৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭, বুধবার, ৯:২০

নিষ্ঠুর বর্বরতায় অবিশ্বাস্য নীরবতা

ভারতীয় মিডিয়া মেয়েটির নাম দিয়েছিল নির্ভয়া। ২০১২ সালের ১৬ই ডিসেম্বর রাতে
দিল্লিতে চলন্ত বাসে ধর্ষণের শিকার হন তিনি। দুই সপ্তাহ পর মারা যান হাসপাতালে। বছর পাঁচেক পর প্রায় একই ঘটনা চিত্রায়িত হলো বাংলাদেশে। টাঙ্গাইলের মধুপুরে চলন্ত বাসে ধর্ষণের পর হত্যা করা হলো মেয়েটিকে। না, বাংলাদেশের মিডিয়া তার কোনো নাম দেয়নি। জাকিয়া সুলতানা রূপার প্রতি ঘটে যাওয়া নির্মমতার কাহিনী খবর হয়েছে। এ ঘটনায় অভিযুক্ত আসামিরা ধরাও পড়েছে।

কিন্তু এই নিষ্ঠুর ও বর্বর ঘটনা এবং এর পরের প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশের সমাজের এক ভয়ঙ্কর বদলই সবার সামনে নিয়ে এসেছে। নির্ভয়া কাণ্ডের পরও ভারতে ধর্ষণ থেমে যায়নি। কিন্তু ওই ঘটনার পর প্রত্যেক বিবেকবান ভারতীয় নাগরিক প্রতিবাদে মুখর হয়েছিলেন। দিনের পর দিন রাজপথে বিক্ষোভ করেছেন জনতা। প্রতিবাদী মিছিলে প্রকম্পিত হয়েছিল চারদিক। ক্ষোভ আর ঘৃণা প্রকাশ করেছিল সব শ্রেণি আর পেশার মানুষ। ভারতের সীমানা পেরিয়ে প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়েছিল দেশে দেশে। ওই মামলায় এরই মধ্যে আসামিদের বিরুদ্ধে আদালত রায় ঘোষণা করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের নির্ভয়াকাণ্ডে কোথাও কোনো প্রতিবাদী মিছিল বের হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। মেয়েটির অনেক স্বপ্ন ছিল পরিবার নিয়ে। পরিবারও স্বপ্ন দেখেছিল তাকে নিয়ে। সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে কিছু অমানুষ। বর্বরতারও একটা সীমা থাকে। মেয়েটির সঙ্গে যা হলো, তা হার মানিয়েছে সব বর্বরতাকেই। এই অবিশ্বাস্য বর্বরতা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও তেমন কোনো মাতম হয়নি। অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে টেস্ট জয় যেন ঢেকে দিয়েছে এই বর্বরতার ক্ষত। সবাই ব্যস্ত খেলা আর সংগীত নিয়ে। যেন এখানেই জীবনের সবকিছু। মেয়েটির সঙ্গে ঘটে যাওয়া বর্বরতা যেন শুধুই একটি পরিবারের ব্যক্তিগত দুঃখ যন্ত্রণার কাহিনী। এর চেয়ে বেশি কিছু নয়। অথচ এর শিকার হতে পারি আমরা যে কেউ।

এই খবর মিইয়ে যাওয়ার আগেই পাওয়া গেছে একই ধরনের আরেক বর্বরতার খবর। এবার ভাড়ায়চালিত মোটরসাইকেল চালকদের ধর্ষণের শিকার হয়েছে এক কিশোরী। ঈদের আগের দিন পটুয়াখালীর বাউফলে ঘটেছে এই ঘটনা। ধর্ষণের শিকার ওই মেয়ের বাবা গণমাধ্যমকে বলেছেন, তার মেয়ে মানসিকভাবে খুব একটা সুস্থ নয়। মায়ের সঙ্গে রাগ করে গত শুক্রবার সন্ধ্যায় সে ঢাকায় চলে যাওয়ার জন্য বাড়ি ছাড়ে। ভাড়ার মোটরসাইকেলে উঠে কিছুদূর যাওয়ার পর চার-পাঁচ যুবক মোটরসাইকেলে এসে পথরোধ করে দাঁড়ায়। তারা মেয়েটিকে ধর্ষণ করে। গতকাল সোমবার কিশোরীটির বয়স নির্ধারণী পরীক্ষা হয় পটুয়াখালী হাসপাতালে।

প্রতিদিনই ধর্ষণের খবর। কোনো দিন একটি, কোনো দিন একাধিক শিরোনাম। ঘটনা স্থান-কাল-পাত্রভেদে গণমাধ্যমে বিশেষ জায়গাও দখল করে। এরমধ্যে কোনো ঘটনা দেশজুড়ে হইচই ফেলে দেয়। আবার কোনো ঘটনা চলে যায় লোকচক্ষুর আড়ালে। তবে থামে না ধর্ষিতা ও তার পরিবারের আর্তনাদ। বেডরুম থেকে হাসপাতাল, থানা, কোর্ট-কাচারি পর্যন্ত পৌঁছে যায় তাদের এই আর্তনাদ। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস বয়ে বেড়ান ধর্ষণের যন্ত্রণা আর অপমান। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ধর্ষক তাদের নিজ গণ্ডির মধ্যেই থাকে। বন্ধু-প্রেমিক-প্রতিবেশীই তাদের ধর্ষক। এমনকি কেউ কেউ ধর্ষিত হচ্ছেন আপনজনের কাছেও। লজ্জায় তা প্রকাশও করতে পারছেন না অনেকে। অথচ প্রতিদিনই ভেতরটা তোলপাড় হয়ে যায় ধর্ষিতার। এ যন্ত্রণা নিয়েই বেঁচে থাকতে হয় সমাজে। অনেকে এই অপমান সহ্য করতে না পেরে শেষ করে দেন নিজেকে। দেশের ১০টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গত ৬ মাসে সহস্রাধিক নারী ও শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। ধর্ষণের আলামত সংগ্রহের জন্য ফরেনসিক পরীক্ষা করানো হয়েছে তাদের।

তিন বছর নয় মাস বয়সী এক অবুঝ শিশু তানহা। পিতা-মাতার ১০ বছরের দাম্পত্য জীবনে সেই ছিল একমাত্র সন্তান। তাকে নিয়ে বাড্ডার আদর্শনগরের একটি বাসায় ভাড়া থাকতেন তারা। ওই বাসার আরেকটি কক্ষে সস্ত্রীক ভাড়া থাকতেন শিপন। তার স্ত্রী একজন গার্মেন্টকর্মী। গত ৩০শে জুলাই বিকাল ৫টায় শিশু তানহা পাশের বাসা থেকে শিপনের ঘরের সামনে দিয়ে নিজের ঘরে ফিরছিল। এ সময় শিপন খাবারের লোভ দেখিয়ে তাকে টান দিয়ে ঘরে নিয়ে যায়। ধর্ষণ করে। তার এই নারকীয় কাণ্ডে তানহা ও শিপনের পরিহিত কাপড়সহ বিছানা রক্তাক্ত হয়ে যায়। তানহা চিৎকার করলে শিপন তার গলা চেপে হত্যা করে। পরে তানহার লাশ বাসার টয়লেটে ফেলে দেয়। শিপন রক্তভেজা চাদর, তার গায়ের গেঞ্জি ও পরনের লুঙ্গি বালতিতে ভিজিয়ে রাখে। পুলিশ ওইদিনই তাকে গ্রেপ্তার করে। জানা যায়, গ্রেপ্তারকৃত শিপন ডাকাতি মামলায় ৫ বছর জেল খেটে আসার পর দিনমজুরের কাজ করতো। লোমহর্ষক এ ঘটনাটি নাড়া দেয় দেশবাসীকে। এরপর থেকে এখনো স্বাভাবিক হতে পারেননি শিশু তানহার মা। তিনি এখন পাগলপ্রায়। তানহার বাবা বলেন, ১০ বছরের সংসার জীবনে তার ওই একটি মাত্রই সন্তান। বলেন, তাদের সংসারে আর কখনোই আনন্দ ফিরবে না। তানহার মাও হয়তো স্বাভাবিক হতে পারবেন না।

গত ৯ই আগস্ট উত্তরখানের এক স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণ করে এলাকার ৫ বখাটে। প্রায় সাড়ে ৫ ঘণ্টা ধরে ধর্ষণের একপর্যায়ে মেয়েটি অচেতন হয়ে পড়ে। পরে জ্ঞান ফিরলে মেয়েটির আর্তচিৎকারে ছুটে যান টহল পুলিশ। এরপর দিন অবশ্য ওই পাঁচ বখাটে ধরা পড়ে পুলিশের হাতে।

২০১৩ সালের ২০শে জানুয়ারি রাতে বাথরুমে যাওয়ার সময় রংপুরের পীরগাছায় এক কিশোরীকে ধর্ষণ করে বখাটে লেবু (২৮)। যুবতীর মুখ কাপড় দিয়ে বেঁধে ধর্ষণ করে। এতে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। পরে ওই অবস্থায় রেখে ধর্ষক পালিয়ে যায়। এ ঘটনা জানাজানি হলে ঘটনার দু’দিন পর অপমানে কিশোরী নিজের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। প্রাণে বেঁচে গেলেও সারা শরীর তার আগুনে ঝলসে যায়। ওই সময় আগুনে পোড়ার যন্ত্রণায় গগণবিদারী চিৎকারে হাসপাতালের পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে। মেয়েটি বেঁচে গেলেও তার সেই আর্তনাদ আজও থামেনি। এখনো সে সেই ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে।

বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যমতে, দেশের ১০টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার ও ফরেনসিক বিভাগে চলতি বছর প্রথম ৬ মাসে সহস্রাধিক নারী ও শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে ফরেনসিক পরীক্ষা করিয়েছেন। বাংলাদেশ মহিলা অধিদপ্তরের নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রকল্পের দেয়া তথ্যমতে, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওসিসিতে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন ১৯২ জন। ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওসিসিতে এই সংখ্যা ২৭ জন। বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (শেবাচিম) ৪৯ ধর্ষিতা নারী-শিশু ফরেনসিক পরীক্ষা করিয়েছে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (চমেক) সূত্রে জানা গেছে, জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ওসিসিতে ৮০ জন ধর্ষিতার ফরেনসিক পরীক্ষা করা হয়েছে। সাম্প্রতিক কালে এ ধরনের রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে হাসপাতালটিতে। সেই তুলনায় শয্যা সংখ্যা অপ্রতুল। ফলে অনেক রোগীকে মেঝেতে রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। সিলেট ওসমানী মেডিকেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত জানুয়ারি থেকে আগস্টের ২০ তারিখ পর্যন্ত ২৩১ জন নারী ও শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তাদেরকে হাসপাতালটির ওসিসিতে ফরেনসিক পরীক্ষা করানো হয়েছে। এছাড়া শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়ে আরো ১৪১ জন ওসিসিতে ভর্তি হয়েছেন। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (খুমেক) ১৬২ জন ব্যক্তি নির্যাতনের শিকার হয়ে ভর্তি হয়েছে। এরমধ্যে ধর্ষিত নারী ও শিশুর সংখ্যা ২৬ জন। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওসিসি সহকারী মো. জাকির হোসেন জানিয়েছেন, এই হাসপাতালে জানুয়ারি থেকে আগস্টের ২০ তারিখ পর্যন্ত ১৫১ ধর্ষিতার ফরেনসিক পরীক্ষা করানো হয়েছে। বর্তমানে সেখানে আরো ৭-৮ জন চিকিৎসাধীন রয়েছেন। বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (শজিমেক) ফরেনসিক বিভাগের প্রধান কেএম সাইফুল ইসলাম জানান, তারা ১২৪ জন যৌন নিপীড়িত নারী-শিশুর ডাক্তারি পরীক্ষা করেছেন। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (রামেক) ওসিসি সূত্রে জানা গেছে, জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত মোট ৪৩ ধর্ষিতার ফরেনসিক পরীক্ষা করা হয়েছে। আর জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার হয়ে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন ১৩৪ ধর্ষণের নারী-শিশু। মহিলা অধিদপ্তরের পরিচালিত নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রকল্পের পরিচালক ড. আবুল হেসেন বলেন, পারিবারিক বন্ধন নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে আগের চেয়ে ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিনি বলেন, পিতামাতার সঙ্গে সন্তানের দূরত্ব তৈরি হলে তাদের নৈতিক স্খলন ঘটে। এছাড়া ইন্টারনেটেরও একটা কুপ্রভাব আছে। তিনি বলেন, অশ্লীল ভিডিও মানুষের পাশবিকতাকে উসকে দেয়। তখন তার হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। এজন্য নাবালক শিশুরাও তার হাত থেকে রেহাই পায় না। তাছাড়া বিচারহীনতার কালচারও এসব ঘটনা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=81639