৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৮:৪২

চামড়ার এমন দুরাবস্থা নজিরবিহীন

বিগত কয়েক বছরের মধ্যে এ বছরই কুরবানির পশুর চামড়া নিয়ে বিশৃংখলা হয়েছে সবচেয়ে বেশি। ট্যানরি মালিকরা বলছেন, বিগত একশ’ বছরের মধ্যে এ বছরই ঈদ মওসুমে তারা সবচেয়ে কম চামড়া পেয়েছেন। মোট সংগ্রহকৃত চামড়ার ৪০ ভাগ চামড়াই ট্যানারি মালিকরা পাননি বলে অভিযোগ করেছেন।

অন্যদিকে ব্যবসায়ী সূত্রগুলো বলছে, অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর কুরবানি হয়েছে বেশি। একটি সূত্র জানিয়েছে, এবছর দেশে গরু মহিষ আর ছাগল খাসী মিলিয়ে কুরবানি হয়েছে এক কোটি ২০ লাখেরও বেশি। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, পশুর এত চামড়া গেল কোথায়? চামড়া নিয়ে এমন দুরবস্থা বিগত একশ’ বছরের মধ্যে হয়নি বলেও জানান ব্যবসায়ীরা।
কুরবানির ঈদের পর পশুর চামড়া নিয়ে যে মন্দা ও বিশৃঙ্খলা দেখা গেছে তা ছিল অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। সরকারের নির্ধারণ করে দেওয়া দামের চেয়ে অনেক কম দামে চামড়া বেচাকেনা হয়েছে। কোথাও মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীরা জোটবদ্ধ হয়ে খুব কম দামে চামড়া কিনে পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে বেশি দামে বিক্রি করে বাড়তি লাভ করেছেন, কোথাও বেশি দামে কিনে কম দামে বিক্রি করে লোকসান গুণতে বাধ্য হয়েছেন।

এমনও হয়েছে যে, কম দামের কারণে কোথাও কোথাও চামড়া বিক্রি না করে সেগুলো দুর্গন্ধ ছড়ানোর আগেই মাটিতে পুঁতে ফেলেছেন অথবা নদীতে বা ডোবা নালায় ফেলে দিয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, কুরবানির পশুর চামড়ার একটি বিরাট অংশ মধ্যস্বত্বভোগীদের কজ্বায় চলে যায় ঈদের দিন রাতেই। এই চামড়া ট্যানারি মালিকরা পায়নি। একটি বড় সিন্ডিকেট নিজেদের মধ্যে যোগসাজশ করে কম দামে পাড়া মহল্লায় ঘুরে চামড়া কিনেছেন। পরে রাতের মধ্যেই এই চামড়ায় লবন মিশিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন পার্শ্ববর্তী দেশে।
এদিকে, রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সরিয়ে নেওয়া হলেও এবারও অল্প বিস্তর কিছু চামড়া ঢুকেছে হাজারীবাগের ছোট ছোট বেশ কিছু ট্যানারিতে। হাজারীবাগের একাধিক ট্যানারির মালিক জানিয়েছেন, শুধু লবণ মেশানোর জন্য সীমিত পর্যায়ে কিছু চামড়া হাজারীবাগে ঢুকেছে অল্প কয়েক দিনের জন্য। লবণ মিশিয়ে সেসব চামড়া সাভারের চামড়াশিল্প নগরীতে স্থানান্তর করা হবে। চামড়ার পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ী এবং আড়তদার সমিতির নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য পাওয়া গেছে। তবে অধিকাংশ ব্যবসায়ী জানিয়েছেন তারা এবছর মাত্র অর্ধেক চামড়া পেয়েছেন তাদের ট্যানারিগুলোতে। বাকি চামড়া কোথায় কি ভাবে চলে গেছে তা জানেন না ব্যবসায়ীরা।

ব্যবসায়ীরা জানান, হাজারীবাগ থেকে সাভারে স্থানান্তরের কারণে বেশ কিছু ট্যানারি বন্ধ হয়ে গেছে। তাই ট্যানারির মালিকদের অনেকে বকেয়া পরিশোধ করেননি। এ ছাড়া লবণের দাম বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে। এসব কারণে এবার চামড়ার দাম আগের বছরের তুলনায় কমেছে। রাজধানীর কাঁচা চামড়ার পাইকারি আড়ত লালবাগ ও আমিনবাজারের ব্যবসায়ীর জানিয়েছেন এসব এলাকার আড়তে ৫ থেকে ৭ বর্গফুটের ছোট গরুর চামড়া ১৫০ থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
গত বছর যার দাম ছিল ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। তা ছাড়া গত বছর ১৪ থেকে ১৫ বর্গফুটের প্রতিটি গরুর চামড়া ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হলেও এবার দাম ছিল ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। এর বাইরে ২০ থেকে ২২ বর্গফুটের প্রতিটি চামড়ার এবারের দাম ছিল ৯০০ থেকে ১ হাজার টাকা। গত বছর যা ১ হাজার ৭০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকায় বিক্রি হয়েছিল।
চামড়া আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক টিপু সুলতান জানান, সরকারের বেঁধে দেয়া ৫০ থেকে ৫৫ টাকা বর্গফুট দামে চামড়া সংগ্রহ করেছেন তাঁরা। তবে লবণ, জনবল ও অন্যান্য খরচ যোগ করে প্রতি বর্গফুট চামড়া সংরক্ষণে তাঁদের খরচ পড়েছে ৭০ থেকে ৭৫ টাকা।
ঢাকার আমিন বাজার কেন্দ্রিক ব্যবসায়ী ও ঢাকা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির নেতা রবিউল আলম বলেন, ‘পাড়া, মহল্লা থেকে যেসব মৌসুমি ব্যবসায়ী চামড়া সংগ্রহ করেছেন, তাঁরা কিছুটা কম দামে চামড়া কিনতে পেরেছেন। রবিউল আলম আরও জানান, এবার সারা দেশে প্রায় সোয়া কোটি চামড়া পাওয়া গেছে। এর মধ্যে গরু ও মহিষের চামড়া প্রায় ৫৫ লাখ এবং ছাগল ও ভেড়ার চামড়া প্রায় ৭০ লাখ পিস।
এদিকে, রাজধানীর হাজারীবাগে সীমিত পর্যায়ে সীমিত সময়ের জন্য চামড়া প্রক্রিয়াজাতের এ সুবিধা দেওয়া হলেও তা দীর্ঘায়িত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন ঢাকা হাইড অ্যান্ড স্ক্রিন লিমিটেডের পরিচালক খোকন ভূঁইয়া। তিনি বলেন, চামড়ার শেষ গন্তব্য হেমায়েতপুরে। সেখানে সীমিত সময়ের জন্য হাজারীবাগে চামড়া ঢোকার সুযোগ দেওয়া ঠিক হয়নি। সীমিত সময়ের জন্য সুযোগ দেওয়া হলেও তা দীর্ঘায়িত হতে পারে।
ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে এবার চামড়ার কম দামের বিষয়ে বেশ কিছু কারণও জানা গেছে। প্রথমত, চামড়া সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান লবণের দাম বেড়ে যাওয়ায় মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীদের একটা বড় অংশ নগদ টাকা খরচ করে চামড়া সংগ্রহ করার উৎসাহ হারিয়েছেন। গত কুরবানির ঈদের সময় চামড়ার বাজারের মন্দার অভিজ্ঞতাও তাঁরা স্মরণে রেখেছেন। দ্বিতীয়ত, অনেক মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী পাইকারি ব্যবসায়ী ও ট্যানারির মালিকদের কাছে গত বছর চামড়া বিক্রি করেছিলেন বাকিতে, সেই বকেয়া টাকা তাঁরা তুলতে পারেননি বলে এ বছর একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করেননি। কিংবা নগদ টাকায় চামড়া সংগ্রহ করার আর্থিক সামর্থ্য তাঁদের ছিল না।

মোট কথা এবার কুরবানির পশুর চামড়ার দাম কম হওয়ার প্রধান কারণ হলো প্রাথমিক পর্যায়ে ক্রেতার ঘাটতি। এ দেশে কোনো কোনো বছর মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে কুরবানির চামড়া সংগ্রহ করেন, আবার কোনো বছর কুরবানির পশুর মালিক নিজেই ক্রেতা খুঁজে পান না। ব্যবসায়ীদের দাবি কী কী কারণে এমনটা ঘটে তা নিরূপণ করা প্রয়োজন; কারণ এ ধরনের অনিশ্চয়তা নিয়ে চামড়াশিল্পের দ্রুত বিকাশ সম্ভব হবে না।

এ খাতেরসাথে সংশ্লিষ্টরা জানান, সরকার যদি সদিচ্ছা নিয়ে এই চামড়াশিল্পের আরও বিকাশ ঘটাতে চায় এবং তা অবশ্যই সম্ভব। সে জন্য এই শিল্পের পেশাদারি মনোভাব বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক বেশ কিছু বড় কোম্পানি আমাদের চামড়াজাত দ্রব্য আমদানি করে না এ কারণে যে আমাদের ট্যানারিশিল্পগুলো পরিবেশ সংরক্ষণের বাধ্যবাধকতা মেনে চলে না। আমাদের কিছু কোম্পানি বিদেশ থেকে চামড়া কিনে এনে তা দিয়ে জুতা ও অন্যান্য চামড়াজাত পণ্য তৈরি করে বিদেশে রপ্তানি করে।
ব্যবসায়ীদের অভিমত হচেছ, আমরা যদি দেশি ট্যানারিশিল্পের পরিবেশগত বাধ্যবাধকতা রক্ষা করে গুণগত মানসম্পন্ন চামড়া পর্যাপ্ত পরিমাণে উৎপাদন করতে পারি, তাহলে বিদেশ থেকে চামড়া আমদানির প্রয়োজন হবে না। এদিকেই আমাদের মনোযোগী হওয়া উচিত। কুরবানির সময় লবণের বাজার নিয়ন্ত্রণ করা জরুরী। কেননা, লবণের চড়া দাম চামড়া সংরক্ষণে বিরাট প্রতিবন্ধক আর সে কারণে চামড়ার গুণগত মান রক্ষা করা সম্ভব নয়।

http://www.dailysangram.com/post/298746