ত্রাণের জন্য বন্যার্তদের অপেক্ষা
৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৮:৩৯

বন্যা

বন্যার্তদের এখনই ভুলে যাওয়ার সুযোগ নেই

 আমাদের সংবাদমাধ্যমের প্রধান মনোযোগের বিষয় এখন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। তারা নিজের দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে দলে দলে বাংলাদেশে ঢুকছে। ইতিমধ্যে ১ লাখ ৮০ হাজারের মতো ঢুকে পড়েছে। মানবিক কারণে আমাদের সরকার তাদের অনুপ্রবেশে বাধা দেয়নি, এ দেশের জনগণও তাদের প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতিশীল। বিষয়টা আমাদের সংবাদমাধ্যমে এত গুরুত্ব পাচ্ছে এই কারণে যে এটা শুধু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সমস্যা নয়, বাংলাদেশের জন্যও এক বিরাট সমস্যা।

কিন্তু সে জন্য আমাদের বিপুলসংখ্যক বন্যাদুর্গত মানুষের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেওয়া কিংবা তাদের দুঃখ–কষ্টের কথা ভুলে যাওয়া মোটেই উচিত হবে না। গত সপ্তাহে বগুড়া ও গাইবান্ধা জেলার কয়েকটি বন্যাদুর্গত জনপদ ঘুরে দেখে ও মানুষের সঙ্গে কথা বলে আমার মনে হয়েছে, তাদের আরও দীর্ঘ সময় ধরে সাহায্য-সহযোগিতার প্রয়োজন হবে। শুধু এই দুটি জেলাই নয়, সরকারের ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, এবারের ব্যাপক বন্যায় আরও ৩০টি জেলা মিলিয়ে প্রায় ৭৫ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রায় ৩ লাখ মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে একদম নিঃস্ব ও নিরাশ্রয় হয়ে পড়েছে। ৭৫ হাজার ঘরবাড়ি সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয়ে গেছে, আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫ লাখ ৮৬ হাজার ঘরবাড়ি। সর্বস্ব হারানো প্রায় ৩ লাখ মানুষকে অন্তত আগামী তিন মাস খাদ্য সাহায্য দিতে হবে। নইলে তাদের অনেকের, বিশেষত শিশু ও নারীদের স্বাস্থ্যগত বিপর্যয় ঘটতে পারে। এমনকি অপুষ্টিজনিত অকালমৃত্যুর হার অনেক বেড়ে যেতে পারে।

কিন্তু এই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির বিপরীতে সরকারের পক্ষ থেকে যে পরিমাণ ত্রাণ সাহায্য বরাদ্দ করা হয়েছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় শোচনীয় রকমের কম। সরকারি হিসাব অনুযায়ী বরাদ্দ করা হয়েছে মোট ২০ হাজার ৭১৮ মেট্রিক টন চাল, ৫৫ হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার এবং ৯ কোটি ৫৯ লাখ ৪০ হাজার টাকা। বগুড়া ও গাইবান্ধা জেলার জন্য বরাদ্দ ত্রাণ সাহায্যের সিংহভাগ ঈদের আগেই বিতরণ করা হয়েছে। কিন্তু আমি বগুড়ার সারিয়াকান্দি ও সোনাতলা উপজেলা এবং সারিয়াকান্দির ফুলছড়ি উপজেলার কয়েকটি বন্যাদুর্গত এলাকায় গিয়ে যে চিত্র দেখেছি, তা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। গরিব বন্যার্ত মানুষগুলোর বেঁচে থাকাই যেন এখনকার একমাত্র সংগ্রাম। যেমন সাত-আট সদস্যের একেকটি পরিবার দেড় মাসের মধ্যে ত্রাণ সাহায্য বলতে পেয়েছে মাত্র ১০ কেজি চাল। সেই ১০ কেজিও আসলে ১০ কেজি নয়, ২-৩ কেজি চুরি করা হয়েছে। দেড় মাস ধরে সাত-আটজন মানুষ একটু একটু করে চাল ফুটিয়ে নুন দিয়ে ভাত খেয়ে কোনোমতে বেঁচে আছে, এমন কথা আমি ভুক্তভোগী মানুষগুলোর মুখেই শুনেছি একাধিক বন্যাদুর্গত গ্রামে।
বগুড়া জেলায় মোট ৬৭ হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জেলা প্রশাসন হিসাব দিয়েছে। জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ থেকে ঈদের আগের দিন পর্যন্ত ওই জেলায় মোট ৯৩৫ মেট্রিক টন চাল আর ১০ হাজার প্যাকেট শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়েছে। বন্যাদুর্গত মানুষের দুর্দশা অনুধাবন করতে ত্রাণ সাহায্যের অপর্যাপ্ততার এই একটা দৃষ্টান্তই যথেষ্ট। গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি উপজেলায় দেখেছি আরও করুণ চিত্র। এই দুটি জেলার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বলা যায়, প্রয়োজনের তুলনায় ত্রাণ সাহায্যের ব্যাপক ঘাটতির ফলে বন্যার্ত জনগোষ্ঠীর দরিদ্রতম অংশের জীবনযাপন কী মানবেতর পর্যায়ে নেমে গেছে। অন্তত তিন লাখ দুর্গত মানুষের জীবনকে এখন স্রেফ অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম ছাড়া অন্য কিছু বলা যাবে না।
বরাদ্দের ঘাটতি একটা বাস্তবতা। এটা নিয়ে আফসোস করা যায়; সরকারের উদ্দেশে বলা যায়, এই বরাদ্দ খুবই কম, দয়া করে বরাদ্দ আরও বাড়ানো হোক। কিন্তু দুর্গত মানুষগুলোর জন্য যেটুকু ত্রাণ সাহায্য বরাদ্দ করা হয়েছে, সেটুকুও যদি তারা ঠিকমতো হাতে না পায়, তাহলে কী করার থাকে?
আফসোস করার কিছু থাকে না; কারণ, ভুখা মানুষগুলোর মুখের গ্রাস যারা কেড়ে খাচ্ছে, তারা আসলে মানুষ কি না, তা নিয়েই আমার মনে সন্দেহ জেগেছে। যেখানেই গেছি, উলঙ্গ শিশু কোলে অভুক্ত নারীরা শুকনা মুখে অভিযোগ করেছেন, তাঁদের হক মেরে খাওয়া হয়েছে। কেউ কেউ তিক্ত স্বরে রসিকতা করে বলেছেন, ঢাকা থেকে ১০ কেজি চাল দিলে কী হবে, ঢাকা তো অনেক দূরে, এতটা পথ পাড়ি দিয়ে সারিয়াকান্দি আসতে আসতে ১০ কেজি চাল তো ৫ কেজি হবেই। গাইবান্ধার ফজলুপুর ইউনিয়নে ব্রহ্মপুত্র নদের পশ্চিম কিনারে ত্রাণ সাহায্যের আশায় কোমরপানিতে দাঁড়ানো কজন পুরুষ আমাকে বলেছেন, ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার-চেয়ারম্যানেরা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের তালিকায় নাম লেখাতে টাকা কিংবা ত্রাণ সাহায্যের অংশবিশেষ নিয়েছেন। ১০০ টাকা দিলে ‘লিস্টিত’ নাম উঠবে, এমন কথা বলেছেন একাধিক পুরুষ। গাইবান্ধার পোড়ার চর নামের এক বন্যাদুর্গত গ্রামের নারীরা বলেছেন, তাঁদের ত্রাণের চাল দেওয়া হয়েছে বালতিতে করে, তাঁরা মেপে দেখেছেন, ১০ কেজি নেই, ৭ কিংবা ৮ কেজি আছে। একাধিক জায়গায় বন্যার্ত মানুষেরা ক্ষোভ ও ক্রোধের সঙ্গে ত্রাণচোরদের উদ্দেশে অভিশাপ উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘যারা গরিবের হক ম্যারে খায়, তারগে উপর আল্লার গজব পড়ে না ক্যা!’
সরকারের বন্যা ত্রাণ কার্যক্রমের সবচেয়ে বড় দুর্বল দিক এটাই, বরাদ্দ করা ত্রাণ সাহায্য দুর্গত মানুষগুলোর কাছে সুষ্ঠুভাবে পৌঁছানো নিশ্চিত করা হয়নি। ত্রাণ চুরির যেসব অভিযোগ ইতিমধ্যে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষের উচিত সেগুলো তদন্ত করে দেখা। অভিযোগ সত্য হলে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
আর যদি এমন হয় যে ত্রাণ সাহায্য চুরি তথা ‘গরিবের হক মেরে খাওয়া’ ইতিমধ্যেই একটা স্থায়ী চর্চায় পরিণত হয়েছে এবং তা সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের খুব ভালোভাবেই জানা আছে, তাহলে বলতে হবে, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত মানবেতর জীবনযাপনকারী লাখ লাখ মানুষের প্রতি সরকারের উচ্চমহলে সংবেদনশীলতার ঘাটতি আছে। বিপুলসংখ্যক মানুষের জীবন যখন মানবেতর পর্যায়ে নেমে গেছে, খাদ্যের অভাবে যখন নারী ও শিশুদের জীবন রক্ষাই দায় হয়ে উঠেছে, তখন তাদের জন্য বরাদ্দ যৎসামান্য ত্রাণ সাহায্য নিয়ে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগের মুখে সরকার কীভাবে নির্বিকার থাকতে পারে? সরকারের নেতাদের অজস্রবার বলতে শুনেছি, পর্যাপ্ত ত্রাণ সাহায্য আছে। কিন্তু এই কথা বলার চেয়ে বেশি জরুরি হচ্ছে এমন হুঁশিয়ারি বারবার উচ্চারণ করা, যারা দুর্গত মানুষের ত্রাণ সাহায্যের নয়ছয় করবে, তাদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে।
সরকারের বন্যা ত্রাণ কার্যক্রম এখনো শেষ হয়নি, যদি সিংহভাগ বরাদ্দই ইতিমধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। সব বরাদ্দ বিতরণ শেষ হওয়ার পরও ক্ষতিগ্রস্ত বিপুলসংখ্যক মানুষের সহযোগিতার প্রয়োজন থেকে যাবে। গাইবান্ধার মতো অনেক বন্যাদুর্গত এলাকায় এখন কোনো কর্মসংস্থান নেই, ওই সব এলাকায় শুকনো মৌসুম আসার আগে পর্যন্ত প্রকট দারিদ্র্য ও খাদ্যাভাব থেকে যাবে। তাই নতুন করে খাদ্য-সাহায্য বরাদ্দ করা প্রয়োজন, এবার চালের সঙ্গে ডাল আর চিনাবাদাম স্বল্প পরিমাণে হলেও দেওয়ার চেষ্টা করা উচিত। কারণ, দীর্ঘ সময় ধরে শুধু শর্করার ওপর নির্ভরতা এসব মানুষের মধ্যে পুষ্টি সমস্যা সৃষ্টি করবে। নারী ও শিশুদের জন্য প্রোটিনসমৃদ্ধ শুকনা খাবারের ব্যবস্থা করা অত্যন্ত জরুরি।

আমাদের সম্পদের সীমাবদ্ধতা আছে, এটা সত্য। আবার এটাও সত্য যে আমরা আমাদের সীমিত সম্পদের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারি না। সম্পদ বরাদ্দের বিবেচনাও সব সময় সঠিক বা ন্যায্য হয় না। এই দেশে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে চার হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়ে গেলে অর্থমন্ত্রী বলতে পারেন, এটা কোনো বড় অঙ্কের টাকা নয়। এই দেশেই বন্যায় ৭৫ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হলে, তাদের মধ্যে ৩ লাখ সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব-নিরাশ্রয় হলে মাত্র ২০ হাজার টন খাদ্যশস্য আর সাড়ে ৯ কোটি টাকা ত্রাণ সাহায্য হিসেবে বরাদ্দ করার মধ্যে কোনো সুবিবেচনার প্রতিফলন আছে কি না, তা ভেবে দেখার বিষয়।
মশিউল আলম: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

mashiul.alam@gmail.com

http://www.prothom-alo.com/opinion/article/1314251