়ে বাংলাদেশ সীমান্তের জিরো পয়েন্টে চলে আসার চেষ্টা করলে মিয়ানমারের সেনাসদস্যরা তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। এতে ওই নৌকার যাত্রীরা সবাই পানিতে লাফ দেন। পরে আমরা নাফ নদী থেকে এক মহিলা ও চার পুরুষের লাশ উদ্ধার করি। উদ্ধারকৃত লাশগুলো মিয়ানমারের তমবাজার রাম্মুইয়া পাড়ার আব্দু শুক্কুরের ছেলে ছৈয়দ আলম, একই গ্রামের শামশুল আলম, আব্দুল আজিজের মেয়ে সুফিয়া বেগম, অছিয়র রহমানের ছেলে ফয়েজুর রহমান ও স্থানীয় মাদরাসার শিক্ষক আব্দুল জব্বরের ছেলে কারি ফয়েজুল ইসলামের।

কক্সবাজার ৩৪ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল মনজুরুল হাসান খান বলেন, নিহতদের আত্মীয়স্বজন লাশগুলো এ পারে নিয়ে আসেন। স্থানীয় ইউপি সদস্য কামাল উদ্দিন বলেন, নাফনদীর সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে বুধবার বেলা ১টায় পাঁচজনের লাশ তাদের স্বজনেরা নিয়ে এলেও আরো অনেকেই হতাহত হয়েছেন। বিজিপির কড়া পাহারার কারণে বাকি লাশগুলো আনতে পারেননি তারা। উলুবুনিয়া সীমান্ত বরাবর পূর্বে মিয়ানমারের উপকূলীয় এলাকা টেকিবনিয়া, কুয়ানচিবং ও রাইম্মনখালীর মধ্যবর্তী গুদুরা বাজার এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। বুচিডংয়ের তংবাজার থেকে একদল নির্যাতিত রোহিঙ্গা সীমান্তের দিকে যাওয়ার সময় বিজিপি সদস্যরা তাদের ধাওয়া করে ও গুলি চালায়।
একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের লক্ষ্য করে বেপরোয়া গুলি করে বিজিপি সদস্যরা। এ সময় অনেক রোহিঙ্গা গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে ঢলে পড়েন। কিছু রোহিঙ্গাকে ধাওয়া করে একটি বাড়িতে তালাবদ্ধ করে বাইরে থেকে আগুন লাগিয়ে দেয়। এত কয়েকজন পুড়ে হতাহত হয়েছেন। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা আরো জানিয়েছেন, গুলিতে ও পুড়ে নিহতের সংখ্যা ৪০ জনে ছাড়িয়ে যেতে পারে। গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হয়েছেন ১৪ জন। তারা ওই এলাকার বিভিন্ন রোহিঙ্গাদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন।

মংডুর যেসব অঞ্চলের রোহিঙ্গা পল্লীতে এখনো সেনাবাহিনী তাণ্ডব চালায়নি, সেসব গ্রামের গণ্যমান্য রোহিঙ্গাদের বুধবার দুপুরে ডেকে বিশেষ সভা করেছে সামরিক প্রশাসন। ওই সভায় প্রশাসনের উপস্থিত রোহিঙ্গাদেরকে সামরিক কর্মকর্তারা বলেন, আমরা তোমাদের আর হত্যা, নির্যাতন করব না, বাড়িঘরে আগুন দেয়া হবে না। তোমরা আগের মতো এখানে বসবাস করতে পারবে। তবে একটি শর্ত পালন করতে হবে। তোমাদের নিজেদের বসতঘরে তোমরা আগুন লাগিয়ে দিবে এবং তা ভিডিও করে আমাদেরকে দেবে। কেউ আগুন না দিলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও হুমকি দেয়া হয়। এমন তথ্য জানিয়েছেন পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা। প্রশাসনের এমন আদেশে রোহিঙ্গাদের মধ্যে নতুন করে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। এসব রোহিঙ্গা এখন কি করবেন ভেবে না পেয়ে প্রাণ বাঁচাতে সীমান্তের দিকে এগিয়ে আসছেন।

রোহিঙ্গাদের নৌকা ডুবিয়ে দিচ্ছে দুর্বৃত্তরা : মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বর্বরতার শিকার হয়ে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা নাফ নদীতে নৌকা ডুবিতে মারা যাচ্ছেন বলে সংবাদ প্রচার হলেও রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন ভিন্ন কথা। তারা বলছেন, দুর্বৃত্তরা তাদের জীবন বাঁচাতে সহযোগিতার কথা বলে নৌকায় কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থানে এনে পণবন্দী করে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করছে। স্বর্ণালঙ্কারসহ সব কিছু ছিনিয়ে নিচ্ছে। অনেক সময় তারা এ কাজে ব্যর্থ হয়ে তাদের বহনকারী নৌকা ও ট্রলার ডুবিয়ে দিচ্ছে। এতে অনেকেই ডুবে মারা যাচ্ছেন। এদিকে টেকনাফের নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগরের বিভিন্ন পয়েন্টে ১১ জন রোহিঙ্গা নারী ও শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। গত এক সপ্তাহে কক্সবাজারে এ নিয়ে অন্তত ৮৪ রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার হয়েছে। এ ছাড়া টেকনাফে আশ্রয় নেয়া আহত ও অসুস্থ তিন রোহিঙ্গার মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে এবং বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি ও উখিয়ার বালুখালী সীমান্তে মিয়ানমার থেকে মাইন বিস্ফোরণে আহত হয়ে আসা ৭ রোহিঙ্গা মারা গেছেন। এদিকে টেকনাফ সীমান্তের নাফনদী পয়েন্ট থেকে পৃথকভাবে দুই হাজার ৩৭২ জন রোহিঙ্গাকে আটক করে মিয়ানমারে ফেরত পাঠিয়েছে বিজিবি ও কোস্টগার্ড।

স্থানীয় ও সীমান্তের প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, নাফ নদীতে রোহিঙ্গাদের প্রাণহানী অপমৃত্যু নয়, আসলে দুর্বৃত্তরাই তাদের হত্যা করছে। আশ্রয়প্রার্থী রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন, সীমান্তের কিছু দুর্বৃত্ত চক্র অনেক রোহিঙ্গাকে বন্দিশালায় আটকে রেখে নির্যাতনের মাধ্যমে বিদেশে থাকা তাদের স্বজনদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। বিদেশে থাকা স্বজনেরাও নিরুপায় হয়ে টাকার বিনিময়ে দুর্বৃত্তদের হাত থেকে আত্মীয়দের ছাড়িয়ে নিচ্ছেন।
পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, মিয়ানমার সীমান্ত থেকে টেকনাফ উপকূল পর্যন্ত পৌঁছে দিতে এসব দুর্বৃত্ত চক্র রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে জনপ্রতি পাঁচ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা আদায় করছে। যারা টাকা দিতে পারছে না অথবা টাকার পরিমাণ কম তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হচ্ছে স্বর্ণালঙ্কার, টাকা, কাপড়সহ মূল্যবান সব কিছু। আবার পরিবারের দু-একজন সদস্যকে আটকে রেখে বাকিদের ছেড়ে দেয়া হচ্ছে দালালদের চাহিদা মতো টাকা সংগ্রহ করে আনতে। শুধু তাই নই, তাদের চাহিদা মতো টাকা পরিশোধ করতে না পারায় দুর্বৃত্তরা রোহিঙ্গা বোঝাই ট্রলার ডুবিয়ে দিচ্ছে। ফলে নারী, শিশু ও বৃদ্ধরা ডুবে মারা যাচ্ছেন। এদেরই লাশ পরে ভেসে উঠছে নাফ নদী ও সাগর উপকূলে।

আরকান রাজ্যের উদং থেকে আসা মোক্তার আহমদের ছেলে এজাহার হোসেন জানান, মিয়ানমার সীমান্তের নাইক্ষ্যংদিয়া হতে এপারের শাহপরীর দ্বীপ পশ্চিম পাড়া পর্যন্ত জনপ্রতি আট হাজার টাকা করে দিয়ে এলেও পরে অতিরিক্ত টাকা দাবি করে দুর্বৃত্তরা। টাকা পরিশোধ করতে না পারায় শাহপরীর দ্বীপ উত্তর পাড়ার কালা নামের এক প্রতারক তার মা ও ভাইকে দুইজনকে আটকে রাখে। তারা ওই নৌকায় ২৫ জন ছিলেন। বর্তমানে তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছে জানা যায়নি।
মিয়ানমারের মেরুল্লা এলাকা থেকে আসা মো: জাকারিয়া জানান, তার বোটওয়ালা প্রতারক তার স্ত্রীর কাছ থেকে দেড় ভরি ওজনের স্বর্ণের চেইন ও কাপড় কেড়ে নিয়েছে এবং পরিবারের তিন সদস্যকে আটকে রেখেছে। সদর ইউনিয়নের নতুন পল্লান পাড়া এলাকার মাঝিরূপী ওই দালালের নাম না জানলেও তার একটি মোবাইল নম্বর (০১৮৭৭৫৫০৩৮৬) সংগ্রহে রয়েছে।
মিয়ানমারের মেরুল্লা থেকে আসা মমতাজ আহমদের স্ত্রী মুর্শিদা বেগম জানান বাহারছড়া ইউনিয়নের নোয়াখালীয়াপাড়ার মৃত হাসন আহমদের ছেলে ছৈয়দ আলম ও দক্ষিণ শীলখালীর মৃত অলী আহমদের ছেলে মনসুর আলম ৩০ জন রোহিঙ্গাকে এনে দেয়ার কথা বলে এক লাখ ৭০ হাজার টাকা নিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে আনার পর আমির আলীর স্ত্রী ফারহানা বেগম (৪০)-এর কাছ থেকে ৪ ভরি স্বর্ণালঙ্কার এবং মালয়েশিয়া প্রবাসী কবির আহমদের স্ত্রী রেসমিন বেগম (২৭)-এর কাছ থেকে ১৩ লাখ টাকা কেড়ে নিয়েছে।

টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো: মাইন উদ্দিন খান জানান, রোহিঙ্গাদের সহায়তার নামে যারা অপরাধ করছে সেসব প্রতারককে ধরতে পুলিশ কাজ করছে। ভ্রাম্যমাণ আদালতে ৪২ প্রতারককে সাজা দেয়া হয়েছে জানিয়ে ওসি আরো জানান, রোহিঙ্গাদের নিয়ে যারা ব্যবসায় করবে তাদের ছাড় দেয়া হবে না।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাহিদ হোসেন ছিদ্দিক জানান, এই দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক অভিযান অব্যাহত আছে। এরই মধ্যে বোট মালিক এবং জেলেদের নিয়ে সচেতনতামূলক সভা করা হয়েছে। জনপ্রতিনিধি এবং সংশ্লিষ্টদের এ বিষয়ে সজাগ থাকতে বলা হয়েছে।

টেকনাফে ৩ রোহিঙ্গার মৃত্যু : আরো ১১টি লাশ উদ্ধার : টেকনাফের নাফ নদীর ও বঙ্গোপসাগরের বিভিন্ন পয়েন্টে ১১ জন রোহিঙ্গা নারী ও শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগরে রোহিঙ্গা বহনকারী নৌকা ডুবির ঘটনায় তাদের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে টেকনাফে আশ্রয় নেয়া আহত ও অসুস্থ তিন রোহিঙ্গার মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।

টেকনাফ মডেল থানার ওসি মো: মাইন উদ্দিন খান বলেন, মিয়নমারে সহিংসতার পর থেকে বঙ্গোপসাগর ও নাফ নদী থেকে নৌকাডুবির ঘটনা ঘটেই চলছে। টেকনাফ উপজেলার শাহপরীর দ্বীপ পয়েন্টে তিনজন, টেকনাফে নোয়াখালীপাড়ার সাগর পয়েন্টে একজন ও বাহারছড়া পয়েন্টে তিনজন, টেকনাফ সদর ইউনিয়নের লেঙ্গুরবিলের তুলাতলী সাগর পয়েন্টে চারজন রোহিঙ্গার লাশ পাওয়া গেছে। এদের সবাই নারী ও শিশু। নাফ নদীর শাহপরীর দ্বীপ পয়েন্ট ও বঙ্গোপসাগরে কয়েকটি রোহিঙ্গা বহনকারী নৌকা ডুবে গেছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
টেকনাফে বুধবার সকালে সদর ইউনিয়নের লম্বরী সৈকত পয়েন্টে মিয়ানমার থেকে আসা আহত দুই রোহিঙ্গার মৃত্যু ঘটেছে। লাশগুলো তাদের স্বজনেরা লেদা ক্যাম্প সংলগ্ন এলাকায় দাফনের জন্য নিয়ে যান বলে জানান সদর ইউপি চেয়ারম্যান শাহাজান মিয়া।

এ ছাড়া বুধবার সকাল ৬টার দিকে টেকনাফ বাস স্টেশনের আবু ছিদ্দিক মার্কেট চত্বরে অন্য রোহিঙ্গাদের সাথে আসা এক বৃদ্ধার মৃত্যু হয়েছে। সীমান্ত পাড়ি দিতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে তার মৃত্যু হয়। তিনি রাখাইনের মংডু থানার উদং এলাকার অলি আহমদের স্ত্রী, তার নাম গুল সেহের (৭৯)। তিনি গত মঙ্গলবার রাতে শাহপরীর দ্বীপ সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশ করে টেকনাফের বাস স্টেশনে আসেন।
গত বুধবার ভোর রাতে সেন্টমার্টিন দ্বীপের অদূরে বঙ্গোপসাগরে সেন্টমার্টিন দ্বীপের একটি যাত্রীবাহী সার্ভিস ট্রলার ডুবে গেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। এতে শতাধিক রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশু ছিল। ট্রলারডুবির পর সবাই নিখোঁজ রয়েছে। তবে বাংলাদেশ কোস্টগার্ড বাহিনী সেন্টমার্টিন দ্বীপ স্টেশনের কর্মকর্তা আশ্রাফ জানান, সার্ভিস ট্রলারটি রোহিঙ্গা পুশব্যাক করতে মিয়ানমারের নাইক্ষ্যংদিয়ায় গিয়েছিল। ফেরার সময় ডুবে চরে আটকে ডুবে যায়। ডুবে যাওয়া ট্রলারটি উদ্ধার করে শাহপরীর দ্বীপে আনা হয়েছে।

সীমান্তের বাতাসে পচা লাশের গন্ধ : তুমব্রু থেকে উত্তর দিকে চলে গেছে বাইশফাঁড়ি সড়ক। ওই সড়ক দিয়ে কিছু দূর যেতেই পাওয়া গেল পচা লাশের গন্ধ। একটু সামনে গিয়ে দেখা গেল মানুষের জটলা। তাদের সাথে কথা বলে জানা গেল সেখানে লাশ অর্থাৎ সীমান্তের জিরো পয়েন্টের ‘মক্কুর টেইলা’ নামক স্থানে মাছি ভনভন করছে। বিজিবি পুলিশ একসাথে গিয়ে দেখল মাটির এক ফুট নিচে এক রোহিঙ্গা হতভাগার লাশ। পরে বিজিব সদস্যরা লাশটির উপরে আরো মাটি চাপা দিলো। এভাবে জিরো পয়েন্টের এ দিক সে দিক অনেক লাশ মাটি চাপা দেয়া হয়েছে। ফলে বাতাসে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। ঘুমধুম ইউপি চেয়ারম্যান এ কে এম জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, বুধবার রাতেও তুমব্রু খাল থেকে এক রোহিঙ্গার লাশ পাওয়া গেছে। ওদিকে নৌকাডুবিতে রোহিঙ্গাদের প্রাণহানির সংখ্যা বাড়ছেই। গতকাল বৃহস্পতিবার উদ্ধার হয়েছে আরো ৯টি লাশ। প্রতিদিন ভেসে আসছে লাশ। তাই সীমান্তের বাতাসে এখন লাশের গন্ধ। এ দিকে সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য বিজিবির ডাকে সাড়া দিচ্ছে না মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বিজিপি। বিজিবি ৩৪ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মনজুরুল আহসান খান জানান, ২৫ আগস্টের পর থেকে সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য বিজিবির পক্ষ থেকে ওদের (বিজিপি) অনেকবার মেসেজ পাঠানো হয়েছে কিন্তু কোনো যোগাযোগই করছে না তারা।

মঙ্গলবার রাতে এবং বুধবারও সীমান্তের অনেক স্থানে আগুনের লেলিহান শিখা ও কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখা গেছে। থেমে থেমে শোনা যাচ্ছে গুলির শব্দ। সীমান্ত এলাকা পালংখালী ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মোজাফ্ফর আহমদ ও ঘুমধুম ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এ কে এম জাহাঙ্গীর আজিজ জানান, সীমান্তের ওপারে বাড়িঘরে আগুন দেয়ার দৃশ্য এপার থেকে দেখা যাচ্ছে এখনো। সীমান্ত পেরিয়ে রোহিঙ্গাদের ঢল অব্যাহত রয়েছে। পথে পথে অনেকে মারা যাচ্ছেন।
বুধবার সকালে তুমব্রু সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের সময় দেখা হয় নাপ্পুরা কাচারবিল এলাকার ফরিদ উল্লাহর (৫৩) সাথে। স্ত্রী-পুত্রসহ পরিবারের ১১ সদস্য নিয়ে তিনি চার দিন পর বাংলাদেশ সীমান্ত পার হতে সক্ষম হন। তিনি বলেন, আমাদের বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে সেনারা, আমার মেয়ের জামাইকে ধরে নিয়ে চোখের সামনে কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেছে তারা। প্রাণ বাঁচাতে পাড়াতে আশ্রয় নিই বললেন ফরিদ উল্লাহ। দুপুরে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের সময় দেখা হয় ফকিরাবাজার এলাকার নবী হোসনের (৬৫) সাথে। তিনি জানান, গত সোমবার আমার বাড়িতে আগুন দিয়েছে সেনারা। পরিবারের সাত সদস্য নিয়ে পালিয়ে এসেছি।

মংডু শহরের নিকটবর্তী রোহিঙ্গা অধ্যুষিত চারটি গ্রাম সোজাপাড়া, ঢলিয়া পাড়া, নলবনিয়া ও ঘোনার পাড়া সোমবার রাতে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। আগুনে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনাও ঘটেছে। এর পরিপ্রেেিত ওই চার গ্রামের বাসিন্দারা এখন সীমান্ত পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করছেন। বর্তমানে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী মিয়ানমারের পাহাড়ে নো ম্যান্স ল্যান্ডের বিভিন্ন পয়েন্টে এবং নাফ নদীর পাশে লাখ লাখ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের অপোয় রয়েছেন। ইতোমধ্যেই কয়েক লাখ রোহিঙ্গা চলে এসেছেন বাংলাদেশে। এখনো দলে দলে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে।

নতুন আসা রোহিঙ্গাদের ঠাঁই হচ্ছে না কোথাও। এসব রোহিঙ্গা উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালী, টেকনাফের লেদা ও শাপলাপুরে স্থান না পাওয়ায় নিয়ন্ত্রণহীন পরিবেশে উখিয়ার কুতুপালং থেকে শুরু করে থাইংখালী পর্যন্ত ৫ কিলোমিটার এলাকার পাহাড়ে অবস্থান নিয়েছেন। টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের উনচিপ্রাংয়ের পশ্চিমের পাহাড়ে গড়ে উঠেছে নতুন রোহিঙ্গা বস্তি। সেখানে লাখের কাছাকাছি রোহিঙ্গা অবস্থান করছেন। তবে এ বস্তিটি পুরোটাই বিজিবির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এ ছাড়া টেকনাফ উখিয়ার অলিগলিতে রোহিঙ্গারা আশ্রয়হীনভাবে এ দিক সে দিক ছুটছেন খাদ্য ও আশ্রয়ের সন্ধানে। মেরিন ড্রাইভ দিয়েও রোহিঙ্গারা ছুটে যাচ্ছেন কক্সবাজার শহরের দিকে। কক্সবাজার শহরতলির সমিতিপাড়ায়ও দলে দলে রোহিঙ্গারা আশ্রয় খুঁজছেন।
এমতাবস্থায় নতুন করে আসা রোহিঙ্গা বসতির জন্য ৫০ একর পাহাড়ি এলাকার প্রস্তাবনা অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন। কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের পক্ষে অতিরিক্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট খালেদ মাহমুদ জানান, অনুমতি পেলেই সব রোহিঙ্গাকে ওখানে একত্র করে রাখা হবে।

নাইক্ষ্যংছড়ি (বান্দরবান) থেকে সংবাদদাতা জানান, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু ও নাই্যংছড়ি সদর ইউনিয়নের চাক ঢালা, আশারতলী, ফুলতলী পর্যন্ত মধ্যবর্তী কয়েকটি এলাকায় গতকালও এসেছে হাজার হাজার রোহিঙ্গা।
নাই্যংছড়ি উপজেলার জামছড়ি এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, পাহাড়ের চূড়ায় আনুমানিক চার হাজার রোহিঙ্গা প্লাস্টিক দিয়ে ছোট ছোট ঘর তৈরি করে আশ্রয় নিয়েছেন। এভাবে সীমান্তের ফুলতলী, আসারতলী, চাকঢালা ঘুমধুমের জিরোপয়েন্টে পাহাড়ের চূড়ায় ডেরা বেঁধে আছেন ৫০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা। সরেজমিন দেখা যায়, নাই্যংছড়ি সীমান্তের কয়েকটি অরক্ষিত স্থান দিয়ে কাঁধে মালামাল নিয়ে রোহিঙ্গারা প্রবেশ করছেন। তাদের কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, ২ সেপ্টেম্বর রাতে মিয়ানমার থেকে বের হয়ে তারা ৪ সেপ্টেম্বর বেলা ১১টায় বাংলাদেশ সীমান্তে পৌঁছেন।

কেউ কেউ গবাদি পশু নিয়ে এলেও বাংলাদেশের কিছু অসাধু লোক সামান্য কিছু টাকা ও শুকনো খাবার দেয়ার নামে ক্যাম্পে ঢুকে রোহিঙ্গাদের ফুসলিয়ে নামমাত্র মূল্যে সেগুলো কিনে নিয়েছে। প্রতিদিন দূরদূরান্ত থেকে রোহিঙ্গাদের সাহায্য আর খাবার দিতে ছুটে আসছেন অনেকে। বাংলাদেশের জিরো পয়েন্টে আশ্রয় নেয়াদের মধ্যে শিশু ও নারীর সংখ্যা বেশি।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/249967