৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭, শুক্রবার, ৩:৫৪

শিক্ষা বিভাগে বিশেষ সুবিধার পদ

ঘুরেফিরে ‘মুখচেনারাই’

সরকারি কলেজের জন্য নিয়োগ পাওয়া ‘মুখচেনা’ কিছু শিক্ষক ঢাকা ও বিভিন্ন বিভাগীয় শহরের অফিসে প্রশাসনিক পদে বছরের পর বছর আসীন আছেন। আর প্রশাসনিক পদ যারা নিতে পারেননি তারা ঢাকার বিভিন্ন কলেজে কর্মরত আছেন। এমন কর্মকর্তাও আছেন যাদেরকে চাকরিজীবনে খুব কমই ঢাকার বাইরে যেতে হয়েছে। তাদের কারণে প্রকৃত মেধাবীরা গুরুত্বপূর্ণ পদে পোস্টিং পাচ্ছেন না। অথচ গোটা সময় মফস্বলে কাটিয়ে চাকরিজীবন শেষ করার মতো কর্মকর্তাও আছেন অনেক। শিক্ষা ক্যাডারে এ ধরনের পোস্টিং ‘বিশেষ সুযোগ’ হিসেবে বিবেচিত বলে খোদ শিক্ষামন্ত্রীর এক অনানুষ্ঠানিক নোটেই উঠে এসেছে।

অভিযোগ আছে, দীর্ঘদিন প্রশাসনিক পদে চাকরির সুবাদে এসব কর্মকর্তার অনেকেই গড়ে তুলেছেন দুর্নীতির সিন্ডিকেট। প্রভাবশালী সেবাপ্রার্থীদের কাছে ঘুষ দাবি করে বা প্রভাবশালী কারও টার্গেটে পড়ে মাঝে মধ্যে দু-চারজন বিপাকেও পড়েন। তবে বেশিরভাগই থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। এ নিয়ে মাঝে মধ্যে শোরগোল হয়। কিছু ক্ষেত্রে অ্যাকশন বলতে শুধু ‘বদলি’ করা হয়। এদিকে অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার পরও একই পদে রাখা ও পদোন্নতি দেয়ার ঘটনা আছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে নির্দেশনার পরও তদন্ত না হওয়ার রেকর্ড আছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. সোহরাব হোসাইন যুগান্তরকে বলেন, ‘কোনো শিক্ষকের বিরুদ্ধে যদি অভিযোগ না থাকে তাহলে তিনি এক কর্মস্থলে বেশিদিন থাকলে তো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তবে প্রশাসনিক পদে যারা বেশিদিন আছেন তাদের বিষয়টি মাথায় রেখে আমরা একটি নীতিমালা করেছি। বর্তমানে যারা বিভিন্ন পদে আছেন, তাদের সবাইকে একসঙ্গে বের করে দিলে অফিস চলবে না। তাই নীতিমালা ধীরে ধীরে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কর্মকর্তাদের একটি প্যানেল করা হয়েছে।’

মুখচেনা এসব কর্মকর্তার বিষয়ে ৬ আগস্ট সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায়ও আলোচনা হয়। ওই সভায় এ নিয়ে শিক্ষা সচিবকে বিভিন্ন প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে। কিছু ব্যক্তি একই পদে বছরের পর বছর কীভাবে থাকেন সে ব্যাপারে কমিটির সদস্যরা প্রশ্ন তোলেন। পাশাপাশি কমিটি সুপারিশ করেছে, বিভিন্ন দফতর, অধিদফতর ও সংস্থায় শিক্ষকদের পদায়ন করার পর তিন বছরের বেশি রাখা যাবে না।

এ প্রসঙ্গে কমিটির সভাপতি ডা. আফছারুল আমিন যুগান্তরকে বলেন, ‘শিক্ষকদের কাজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। কিন্তু তা বাদ দিয়ে কিছু কর্মকর্তা অন্য কাজে জড়িয়ে গেছেন। বছরের পর বছর বিভিন্ন বোর্ড, প্রকল্প, দফতরে ডেপুটেশনে রাখা হচ্ছে। নীতিমালার একটি ধারার ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে একই কর্মকর্তাকে একই প্রতিষ্ঠানের অন্য পদে ৩ বছর পর বদলি করে রাখার ঘটনাও আছে। আমরা মন্ত্রণালয়কে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে সুপারিশ করেছি।’

জানা গেছে, একই বিষয়ে এ কমিটি ২০১৪ সালেও আরেক দফা সুপারিশ করেছিল। কিন্তু কোনো পদক্ষেপ নেয়নি মন্ত্রণালয়।

দীর্ঘদিন বিভিন্ন বোর্ডে থাকা ব্যক্তিদের একজন সিলেটের চেয়ারম্যান একেএম গোলাম কিবরিয়া তাপাদার। জানা গেছে, ২০১০ সালের অক্টোবরে তিনি এ বোর্ডে কলেজ পরিদর্শক পদে যোগ দেন। ২০১৪ সালের এপ্রিলে একই বোর্ডের সচিব হন। এর ৩-৪ দিনের মাথায় তিনি সচিবের পাশাপাশি বোর্ডের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানও হন। বিগত তিন বছরে মাস খানেকের ব্যতিক্রম ছাড়া এই দুই শীর্ষ পদই দখলে রাখেন তিনি। গত বছরের ২ অক্টোবর অধ্যাপক হিসেবে তিনি পদোন্নতি পান। তখন তাকে কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে পাঠানো হয়। কিন্তু সেখানে যোগদানের পরদিনই তিনি ফিরে যান সিলেট বোর্ডের সচিব পদে।

পাশাপাশি ভিন্ন এক আদেশে একইদিন তাকে চেয়ারম্যানের বাড়তি দায়িত্বও দেয়া হয়। ওই বোর্ডের কলেজ পরিদর্শক মোস্তফা কামাল আহমদ, স্কুল পরিদর্শক কবির আহমদও দীর্ঘদিন কর্মরত আছেন।

এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক তাপাদার সম্প্রতি যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি ভালোভাবে বোর্ড চালাচ্ছি। এ কারণে সচিব পদে দেয়ার পরও চেয়ারম্যান পদে কাউকে দেয়া হয়নি। চেয়ারম্যানের পদটি অধ্যাপকের। আমি সহযোগী অধ্যাপক ছিলাম বলে আড়াই বছর ধরে ওই পদে সরাসরি নিয়োগ পাইনি।’

অভিযোগ আছে, সুবিধাজনক স্থানে পদায়নে হালের সংস্করণ হচ্ছে ‘জুনিয়র’দের আধিক্য। এদের বেশিরভাগই শিক্ষামন্ত্রীর সাবেক এপিএস মন্মথরঞ্জন বাড়ৈর অনুসারী। তারা বিসিএসের নামে বিভিন্ন ‘ফোরাম’ গঠন করেছেন। বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ডের যেসব পদে আগে সিনিয়র অধ্যাপক বা অধ্যাপকরা পদায়ন পেতেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় রহস্যজনক কারণে সেসব পদে ফোরামের জুনিয়র কর্মকর্তাদের বসিয়ে রেখেছে। এসব কর্মকর্তার অনেকেই দুর্নীতিগ্রস্ত বলে অভিযোগ আছে।

দীর্ঘদিন একই পদে থাকা শিক্ষকদের একজন ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সচিব শাহেদুল খবীর চৌধুরী। তিনি ২০০৯ সালের মার্চ থেকে এখন পর্যন্ত এ বোর্ডেই আছেন। ঢাকা বোর্ডে সবচেয়ে দীর্ঘদিন প্রায় দেড় দশক ধরে কর্মরত আছেন উপসচিব ফজলে এলাহী। উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মাসুদা বেগম ২০০৯ সাল থেকে এখনও কর্মরত আছেন। এই কর্মকর্তা বিভিন্ন স্থানে নিজেকে শিক্ষামন্ত্রীর কাছের লোক পরিচয় দিয়ে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেন বলে অভিযোগ আছে।

নানা অভিযোগের ওপর ভিত্তি করে বিগত সংসদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি তদন্ত চালায় পরিদর্শন নিরীক্ষা অফিদফতরে (ডিআইএ)। এর পর ১৭ কর্মকর্তাকে চিহ্নিত করে বদলির সুপারিশ করা হয়। কিন্তু তাদের অনেকেই এখনও বহাল আছেন। যে ক’জনকে বদলি করা হয়েছে, তারা তুলনামূলক প্রাইজ পোস্টিং পেয়েছেন। তাদের একজন শফিকুল ইসলাম সিদ্দিকি বর্তমানে মাউশিতে আছেন।

এভাবে ২০০০ সালের পর ঘুরেফিরে ঢাকায় ‘সুবিধাজনক’ পদে থাকা কর্মকর্তারা হলেন : মাদ্রাসা বোর্ডের রেজিস্ট্রার মো. মুজিবর রহমান, পরিদর্শক আবুল বাশার, কারিগরি বোর্ডের বিজয় কুমার ঘোষ, মাউশির উপ-পরিচালক ফারহানা হক, আইন কর্মকর্তা আবুল কাশেম, সহকারী পরিচালক (শারীরিক শিক্ষা) মো. সাইফুল ইসলাম, হেলালউদ্দিন, আবদুস সালাম প্রমুখ। মাউশির পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের প্রায় সব কর্মকর্তা। পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতরে আছেন প্রায় এক ডজন কর্মকর্তা। অধ্যাপক আবদুল মজিদসহ আরও ১০-১২ জন আছেন এনসিটিবিতে। এভাবে চট্টগ্রাম, বরিশাল, কুমিল্লা, দিনাজপুর, যশোর, মাদ্রাসা ও কারিগরি বোর্ড, এনসিটিবি, নায়েম, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর, ব্যানবেইস, অবসর বোর্ড, কল্যাণ ট্রাস্টসহ বিভিন্ন দফতর এবং ঢাকার কলেজগুলোতেও নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তি যুগ যুগ ধরে চাকরি করছেন।

এসব বিষয়ে নানা অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে খোদ শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ গত বছরের ২ অক্টোবর মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের কাছে নোট পাঠান। এর এক স্থানে তিনি লেখেন, ‘আমার কাছে সারা দিন (সকাল ৬টা-রাত ১২টা) যত মানুষ আসেন, যত চাপ দেয়া হয়, তা মোট কাজের ৮০ শতাংশ ঢাকায় বদলি, সুবিধাজনক পদায়ন, ভিসি-চেয়ারম্যান প্রভৃতি বড় পদসহ কোনো কর্মকর্তার পদে পদায়ন করার। বিসিএস শিক্ষকদের দুইটি বড় লক্ষ্যের একটি ঢাকায় থাকা বা আসা, অপরটি কর্মকর্তা হওয়া। এটা তাদের মধ্যে বিশেষ সুযোগ হিসেবে বিবেচিত।’

বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির সভাপতি অধ্যাপক আইকে সেলিমউল্লাহ খোন্দকার যুগান্তরকে বলেন, ‘কেউ অনির্দিষ্টকালের জন্য অফিসে থাকবে, তা আমরা চাই না। আমরা চাই, পাঠদানের অভিজ্ঞতা প্রশাসনিক কাজে লাগানোর সুযোগ। অন্য ক্যাডারে যাদের মাঠ প্রশাসনের অভিজ্ঞতা থাকে না, তাদের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয় না। শিক্ষার ক্ষেত্রেও এটা করা উচিত। সে কারণে নীতিমালা অনুযায়ী বদলির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। তাহলে শিক্ষা ক্যাডারে ক্ষোভ-অসন্তোষ থাকবে না। তাই যারা ১০-১৫ বছর ঢাকার বাইরে আছে, তাদের রোটেশনে ভালো পদে দিতে হবে।’

 

https://www.jugantor.com/last-page/2017/09/08/153561