৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৮:৫৬

মিয়ানমার সীমান্তে স্থলমাইন

রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ায় বাংলাদেশের প্রশংসা গুতেরেসের * জাতিসংঘে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব উঠতে পারে * সুচির দাবি- রোহিঙ্গাদের নিয়ে ভুয়া খবর ছড়ানো হচ্ছে * গুলিবিদ্ধসহ ১৩ রোহিঙ্গার মরদেহ উদ্ধার * বাংলাদেশে এসেছেন দুই লাখের বেশি রোহিঙ্গা * রাখাইনে ব্যাপক সহিংসতা ও চলমান সেনা অভিযানের প্রতিবাদ

মিয়ানমারের তুমব্রু সীমান্তে স্থলমাইন বিস্ফোরণে পায়ের নিচের অংশ উড়ে যাওয়া সাবেকুন্নাহারকে উখিয়ার কুতুপালং এমএসএফ হাসপাতালে নেয়া হচ্ছে -যুগান্তর
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে হত্যায় ফের ঘৃণ্য পন্থা বেছে নিয়েছে মিয়ানমার। জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা যাতে নিজ দেশে আর ফিরতে না পারেন সেজন্য সীমান্তে স্থলমাইন বসিয়েছে মিয়ানমার। স্থলমাইন বিস্ফোরণে ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন।

মিয়ানমারে ক্রমবর্ধমান নিপীড়নের মুখে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশমুখী স্রোত অব্যাহত আছে। ২৪ আগস্ট থেকে বুধবার পর্যন্ত দুই লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন। নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ সীমান্ত পার হয়ে আসা শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়ার চেষ্টা করছে। বুধবার পাহাড়ি এলাকায় প্রবল বর্ষণে শরণার্থীদের দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। সরকার রোহিঙ্গাদের দুর্ভোগ লাঘবে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছে। জনবহুল বাংলাদেশের এ মহানুভবতার প্রশংসা করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সরকারের আচরণের নিন্দা জানিয়ে তিনি সংখ্যালঘু এ জনগোষ্ঠীকে নাগরিক অধিকার দেয়ার জন্য মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এদিকে মিয়ানমার বিষয়ে আলোচনার জন্য তিনি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের কাছে চিঠি লিখেছেন। ধারণা করা হচ্ছে, নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব উত্থাপন করা হতে পারে। এ অবস্থায় মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ বুধবার জানিয়েছে যে, সম্ভাব্য নিন্দা প্রস্তাব ঠেকাতে তারা চীন ও রাশিয়ার সহায়তা পাবে বলে আশা করছে। আর মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সুচি বলেছেন, রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ ‘আইসবার্গের মতো ভুল তথ্য।’ তার দাবি, সংঘাতময় রাখাইনে সবাই সুরক্ষিত। রোহিঙ্গাদের নিয়ে ভুয়া খবর ছড়ানো হচ্ছে।

মিয়ানমার থেকে বিপজ্জনক নৌপথে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আসা অব্যাহত আছে। নৌকা বোঝাই করে পালিয়ে আসার সময় সাগরে ফের নৌকা ডুবে গেছে। এতে আরও ৮ রোহিঙ্গা নারী ও শিশু মারা গেছেন। এছাড়া কক্সবাজারের উখিয়ায় গুলিবিদ্ধ ৫ রোহিঙ্গার মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। নিয়ে গত কয়েক দিনে নদীপথে বাংলাদেশে আসার সময় অন্তত ৭০ রোহিঙ্গার মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরাতে জাতিসংঘের কার্যকর পদক্ষেপ চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়া রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক সহিংসতা ও চলমান সেনা অভিযানের প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ। বুধবার দেশটির ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত অং মিন্টকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে ‘প্রটেস্ট নোট’ ধরিয়ে দেয়া হয়। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলার জন্য তুরস্কের ফার্স্টলেডি এমিন এরদোগান ঢাকায় আসছেন। সঙ্গে আছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাপসগুল। তারা আজ কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলবেন।
বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে মিয়ানমারের স্থলমাইন : বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, বাংলাদেশ সীমান্তের খুব কাছে স্থলবোমা বা ল্যান্ডমাইন পেতে রেখেছে মিয়ানমার। ৩ দিন ধরে এমনটা করা হয়েছে। পরিস্থিতি সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ঢাকায় সরকারি দুটি সূত্র একথা বলেছেন। তবে বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ায় তারা তাদের পরিচয় প্রকাশ করতে রাজি হননি। তারা বলেছেন, এর উদ্দেশ্য হল- পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা যাতে আর মিয়ানমারে ফিরে যেতে না পারেন। বুধবার আনুষ্ঠানিকভাবে এর প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ বর্ডার গার্ডের কর্মকর্তা মনজুরুল হাসান খান বলেন, সোমবার খবর ছড়িয়ে পড়ে যে মিয়ানমারের বিভিন্ন বাহিনী সীমান্তে স্থলবোমা বা ল্যান্ডমাইন পুঁতে রাখছে। এরপর মঙ্গলবার তারা মিয়ানমার অংশে দুটি বিকট বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পেয়েছেন। মঙ্গলবার এ সময় সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে আসার চেষ্টা করছিল একটি বালক। ওই বিস্ফোরণে তার বাম পা উড়ে গেছে। এরপর তাকে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়েছে চিকিৎসার জন্য। আরেকটি বালক অল্প আহত হয়েছে। বিস্ফোরণে এক নারীও আহত হয়েছেন। মনজুরুল হাসান খান বলেন, এটি হয়তো মাইন বিস্ফোরণ থেকে সৃষ্টি হয়েছে। সীমান্তে নোম্যানস ল্যান্ডে, যেখানে অনেক রোহিঙ্গা আটকা পড়েছেন। সেখানে একজন রোহিঙ্গা হাঁটছিলেন। তিনি এ সময় বিস্ফোরণ স্থলের ছবি ধারণ করেছিলেন। সেটা দৃশ্যত একটি মাইন হতে পারে। দেখা গেছে প্রায় ১০ সেন্টিমিটার ব্যাসের একটি ধাতব ডিস্ক মাটির ভেতর আংশিক পুঁতে রাখা হয়েছে। ওই রোহিঙ্গা বলেছেন, তিনি আরও দুটি একই রকম ডিভাইস মাটিতে পোঁতা দেখতে পেয়েছেন। তবে সীমান্তে বিস্ফোরণের বিষয়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনী কোনো মন্তব্য করেনি। স্টেট কাউন্সেল অং সান সুচির মুখপাত্র জাও হ তাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। সোমবার তিনি বলেছিলেন, কোথায় বিস্ফোরণ হয়েছে, কারা সেখানে গিয়েছিল এবং কারা সেখানে ল্যান্ডমাইন পুঁতে রেখেছে তা নিশ্চিত হতে হবে। তিনি এ সময় আরও বলেন, কে নিশ্চিত করে বলতে পারে ওইসব ল্যান্ডমাইন সন্ত্রাসীরা (রোহিঙ্গা) পোঁতেনি।

বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র সচিব মোস্তফা কামাল উদ্দিনও এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি। ঢাকাভিত্তিক সূত্রগুলো যে পিলারের মাঝে ল্যান্ডমাইন পেতে রাখার কথা বলেছেন, সেইসব পিলার মিয়ানমার ও বাংলাদেশ সীমানাকে আলাদা করেছে। এছাড়া বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে রয়েছে কাঁটাতারের বেড়া। এ দুটি দেশের মধ্যে রয়েছে ২১৭ কিলোমিটার সীমান্ত, যার বেশিরভাগই নি-িদ্র নয়। বাংলাদেশের ওই সূত্র দাবি করেছে, তারা বাংলাদেশের মাটিতে কিছুই করছে না। তবে আগে কখনও সীমান্ত এলাকায় স্থলমাইন বসাতে দেখা যায়নি।
রয়টার্স জানায়, কয়েক বছর আগেও মিয়ানমার ছিল সেনা শাসনের অধীনে। বিশ্বে যেসব দেশের হাতে সবচেয়ে বেশি স্থলবোমা বা ল্যান্ডমাইন আছে তার অন্যতম মিয়ানমার। ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘের ল্যান্ডমাইন নিষিদ্ধ বিষয়ক চুক্তিতে যে কয়েকটি দেশ স্বাক্ষর করেনি তার অন্যতম মিয়ানমার।
বাংলাদেশের প্রশংসা জাতিসংঘ মহাসচিবের : মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে সেনা অভিযানের মুখে গণহত্যা থেকে রেহাই পেতে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়ায় বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস।
এছাড়া রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নিধনের ঝুঁকির কথা উল্লেখ করে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষকে হুশিয়ার করেছেন তিনি। এজন্য অবিলম্বে রাখাইনে সহিংসতা বন্ধ করতেও বলেছেন। মঙ্গলবার নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দফতরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এসব কথা বলেন জাতিসংঘ মহাসচিব।
তিনি বলেন, অসহ্য যন্ত্রণা ও হতাশার শিকার প্রায় সোয়া লাখ রোহিঙ্গা (তবে সর্বশেষ তথ্য প্রায় দুই লাখ) বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন এবং বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। শরণার্থীদের প্রবেশের সুযোগ দেয়ার জন্য বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান জাতিসংঘ মহাসচিব। তিনি এ সিদ্ধান্তকে ‘উৎসাহব্যঞ্জক’ বলে অভিহিত করেন। বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের জন্য আগামী ৩ মাসে এক লাখ ৮০ হাজার ডলার সাহায্যের আবেদন জানিয়েছে জাতিসংঘ সংস্থাগুলো।
গুতেরেস রাখাইন রোহিঙ্গাদের বহু বছরের পুরনো বৈষম্য, হতাশা এবং চরম দারিদ্র্যের কথা উল্লেখ করে তাদের জাতিগত নিধনের শিকারে পরিণত হওয়ার আশঙ্কার বিষয়ে সতর্ক করেন। তিনি বলেন, সংকটের আসল কারণ খুঁজে বের করে সমাধানের উদ্যোগ নেয়ার ক্ষেত্রে আর কালক্ষেপণের সুযোগ নেই। তাই মিয়ানমার কর্তৃপক্ষকে এখনই রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব প্রদান অথবা এমন বৈধতা দিতে হবে, যাতে তারা স্বাধীনভাবে বাঁচতে ও চলাফেরা করতে পারে, কাজ খুঁজে পায় এবং শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের কোনো নাগরিক অধিকারই দেয়নি। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা সংকটের সামগ্রিক সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও উদ্যোগী হয়ে সমন্বিত পদক্ষেপ প্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের কাছে চিঠি পাঠানোর কথা উল্লেখ করেন তিনি। এতে চলমান সহিংসতার অবসান এবং সংকটের মূল কারণগুলো সমাধানের জন্য নানা পদক্ষেপ গ্রহণের প্রস্তাব করা হয়েছে। রোহিঙ্গা সংকটকে তিনি ‘আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতার অনস্বীকার্য উপাদান’ বলে মন্তব্য করেন।
রাখাইনে প্রবেশাধিকার চায় ইইউ : অবরুদ্ধ রাখাইনে পূর্ণ মানবিক প্রবেশাধিকার চেয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নিপীড়ন বন্ধেরও আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি। মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে ইইউ কমিশনার ক্রিস্টোস স্টাইলিয়ানিডস বলেন, অনেক রোহিঙ্গা চরম দুর্ভোগের শিকার হয়ে দেশ ছাড়ছেন। তিনি বলেন, শরণার্থীদের নিরাপত্তায় বাংলাদেশ সরকার যে পদক্ষেপ নিয়েছে তাতে ইইউ সমর্থন দিয়ে যাবে এবং সাহায্য করবে।
মিয়ানমারের ভরসা চীন ও রাশিয়া : রয়টার্স জানায়, মিয়ানমার সরকার জানিয়েছে যে রোহিঙ্গা নিপীড়নের প্রতিবাদে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমার সরকারের নিন্দা জানিয়ে কোনো প্রস্তাব আনা হলে তা ঠেকাতে চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। মিয়ামারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা থং তুন রাজধানী নেপিদোতে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, সংকট নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের কোনো প্রস্তাব নিলে তারা নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য চীন ও রাশিয়ার ভেটো ক্ষমতার ওপর নির্ভর করবে।

তিনি বলেন, ‘কিছু বন্ধুপ্রতিম দেশের সঙ্গে আমরা আলোচনা করছি যেন বিষয়টি নিরাপত্তা পরিষদে তোলা না হয়। চীন আমাদের বন্ধু। রাশিয়ার সঙ্গেও আমাদের একই রকম বন্ধুত্ব।
রোহিঙ্গা নিপীড়ন নিয়ে আইসবার্গের সমান মিথ্যাচার চলছে -সুচি : রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে চলমান সহিংসতা নিয়ে অবশেষ মুখ খুলেছেন মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সুচি। ২৫ আগস্ট থেকে নতুন করে রোহিঙ্গা মুসলিম নিধন শুরু হলেও গত ১২ দিন মুখে কুলুপ এঁটে ছিলেন তিনি। নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছিলেন। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী নেতার এ মৌনব্রত পালন নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক সমালোচনা হয়। অবশেষে সুচি বলেন, রাখাইন রাজ্যে সবাই সুরক্ষিত আছেন। কিন্তু এ সংঘর্ষ নিয়ে ‘বৃহৎ আইসবার্গ সমান ভুল তথ্য’ চাউর হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, এতে ‘সন্ত্রাসী’ রোহিঙ্গাদের স্বার্থ হাসিল হচ্ছে। মিয়ানমারের কার্যত সরকারপ্রধান হিসেবে খ্যাত সুচির কার্যালয় জানায়, মঙ্গলবার তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোগানের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার সময় এমন মন্তব্য করেন সুচি।
এরদোগানের সঙ্গে কথোপকথনের বিষয় নিয়ে বুধবার বিবৃতি প্রকাশ করেছে সুচির কার্যালয়। স্থানীয় গণমাধ্যমে তার বিবৃতি ছাপা হয়েছে। তিনি তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগানকে বলেছেন, যতটা সম্ভব সবচেয়ে উত্তম উপায়ে রাখাইনের সব মানুষকে রক্ষার কাজ শুরু করেছে তার সরকার। সুচিকে উদ্ধৃত করে বিবৃতিতে বলা হয়, “আমরা ভালো করেই জানি যে, মানবাধিকারের বঞ্চনা ও গণতান্ত্রিক সুরক্ষার অর্থ। সুতরাং আমরা নিশ্চিত করছি যে, আমাদের দেশের সব মানুষের অধিকারের সুরক্ষা আছে এবং সেই অধিকার, যা শুধু রাজনৈতিক নয়, বরং সামাজিক ও মানবিক সুরক্ষার অধিকার।’ বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘সংঘর্ষ নিয়ে বৃহৎ আইসবার্গ সমান ভুল সংবাদ ও ছবি’ প্রকাশ করা হচ্ছে, যা ব্যাপকভাবে ভুল তথ্য ছড়াচ্ছে। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সমস্যা বাড়াতে এবং সন্ত্রাসীদের স্বার্থ হাসিলে এ কাজ করা হচ্ছে। আর এ ভুল তথ্যের কারণে ‘সন্ত্রাসী’ রোহিঙ্গাদের প্রতি সহানুভূতি বাড়ছে।”
গুলিবিদ্ধসহ ১৩ রোহিঙ্গার মরদেহ উদ্ধার : যুগান্তরের কক্সবাজার প্রতিনিধি জানান, কক্সবাজারের উখিয়ার পালংখালী সীমান্তের ওপারে নাফ নদীর তীরে মিয়ানমার সেনা ও মগ যুবকদের দায়ের কোপ ও গুলিতে নিহত হওয়া পাঁচজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। পাংলখালী আনজুমপাড়া এলাকার মেদিখাল এলাকা থেকে বিকালে এসব মরদেহ বাংলাদেশ ভূখণ্ডে তুলে আনা হয়। সন্ধ্যার পর আনজুমনপাড়া পূর্ব ফারিরবিল জামে মসজিদ কবর স্থানে তাদের লাশ দাফন করা হয়। নিহতরা হলেন- কারি ফায়েজুল ইসলাম (৫৬), শামশুল আলম (৫০), ছৈয়দ আলম (৫৫), সুফিয়া আকতার (১৯) ও ফয়েজুর রহমান (৯০)। তারা সবাই মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বুচিদং টংবাজার রাংমংপাড়ার বাসিন্দা।
বুচিদং টংবাজার রাংমংপাড়া মুহাম্মদ ফয়েজ জানান, বুধবার সকালে মিয়ানমার সেনার একটি বিশাল বাহিনী ও মগ যুবকরা তাদের পাড়ার পূর্ব প্রান্ত থেকে হামলা শুরু করে। নির্বিচারে গুলি চালিয়ে মানুষ হত্যা ও বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়ার খবর পেয়ে তাদের পাশের লোকজন বাংলাদেশ সীমান্তে পালিয়ে আসছিলেন। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সীমান্তে নৌকায় উঠার জন্য অপেক্ষারত লোকজনকে ধাওয়া করে তারা। কেউ নৌকায় কেউ সাঁতরে নদী পার হচ্ছিলেন। এ সময় মগ যুবকরা পেছন থেকে বেশ কয়েকজনকে ধারালো কিরিচ দিয়ে কোপায়। যারা নৌকায় ছিলেন তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে সেনারা। উখিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (তদন্ত) মো. কায় কিসলু তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, ওপারে গুলি ও ধারালো অস্ত্রের আঘাতে নিহত ৫ জনের মরদেহ এপারে নিয়ে এসেছেন স্বজনরা।
এদিকে টেকনাফ প্রতিনিধি জানান, নাফ নদীর শাহপরীর দ্বীপ ও খারাংখালীর পয়েন্টে পৃথক নৌকাডুবির ঘটনায় শিশুসহ ৮ রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। বুধবার সকালে শাহপরীর দ্বীপের নাফ নদী ও খারাংখালীর পয়েন্ট থেকে এ লাশগুলো উদ্ধার করে কোস্টগার্ড ও পুলিশ। এছাড়া আহত ও অসুস্থ হয়ে আরও তিন রোহিঙ্গার মৃত্যু ঘটেছে। এ নিয়ে গত ২ সপ্তাহে অন্তত ৭০ জন রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে।

গুলিবিদ্ধ আরও চার রোহিঙ্গা হাসপাতালে ভর্তি : চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর গুলিতে আহত চার রোহিঙ্গাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এরা হলেন- মংডু থানার আকিয়াবের নুরুল আমিনের ছেলে মো. শফি (২৫), নয়াপাড়ার আহমদ হোসেনের মেয়ে হাসিনা বেগম (১৮), একই এলাকার নুরুল মিয়ার ছেলে জাফর আলমকে (২৫) ও মংডুর হাইসুকার আবদুল জব্বারের ছেলে ওসামাকে (১৬)। মঙ্গলবার রাতে তাদের চমেক হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। পুলিশ জানায়, মঙ্গলবার রাতে গুলিবিদ্ধ ও আগুনে পোড়া চারজনকে হাসপাতালে আনা হলে তাদের ৬ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। এর আগে তাদের কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। পরে তাদের অবস্থার অবনতি হলে তাদের চমেক হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। ২৪ আগস্ট থেকে ১৩ দিনে ৫২ জন রোহিঙ্গা চট্টগ্রাম মেডিকেলে চিকিৎসা নিতে আসেন।
তুরস্কের ত্রাণ সহায়তা : তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোগান বলেছেন, রোহিঙ্গাদের জন্য তুরস্ক এক হাজার টন ত্রাণ পাঠাচ্ছে। বুধবার এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের প্রতি সমর্থন জানাতে তার স্ত্রী, সন্তান ও এক মন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে যাচ্ছেন।

https://www.jugantor.com/first-page/2017/09/07/153324