৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৮:৪৬

শুল্ক কমছে আমদানি বাড়ছে : চালের দাম কমছে না

‘সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়েছেন মিলমালিক ও আড়তদারেরা’

সরবরাহ ঘাটতির কারণে চালের আমদানি শুল্ক ২৮ শতাংশ থেকে দুই দফায় কমিয়ে মাত্র ২ শতাংশে আনা হয়েছে। আরো এক ধাপ এগিয়ে কোনোরূপ বিনিয়োগ ছাড়াই চাল আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলার সুযোগ করে দিয়েছে ব্যাংকগুলো। সুযোগ পেয়ে বিদেশ থেকে ব্যাপকহারে চাল আমদানি করছেন বেসরকারি উদ্যোক্তারা। সরকারিভাবে চাল আমদানি করা হচ্ছে ভারত, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনামসহ বিভিন্ন দেশ থেকে। ভারতীয় সামান্তবর্তী স্থলবন্দরগুলোয় চালভর্তি শত শত ট্রাকের অপেক্ষার খবর প্রতিনিয়তই গণমাধ্যমে প্রচার হচ্ছে। অথচ পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে এর কোনো প্রভাবই চোখে পড়ছে না। অর্থনীতির সাধারণ সূত্র অনুযায়ী জোগান বৃদ্ধির ফলে দাম কমার কোনো লক্ষণ তো নেই-ই, উল্টো সপ্তাহের ব্যবধানে বাড়ছে এক থেকে দুই টাকা।
আমদানি বৃদ্ধির পরও চালের দাম না কমার কারণ হিসেবে রাজধানীর বাদামতলীর লক্ষ্মী রাইস এজেন্সির মালিক নূর মোহাম্মদ নয়া দিগন্তকে বলেন, চাল আমদানি বেড়েছে এ কথা সত্যি। তবে বাজারে চালের যে চাহিদা রয়েছে আমদানি বা সরবরাহ সে তুলনায় বাড়েনি। তা ছাড়া চালের আমদানি শুল্ক এমন সময়ে এসে কমানো হয়েছে যখন আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম বাড়তি। এলসির মূল্য বেড়ে যাওয়ায় প্রচুর চাল আমদানি হলেও কম দামে বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে না। তিনি বলেন, প্রতিযোগিতার বাজারে মিলপর্যায়ে চালের দাম কমলে যেমন আমাদের কমাতে হয়, তেমনি মিলপর্যায়ে দাম বাড়লে আমাদের বাড়তি দামেই বিক্রি করতে হয়। উৎপাদন ও চাহিদার সঠিক হিসাব না থাকায় বাজারে চালের সঙ্কট কাটছে না বলেও দাবি করেন তিনি।
খুচরা বিক্রেতাদের অভিযোগ, মিলমালিক ও আড়তদারেরা সিন্ডিকেট করে চালের দাম বাড়িয়েছেন। তাদের সাথে যুক্ত ছিলেন সরকারের নীতিনির্ধারকেরাও। তারা যদি উপযুক্ত সময়ে শুল্ক কমানোর সিদ্ধান্ত নিতেন তাহলে সিন্ডিকেটকারীরা জনগণের পকেট থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ছিনিয়ে নিতে পারতেন না। দেশবাসী আরো অন্তত ৫ থেকে ১০ টাকা কম দামে চাল খেতে পারতেন। বাবুবাজার চালের আড়তে বর্তমানে মোটা চাল বিআর-২৮, গুটি ও স্বর্ণা কেজিপ্রতি ৪২ থেকে ৪৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সরু চাল মিনিকেট বা নাজিরশাইল বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫৩ টাকা কেজি দরে। খুচরা বাজারে গতকাল প্রতি কেজি মোটা চাল মানভেদে ৪৫ থেকে ৪৭ টাকায় বিক্রি হয়। সরু চাল নাজিরশাইল ও মিনিকেট ৫৬ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হয়।
জানা যায়, সন্তোষজনক বাড়তি মজুদ থাকায় আমদানি নিরুৎসাহিত করতে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে চালের শুল্কহার ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করেছিল সরকার। এর সঙ্গে রেগুলেটরি ডিউটি তিন শতাংশ যোগ হওয়ায় ব্যবসায়ীদের ২৮ শতাংশ শুল্ক গুণতে হত। ফলে গত দেড় বছর ধরে বেসরকারি পর্যায়ে চাল আমদানি প্রায় বন্ধ ছিল। কিন্তু চালের মজুদ কমতে কমতে দেড় লাখ মেট্রিক টনের ঘরে চলে আসায় এবং দাম কেজিপ্রতি ৬০ টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ায় আমদানি শুল্ক কমাতে বাধ্য হয় সরকার। রমজানের শেষভাগে এসে আমদানি বাড়াতে বিদ্যমান শুল্কহার ২৮ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা দেয় সরকার। আগস্টের মাঝামাঝিতে এসে আরো ৮ শতাংশ কমিয়ে নির্ধারণ করা হয় মাত্র ২ শতাংশ। তফসিলি ব্যাংকগুলোকে বিনা বিনিয়োগে আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খোলার অনুমতি দেয়ার নির্দেশ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
সরকার এ বছর প্রতি কেজি ধানের ক্রয়মূল্য নির্ধারণ করেছে ২৪ টাকা। চালের দাম ৩৪ টাকা। গত বছর ধানের বাম্পার ফলন হওয়ায় ২৩ টাকা দরে ধান এবং ৩২ টাকা দরে চাল ক্রয় করে সরকার। কিন্তু ক্রয়নীতিতে দুর্বলতা এবং দলীয় লোকদের মধ্যস্বত্ব ভোগের কারণে কৃষক এ দাম পাননি। সরকার ৯২০ টাকা দর বেঁধে দিলেও মওসুমের শুরুতে কৃষক ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা মণ দরে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। এ কারণে এ বছর অনেক কৃষক জমিতে ধানচাষ থেকে বিরত থেকেছেন বলেও জানান সংশ্লিষ্টরা। তাদের দাবিÑ সরকারের পরিসংখ্যানের সাথে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। মিল নেই মোট চাহিদা, উৎপাদন, জোগান ও জনসংখ্যার হিসাবেও।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যানুযাযী, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে ৩ কোটি ৪৯ লাখ ৬৮ হাজার টন চাল উৎপাদিত হয়েছে; যা আগের বছরের চেয়ে ২ লাখ ৫৮ হাজার টন বেশি। চলতি অর্থবছরে উৎপাদনের ল্য ৩ কোটি ৫০ লাখ টন। হওরের পরিস্থিতি উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে আশঙ্কা করেছিলেন সংশ্লিষ্টরা। অথচ আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম তখন দাবি করেন হাওর ডুবে গেলেও চালের কোনো ঘাটতি হবে না। তার দাবি ছিল, বাংলাদেশে বছরে ১৫ থেকে ২০ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকে। হাওরে ছয় লাখ টন কম উৎপাদন হলেও কোনো ঘাটতি হবে না।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/249746