৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭, শুক্রবার, ৪:০৬

বর্মী আক্রোশ থেকে রেহাই পায়নি ৩ দিনের শিহামণিও

এক করুণ চিত্র। কক্সবাজার সদর হাসপাতাল। এখানে চিকিৎসা নিচ্ছে শত শত রোহিঙ্গা। তারা কোনোমতে জীবন নিয়ে বাংলাদেশে ঢুকতে পেরেছে। এদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। ৫ম তলার অর্থোপেডিক্স ওয়ার্ডে তাদের চিকিৎসা চলছে
। অনেকের হাত-পায়ে গুলি লেগেছে। কারও হাত-পা মুুুচড়ে দেয়া হয়েছে। বর্মীদের অত্যাচার থেকে রেহাই পায়নি ৩ দিন বয়সী শিহামণিও। হাসপাতালের অর্থোপেডিক্স ওয়ার্ডের ফ্লোরে মা ছমিরা খাতুন তার সন্তানের ওপর আক্রমণের বর্ণনা দিলেন। জানালেন- রাখাইনের নাইক্ষ্যংদিয়া এলাকায় তাদের বসতভিটা ছিল। তা পুড়িয়ে দেয় মিয়ানমার সেনা ও উগ্রপন্থি বৌদ্ধরা। ২৫শে আগস্ট রাতেই তাদের বাড়িতে আক্রমণ চালায়। ছোট্ট শিহামণি তার কোলেই ছিল। বর্মীরা তার কোল থেকে শিশুটিকে ছিনিয়ে নেয়। প্রথমে তাকে আঘাত করে। যাওয়ার সময় ছোট্ট শিহামণির পা ও দু’হাত পায়ের নিচে ফেলে মাড়িয়ে যায় এক বর্মী সেনা। ছমিরা খাতুনের পাশেই ফ্লোরে কাতরাচ্ছেন নছুয়া খাতুন। রাখাইনের বড়ছড়া ঘাটের কাছেই ছিল তার বাড়ি। অসুস্থ স্বামী আবু জামিল ও মেয়ে রহিমা খাতুনকে নিয়ে বাড়িতেই ছিলেন। এমন সময় বর্মী বাহিনী তার বাড়িতে আক্রমণ চালায়। মেয়েকে রক্ষা করতে গিয়ে তিনি তাদের আক্রোশের শিকার হন। এ সময় আক্রমণকারীদের হাতে থাকা ধারালো অস্ত্র দিয়ে তার বাম পায়ে আঘাত করে। নছুয়া খাতুন তখনও মেয়েকে ছাড়েননি। পরক্ষণেই তার ডান পায়ে গুলি করে বাড়িঘর ভেঙে দেয় বর্মীরা। বাস্তুচ্যুত ওই নারী স্বামী ও মেয়েকে নিয়ে কোনোমতে টেকনাফের শাপলাপুর ঘাটে আসেন। সেখানে দু’দিন কাটিয়ে এখন তিনি কক্সবাজারে। সদর হাসপাতালে তার দুই পায়ের সার্জারি হয়েছে। সার্জারি ওয়ার্ড থেকে গতরাতে অর্থোপেডিক্স ওয়ার্ডে স্থানান্তর করা হয়েছে। কর্তব্যরত চিকিৎসক জানিয়েছেন, নছুয়া খাতুনের দুই পায়ের অবস্থাই গুরুতর। তার ক্ষতস্থানে মারাত্মক ইনফেকশন হয়েছে। জরুরিভিত্তিতে তার একাধিক অপারেশন প্রয়োজন। চিকিৎসকরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরের। আজ/কালের মধ্যেই তাকে চট্টগ্রাম পাঠানো হবে বলে জানান কর্তব্যরত এক নারী চিকিৎসক। ফাতেমা, পিতা নুরুল হক। আজই এসেছেন কক্সবাজার সদর হাসপাতালে। আইওএম-এর তত্ত্বাবধানে আছেন তিনি। জরুরি বিভাগে ঢুকতেই শোনা গেল তার কান্নার আওয়াজ। তার দুই পায়ে গুলি লেগেছে। জরুরি বিভাগে চিকিৎসা শেষে তাকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে অর্থোপেডিক্স ওয়ার্ডে। চিকিৎসক জানালেন, তাকে ভর্তি করা হয়েছে। ওয়ার্ডে রেখেই তার বাকি চিকিৎসা হবে। তার আঘাতও গুরুতর। ১১ বছরের রবি আলম। ভাঙা হাত নিয়ে কাতরাচ্ছে জরুরি বিভাগে। মাথায় আঘাত, রক্ত ঝরছে। মা হানু বিবি, ছোট বোন উম্মে কুলসুম (৭-৮ বছর) অসহায় দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। চিকিৎসক, নার্স সবাই ব্যস্ত। একের পর এক রোগী আসছে। রাখাইনের রশিধং মগপাড়া থেকে এসেছে রবি আলম ও তার পরিবার। বাবা নুর করিম মিয়ানমারের কারাগারে বন্দি। লেদা সীমান্ত দিয়ে পার হয়েছেন তারা। নৌকায় করে আসছিলেন। ৪৫ জন রোহিঙ্গা পার হয়েছে ঐ নৌকায়। বর্মী বাহিনী নৌকাতেও তাদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। সেখানে ৫ জনের মৃত্যু হয়। রবি আলমের হাতে আঘাত এবং মাথা ফাটলেও সে জীবন নিয়ে পালিয়ে আসতে পেরেছে। হানু বিবি আর উম্মে কুলসুমও রেহাই পায়নি বর্মীদের নির্যাতন থেকে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে হানু বিবি তার আঞ্চলিক ভাষায় বলছিলেন- জীবন নিয়ে কোনোভাবে বাংলাদেশে ঢুকতে পেরেছি। এখন যা হওয়ার হবে। আমাদের তো আর ওখানে থাকার মতো অবস্থা নাই। বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে। ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট কক্সবাজার সদর হাসপাতালে রোগী ধারণের ঠাঁই নেই। সব ফ্লোরই রোগীতে ঠাঁসা। সঙ্গে স্বজনরাও রয়েছেন। তবে রোহিঙ্গা রোগীদের চিনতে কোনো অসুবিধা হয়নি। যে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই তাদের দেখিয়ে দেয়। বেশভূষাতেও তাদের পরিচয় স্পষ্ট। কথা বলতে গেলে অনেকেই এগিয়ে আসেন। উখিয়া কোর্টবাজারের যুবক মোহাম্মদ ফরহাদ। বেশ দরদি এ যুবক অনেক রোহিঙ্গাকেই সাহায্য সহায়তা করছেন। কথা হয় তার সঙ্গে। নিয়ে যান হাসপাতালের রোহিঙ্গা ভর্তি ওয়ার্ডগুলোতে। ফরহাদ জানান, এরই মধ্যে অনেক রোহিঙ্গাকে বিশেষত নারী ও শিশুকে চিকিৎসা কাজে সহায়তা করেছেন তিনি। অনেকে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে কক্সবাজারের পাহাড়তলী, সমিতিপাড়া, চরপাড়া, নূন্যারছড়া, উখিয়ার কুতুপালংসহ বিভিন্ন এলাকায় তাদের স্বজনদের কাছে ফিরে গেছে। অনেককে উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। কেউ কেউ রোহিঙ্গা স্বজনদের মাধ্যমে বেসরকারি হাসপাতালেও চিকিৎসা নিচ্ছেন বলে জানা গেছে।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=81953