৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭, শুক্রবার, ৩:৫৯

আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস আজ

সাক্ষরতা বাড়াতে সরকারি উদ্যোগ ছিল না ৩ বছর

প্রায় তিন বছর সাক্ষরতা বাড়ানোর কোনো প্রকল্প বা উদ্যোগই ছিল না সরকারের। তা সত্ত্বেও সরকারের দাবি, ওই তিন বছরে সাক্ষরতার হার বেড়েছে প্রায় ১১ শতাংশ। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর অধীনে সাক্ষরতা বাড়ানোর সর্বশেষ প্রকল্পটি শেষ হয় ২০১৪ সালের জুন মাসে। এরপর চলতি বছরের মাঝামাঝি আরেকটি প্রকল্প শুরু হয়েছে মাঠপর্যায়ে। সাক্ষরতা নিয়ে কাজ করেন এমন বিশিষ্টজনরা বলছেন, মাঠপর্যায়ে সরকারের কোনো প্রকল্প না থাকা সত্ত্বেও সাক্ষরতার হার ব্যাপক হারে কিভাবে বাড়ল তা তাঁদের বোধগম্য নয়। তাঁরা বলেন, সাক্ষরতা বাড়াতে প্রয়োজন একটি বড় সামাজিক আন্দোলন। কিন্তু সেটা নেই।
এদিকে দেশে সাক্ষরতার হার নিয়েও বিভ্রান্তি কাটছে না। কয়েক বছর ধরেই সরকারি হিসাব এক রকম আর বেসরকারি হিসাব অন্য রকম। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০১৬ সালের মে মাসের তথ্যানুযায়ী দেশে সাক্ষরতার হার ৭২.৩ শতাংশ। অথচ ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত বেসরকারি হিসাব অনুযায়ী দেশে সাক্ষরতার হার ৫১.৩ শতাংশ।
সরকারি-বেসরকারি হিসাবের মধ্যে ব্যবধান প্রায় ২১ শতাংশ।

সাক্ষরতার সংজ্ঞা নিয়েও রয়েছে বিভ্রান্তি। কেউ কেউ বলেন, কোনো ব্যক্তি নাম লিখতে পারলেই তিনি সাক্ষর। সরকারেরও কারো কারো মধ্যে এমন ধারণা প্রচলিত আছে। আন্তর্জাতিক সংজ্ঞানুযায়ী, সাক্ষরতা হচ্ছে পড়া, অনুধাবন করা, মৌখিকভাবে ও লেখার বিভিন্ন পদ্ধতিতে ব্যাখ্যা করা, যোগাযোগ স্থাপন করা এবং গণনা করার দক্ষতা। এটি একটি ধারাবাহিক শিখন-প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি নিজস্ব বলয় এবং বৃহত্তর সমাজের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের ক্ষমতা ও জ্ঞানের ভিত্তি তৈরি করতে পারে। অর্থাৎ সাক্ষরতা বলতে লিখতে, পড়তে, গণনা করতে ও যোগাযোগ স্থাপন করার সক্ষমতাকে বোঝানো হয়। সাক্ষরতাসম্পন্ন একজন ব্যক্তি অন্তত তৃতীয় শ্রেণি পাস করা শিক্ষার্থীর সমমানের হতে হবে বলে মানদণ্ড নির্ধারণ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিবিএস কোন পদ্ধতির ওপর ভিত্তি করে জরিপ করেছে, সেটা আমার জানা নেই। তবে আমরা মাঠপর্যায়ে গিয়ে জরিপটি করেছি। আমার মনে হয়, মূলত সংজ্ঞাগত কারণেই হার নিয়ে এই বিভ্রান্তি। আমরা জরিপ করার সময় লিখতে, পড়তে, বলতে ও বুঝতে পারে কি না, সেটা দেখেছি। একই সঙ্গে প্রায়োগিক দক্ষতাও দেখা হয়েছে। ’ তিনি আরো বলেন, ‘সরকারি হিসাব সঠিক ধরলেও দেখা যায় এখন অনেক মানুষ নিরক্ষর। আসলে সাক্ষরতার হার বাড়াতে একটি সামাজিক আন্দোলন দরকার। ’
জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘শুধু স্বাক্ষর করতে পারলেই সে সাক্ষর জ্ঞানসম্পন্ন হবে, তা নয়। আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় যেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষায় সেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। গতানুগতিক প্রকল্প দিয়ে সাক্ষরতার হার সেভাবে বাড়ানো যাবে না। এ জন্য নাগরিক আন্দোলন এবং সরকারের কমিটমেন্ট দরকার। ’
সাক্ষরতার হার ও সংজ্ঞা নিয়ে বিভ্রান্তির মধ্যেই আজ শুক্রবার পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস ২০১৭। এবারের প্রতিপাদ্য ‘সাক্ষরতা অর্জন করি, ডিজিটাল বিশ্ব গড়ি’। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর মাধ্যমে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা, সংগঠন, এনজিও, শিক্ষক এবং শিক্ষাক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে দিবসটি পালন করার উদ্যোগ নিয়েছে মন্ত্রণালয়। আজ সকাল সাড়ে ১০টায় রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালায় দিবসটির কর্মসূচি উদ্বোধন করবেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান।

আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস উপলক্ষে গতকাল বৃহস্পতিবার আলাদা বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাষ্ট্রপতি বলেছেন, ‘বর্তমান সরকার শিক্ষার প্রসার ও নিরক্ষরমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ’ প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘২০২১ সালের মধ্যে দেশ নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্ত হবে। ’
জানা যায়, প্রকৃত অর্থে সাক্ষরতার হার নিয়ে বিবিএসের সর্বশেষ জরিপ প্রকাশিত হয় ২০১১ সালে। ওই জরিপের তথ্য অনুযায়ী তখন সাক্ষরতার হার ছিল ৫৮.০৮ শতাংশ। এরপর বিবিএসের ‘মনিটরিং দ্য সিচুয়েশন অব ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিকস অব বাংলাদেশ’ বা এমএসভিএসবি প্রকল্পের অধীনে প্রতিবছর দেশের জনসংখ্যা পরিস্থিতি হিসাব করা হয়। ২০১৬ সালের শুরুতে ওই কাজের অতিরিক্ত হিসেবে সাক্ষরতা পরিস্থিতি দেখা হয়। তখন বাড়ি বাড়ি গিয়ে লোকজনকে প্রশ্ন করা হয়েছিল তারা চিঠি লিখতে পারে কি না। ওই প্রশ্নের ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’ জবাবের ওপর ভিত্তি করে সাক্ষর মানুষ হিসাব করা হয়েছে। কোনো পরীক্ষা নেওয়া হয়নি। সেই হিসাবেই সরকার এখন বলছে, দেশে সাক্ষরতার হার ৭২.৩ শতাংশ। একইভাবে সাক্ষরতার হার ২০১৫ সালে ৬৪.০৬, ২০১৪ সালে ৬১.১৪, ২০১৩ সালে ৬১.০৪ এবং ২০১২ সালে ৬০.৭ শতাংশ ছিল বলে দাবি করা হয়েছিল।
আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস উপলক্ষে গত বুধবার আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী বলেন, বিবিএসের ২০১৬ সালের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী দেশে সাক্ষরতার হার ৭২.৩ শতাংশ। বর্তমান সরকারের নানামুখী কর্মসূচির কারণে আগের তুলনায় সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে এখনো প্রায় ২৭.৭ শতাংশ জনগোষ্ঠী নিরক্ষর। এই নিরক্ষর জনগোষ্ঠীকে সাক্ষর করতে না পারলে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব নয়।

তবে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘সাক্ষরতা মানে শুধু লিখতে, পড়তে পারলেই হবে না। আমরা সাক্ষরতা বলতে বুঝি যিনি লিখতে পারেন, পড়তে পারেন, শব্দ গঠন করতে পারেন, খবরের কাগজ পড়তে পারেন। তবে বিবিএস কিসের ভিত্তিতে এই জরিপ করেছে, কাদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছে, তা আমাদের জানা নেই। ’
দেশব্যাপী বেসরকারি সংস্থা গণসাক্ষরতা অভিযান (ক্যাম্পে) পরিচালিত এক সমীক্ষায় সাক্ষরতার হার নিরূপণ করা হয় ৫১.৩ শতাংশ। গত বছরের ২ ডিসেম্বর এই তথ্য আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়। ক্যাম্পের তথ্যানুযায়ী, মোট জনসংখ্যার হিসাবে পুরুষদের সাক্ষরতার হার ৫০.৫ শতাংশ, নারীর ক্ষেত্রে ৫৩.২ শতাংশ এবং অন্যান্য জেন্ডারের ক্ষেত্রে সাক্ষরতার হার ৪০.১ শতাংশ। ১৫ বছরের বেশি বয়সী মানুষের মধ্যে সাক্ষরতার হার প্রায় ৪৭.২ শতাংশ। ১৫ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে এই হার ৭৪.৮ শতাংশ। আর ৬০ বছরের বেশি বয়সী পুরুষের সাক্ষরতার হার ২০.৭ শতাংশ।
বেসরকারি হিসাবে সাক্ষরতার হার সবচেয়ে কম ময়মনসিংহে, বেশি বরিশালে : ক্যাম্পের সমীক্ষা থেকে জানা যায়, বিভাগভিত্তিক সবচেয়ে বেশি সাক্ষর মানুষ বরিশালে। সেখানে সাক্ষরতার হার ৫৭.৩ শতাংশ। সাক্ষরতার হার সবচেয়ে কম ময়মনসিংহে, ৪২.১ শতাংশ। এই হার ঢাকায় ৪৮.৩, চট্টগ্রামে ৪৫.৪, রাজশাহীতে ৫২.৯, খুলনায় ৫৩.৯ এবং রংপুরে ৪৭.৩ শতাংশ। এ ছাড়া সিটি করপোরেশন এলাকায় সাক্ষরতার হার ৬৩.৩ শতাংশ। আয়ের বিবেচনায় জনসংখ্যাকে পাঁচ ভাগ করে সাক্ষরতার হার বের করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সাক্ষরতার হার অতিদরিদ্রদের মধ্যে ৩৩.৬, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৪৪.১, মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৫২.৩, ধনী জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৬০.১ এবং অতিধনী জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৬৯.১ শতাংশ। এ ছাড়া বাঙালিদের মধ্যে সাক্ষরতার হার ৫১.৭, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে ৩৮.২ এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যে সাক্ষরতার হার ৫১.৩ শতাংশ।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2017/09/08/540227