৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭, বুধবার, ৯:১২

তদন্ত প্রক্রিয়াতেই ব্যয় ২৭৯ দিন!

ইঁদুরে বাঁধ কাটা দুর্নীতি

গত বছর হাওর রক্ষা বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত প্রতিবেদন প্রক্রিয়ায়ই সময় লেগে যায় ২৭৯ দিন। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) সংশ্লিষ্ট ১০ কর্মকর্তার টেবিলে ঘুরে তদন্ত প্রতিবেদনের অনুমোদন পেতে এ সময় ব্যয় হয়। এর মধ্যে প্রতিবেদনটি পাউবোর তৎকালীন ডিজির টেবিলেই ছিল ৫৪ দিন। ‘ইঁদুরে বাঁধ কেটে ফেলা’র আলোচিত সেই তদন্ত প্রতিবেদনটি পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) পাঠাতে সময় নেয়া হয় ৬২ দিন। এভাবেই একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার পাঠানো অভিযোগের জরুরি তদন্ত প্রক্রিয়াতেই কেটে যায় প্রায় ১০ মাস। দুদক আলোচ্য তদন্ত প্রতিবেদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তি নিশ্চিত করার কথা বললে সময়ক্ষেপণের বিষয়টি বেরিয়ে আসে। এ ঘটনায় দায়িত্ব পালনে গাফিলতির অভিযোগে চার কর্মকর্তা-কর্মচারীকে দায়ী করা হয়। অথচ তদন্ত প্রতিবেদন অনুমোদনকারী কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাকে কৌশলে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. জাফর আহমেদ খান মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, ‘তদন্ত কমিটি যাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেছে তা পর্যাপ্ত নয়। ফসলহারা হাওরবাসীর প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই বলতে চাই যখন এই তদন্ত রিপোর্ট পাউবোর ডিজির কাছে পাঠানো হয় তখন কিছুতেই তিনি ৫৪ দিন আটকে রাখতে পারেন না। আমি বলব, এটা পাউবোর তৎকালীন ডিজির গাফিলতি।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘দীর্ঘ সময় নষ্ট করার বিষয়ে আমি সাবেক ডিজির কাছে কৈফিয়ত তলব করেছিলাম। কিন্তু তিনি অন্য প্রসঙ্গে কথা বলে এড়িয়ে গেছেন। তবে ডিজি জাহাঙ্গীর কবীর অবসরকালীন ছুটিতে যাওয়ায় তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া যায়নি।’ অপর এক প্রশ্নের জবাবে এই সিনিয়র সচিব বলেন, ‘মন্ত্রণালয় থেকে দুদক কার্যালয়ে তদন্ত প্রতিবেদন পাঠাতে ৬২ দিন সময় নেয়ার বিষয়টিও গ্রহণযোগ্য নয়। বিষয়টি আমি গুরুত্ব দিয়ে দেখব।’
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, যাদের বিরুদ্ধে দায়িত্ব পালনের এই অভিযোগ আনা হয়েছে তাদের মধ্যে তিনজনই তুলনামূলক অনেক ছোট পর্যায়ের কর্মকর্তা। এই ফাইল আটকে রাখার কোনো ক্ষমতাই তাদের নেই। দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের অভিযোগ থেকে ছেড়ে দিয়ে পাউবো শাক দিয়ে মাছ ডেকে রাখার কৌশল নিয়েছে। এ নিয়ে পাউবোতে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, সুনামগঞ্জের ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে গত বছরের ৫ এপ্রিল দুদকে অভিযোগ দেয় একটি গুরুত্বপূর্ণ গোয়েন্দা সংস্থা। পাউবোর সুনামগঞ্জের তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী, উপবিভাগীয় প্রকৌশলী (এসডিই) ও শাখা কর্মকর্তাসহ (এসও) ৮ জনের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ দেয়া হয়। এরপর ১৬ মে অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত করতে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে দাফতরিক পত্র দেয় দুদক। ২২ দিন পর গত বছরের ৭ জুন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় অভিযোগের বিষয়টি পানি উন্নয়ন বোর্ডে পত্র দেয়। এরপর তদন্ত কমিটি গঠন করতে পাউবো সময় নেয় ১৬ দিন। অর্থাৎ ২৩ জুন পাউবোর তৎকালীন অতিরিক্ত মহাপরিচালক আবদুল হাই বাকী ও ডিজাইন সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হারুনুর রশীদের সমন্বয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। পাউবো দফতর থেকে তদন্ত কমিটির দুই সদস্যকে তদন্তের বিষয়টি অবহিত করতে সময় নেয়া হয় ৫ দিন। তদন্তকারী কর্মকর্তারা এ বিষয়ে দাফতরিক পত্র পান ২৮ জুন। ৬৪ দিন তদন্ত করে কমিটি পাউবোর শৃঙ্খলা পরিদপ্তরে প্রতিবেদন দেয় ১ সেপ্টেম্বর। পাউবোর শৃঙ্খলা পরিদফতর এই তদন্ত প্রতিবেদন যাচাই-বাছাই করতে সময় নেয় ৩৯ দিন। এরপর ১০ অক্টোবর পরবর্তী প্রক্রিয়া গ্রহণে পাউবোর অতিরিক্ত মহাপরিচালকের (প্রশাসন) কার্যালয়ে এই নথি পাঠানো হয়। সেখানেও এই ফাইল অনুমোদনের অপেক্ষায় ছিল ১৫ দিন।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, অতিরিক্ত মহাপরিচালক ও পাউবোর মহাপরিচালক পাশাপাশি কক্ষে অফিস করেন। কিন্তু অতিরিক্ত মহাপরিচালকের (প্রশাসন) কার্যালয় থেকে এই নথি মহাপরিচালকের দফতরে যেতে সময় লেগেছে ১৫ দিন। ২৫ অক্টোবর পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণে ফাইল যায় মহাপরিচালকের দফতরে। আর তৎকালীন মহাপরিচালক জাহাঙ্গীর কবীর এই তদন্ত রিপোর্ট অনুমোদন করতে সময় নেন ৫৪ দিন। ১৮ ডিসেম্বর তদন্ত রিপোর্টের ফাইলে স্বাক্ষর করেন পাউবোর এই শীর্ষ কর্মকর্তা। এরপর ২০ ডিসেম্বর পাউবো থেকে আলোচ্য এই নথিটি পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে তদন্ত রিপোর্ট সেগুনবাগিচা দুর্নীতি দমন কমিশনে পাঠাতে সময় লাগে ৬২ দিন। এ বছর ২০ ফেব্রুয়ারি তদন্ত রিপোর্টটি দুদকে পাঠানো হয়।
এদিকে দীর্ঘ দশ মাস পর তদন্ত রিপোর্ট সম্পর্কে অবহিত করায় ক্ষেপে যায় দুর্নীতি দমন কমিশন। এ বছরও সেই সুনামগঞ্জের হাওর রক্ষা বাঁধে একই দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে আবারও আলোচনায় আসে পাউবোর স্থানীয় প্রকৌশলী ও কর্মকর্তারা। এ সময় গত বছরের অভিযোগের তদন্ত রিপোর্ট পর্যালোচনার উদ্যোগ নেয় দুদকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তদন্ত রিপোর্ট পর্যালোচনা করে দুদক কর্মকর্তারা দেখতে পায় পাউবোর তদন্ত কমিটি হাওর রক্ষা বাঁধ নির্মাণে কোনো দুর্নীতি-অনিয়মের সন্ধান পায়নি। বাঁধ ভেঙে হাওরের ফসল তলিয়ে যাওয়ার জন্য ইঁদুরের গর্তকে দায়ী করে প্রতিবেদন দেয়া হয়। প্রায় ১০ মাস পর তদন্ত রিপোর্ট দেয়ার বিষয়টিও দুদক কর্মকর্তাদের দৃষ্টিগোচর হয়। এক পর্যায়ে ১ জুন এই প্রতিবেদন প্রেরণে দীর্ঘ সময়ক্ষেপণের পেছনে জড়িত কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে দুদক কার্যালয়কে অবহিত করতে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে পত্র দেয়। পরবর্তীকালে তদন্ত প্রতিবেদন পাঠাতে সময়ক্ষেপণের বিষয়ে দায়ী কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করার নির্দেশ দেয় পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। এরপর ২ জুলাই পাউবোর অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. মোসাদ্দেক হোসেনকে এ বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়। তিনি কোন কোন দফতরে ২৭৯ দিন সময় নেয়া হয় তার বিস্তারিত তদন্ত রিপোর্টে উল্লেখ করে চারজন কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে চিহ্নিত করেন। তারা হলেন- পাউবোর শৃঙ্খলা পরিদফতরের পরিচালক একেএম নজরুল ইসলাম খান, একই পরিদফতরের উচ্চমান সহকারী মো. ফায়েকুজ্জামান, অতিরিক্ত মহাপরিচালকের (প্রশাসন) দফতরের সহকারী পরিচালক মো. কোরবান আলী শেখ ও একই দফতরের ডিইও তাহমিনা আক্তার মিলি। ২৭৯ দিন সময়ক্ষেপণের জন্য তাদের দায়ী করে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়। কিন্তু তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের কৌশলে আড়াল করা হয়েছে।

http://www.jugantor.com/last-page/2017/09/06/153107