৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭, বুধবার, ৮:৫৯

কয়েক শ’ বছর আরাকানের মুদ্রায় লিখিত ছিল আরবি কালিমা

রোহিঙ্গাদের রক্ত ঝরার ইতিহাস-৪

হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে আরাকান ছিল প্রাচুর্যে ভরপুর একটি উন্নত জনপদ। দ্বিতীয় ওমর হিসেবে পরিচিত খলিফা ওমর বিন আবদুল আজিজ, বাগদাদের খলিফা মামুনসহ অন্যান্য খলিফার সাথে যোগাযোগ ছিল আরাকানী শাসকদের। খলিফাদের কাছে আরাকান রাজাদের লিখিত চিঠিতে জানা যায়, এক হাজার পূর্বপুরুষ বংশপরম্পরায় আরাকান শাসন করে আসছেন এবং তাদের রাজ প্রাসাদে এক হাজার পূর্বপুরুষের জহরতের মুকুট সংরক্ষিত আছে। এ ধরনের আরো অনেক প্রাচুর্যের বিবরণ রয়েছে সেসব চিঠিতে। কয়েক শ’ বছর ধরে আরাকানের মুদ্রায় আরবি হরফে লিখিত ছিল মুসলমানদের কালিমা। কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত আরাকানের সরকারি ভাষা ছিল ফার্সি।

কিন্তু গত দেড় হাজার বছর ধরে আরাকানের যে লিখিত ইতিহাস পাওয়া যায় তাতে দেখা যায় শেষ কয়েক শতক ধরে আরাকানের ইতিহাস রক্ত ঝরার ইতিহাস আর লুটপাটের ইতিহাস। আরাকানের প্রাচুর্য কারা লুট করেছে? পলাশীর পরাজয়ের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক যেমন বাংলার মূল্যবান রতœভাণ্ডার জাহাজ বোঝাই করে বিলাতে পাচারের ইতিহাস জানা যায় তেমনি বর্মী রাজা কর্তৃক ১৭৮৪ সালে আরাকান দখলের পরও আরাকান লুটের কথা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে। এর বহু শত বছর আগে ১৪০৬ সালসহ বিভিন্ন সময়ে বর্মী রাজা কর্তৃক আরাকান আক্রমণের শিকার হয়।

আরাকান দখলের পর রাজা ভোদাপায়া আরাকানের মূল্যবান সামগ্রী তখনকার বার্মার রাজধানী আভায় নিয়ে যাওয়ার জন্য অনেক আরাকানীদের নিয়োগ করে। গভীর জঙ্গলের পথে ভারী মালামাল বহনের সময় অনেক আরাকানী মৃত্যুবরণ করেন।
আরাকানে চন্দ্রবংশীয় রাজবংশের ঐতিহাসিক উপাখ্যান রদজাতুয়ের উল্লেখ অনুসারে রাজা মহত ই চন্দ্রের রাজত্বকালে (৭৮৮-৮১০) একটি আরবীয় বাণিজ্য বহর দুর্ঘটনার কবলে পড়ে আরাকান উপকূলে আশ্রয় নেয়। রাজা মহত ই চন্দ্র নাবিকদের দক্ষতা ও অন্যান্য গুণে মুগ্ধ হয়ে তাদের আশ্রয় দেন। নাবিকেরা বাণিজ্য পেশা পরিত্যাগ করে আরকানী রমণীদের বিয়ে করে এখানে থেকে যান স্থায়ীভাবে। এই দলটির মাধ্যমেই আরাকানে মুসলমানদের আগমন ঘটে বলে কোনো কোনো ইতিহাস বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছে।

অন্য দিকে ৮৫১ সালে আরব ভূগোলবিদ সুলায়মান লিখিত ‘সিলসিলাত উত তাওয়ারিখ’ গ্রন্থে বঙ্গোপসাগরের তীরে রুহমী অঞ্চলের পরিচয় উল্লেখ করেছেন। অনেকেই এই রুহমীকে বর্তমান রোহিঙ্গা বসবাসকারী আরাকান বলে মনে করেন।
আবার অনেকের মতে এরও অনেক আগে এখানে মুসলমনাদের আগমন ঘটে। পারস্য দেশের লোকজনই আকিয়াব বন্দরের গোড়াপত্তন করে। এ শব্দটিও ফার্সি। ১৮২৪ সালে পুরো বার্মা ইংরেজদের দখলে আসার আগ পর্যন্ত কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত আরাকানের প্রশাসনিক ভাষা ছিল ফার্সি। ইংরেজরা বার্মা দখলের পর আরাকানেও ইংরেজি চালু হয়। ইতিহাসে এটা স্পষ্ট যে, সুপ্রাচীনকাল থেকে আরবদের সাথে আরাকানীদের যোগাযোগ ছিল। সপ্তম ও অষ্টম শতকে আরাকানে মুসলমানদের বসবাস ছিল। সপ্তম-অষ্টম শতকের আরবীয় ভৌগোলিক ইতিহাসবিদদের লেখায় ‘রুহমী’ নামক একটি রাজ্যের পরিচয় পাওয়া যায়। অনেকের মতে এটিই বর্তমান আরাকান রাজ্য। রুহমী রাজাদের সাথে বাগদাদের আব্বাসীয় খলিফাদের যোগাযোগের প্রমাণ রয়েছে ইতিহাসে। মুসলিম স্পেনের পি ত ইবনে আবদু রব্বি ‘আল এখদুল ফরিদ’ বইয়ে রুহমী রাজা কর্তৃক ওমর বিন আবদুল আজিজের কাছে লেখা একটি চিঠির অনুলিপি তুলে ধরেছেন। চিঠিতে লেখা হয় হিন্দের বাদশাহর মধ্যে রুহমী রাজ্যের বাদশাহ এমন এক পুরুষ, যার এক হাজার পূর্বপুরুষ বংশপরম্পরায় এ রাজ্যের শাসক ছিলেন, যার স্ত্রীও এই বংশের হাজার বাদশাহর কন্যা। এই বাদশাহর হাতিশালে রয়েছে হাজার হাজার হাতি। যার রাজপ্রাসাদের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে এমন দু’টি নহর, যে নহরদ্বয়ের উদগাছসহ আরো এমন গাছ শোভা পায়, যার ফলে নহরের সুঘ্রাণ ১২ মাইল পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। এই বাদশাহর পক্ষ থেকে ওই বাদশাহর কাছেই চিঠি পাঠানো হচ্ছে, যে বাদশাহ আল্লাহর সাথে কোনো কিছু শরিক করে না। এ চিঠি একটি শুভেচ্ছার নিদর্শনস্বরূপ পাঠানো হলো এ আশা নিয়ে যে, আপনি আমাদের কাছে আপনার পক্ষ থেকে এমন কিছু লোক পাঠাবেন যারা আমাদের ইসলাম শিক্ষা দেবেন এবং আল্লাহ সম্পর্কে সঠিক ধারণা দেবেন।

কাজী রশিদ বিন যোবায়ের (মৃত্যু ৪৬৩ হিজরি) লিখিত ইতিহাস গ্রন্থ ‘কিতাবুস যাখায়ের ওয়াত তোহাফ’ এ রুহমী রাজা কর্তৃক বাগদাদের খলিফা মামুনের কাছে লেখা একটি চিঠি উল্লেখ করেছেন। চিঠিতে রুহমী রাজা লিখেছেন, রুহমীর পক্ষ থেকে, যিনি হিন্দের বাদশাহ, যিনি স্বর্ণকুঠির মালিক; যে কুঠির খুঁটি ইয়াকুত পাথরের তৈরি এবং যে কুঠির বিছানা মুক্তা দিয়ে তৈরি, যে বাদশাহর বালাখানার প্রতিটি দেয়াল উদগাছের, যেখানে কোনো কিছুর ছাপ পড়লে মোমের ওপর সিলমোহরের মতো অঙ্কিত হয়, যে বাদশাহর খাজাঞ্চিখানায় এক হাজার পিতৃপুরুষের জহরতের মুকুট রয়েছে, যা আমার এক হাজার পূর্বপুরুষ রাজ্য শাসনকালে তৈরি করেছিলেন, আমি রুহমী রাজ্যের সেই বাদশাহ যে বাদশাহকে এ দেশের প্রধান ধর্মগুরু কুর্নিশ করে, যে বাদশাহর খাজাঞ্চিখানায় দশ লাখ মিসকান স্বর্ণের মজুদ রয়েছে, এই বাদশাহর আস্তাবলে এক হাজার সাদা হাতি রয়েছে। প্রজার প্রতি ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত করতে এই বাদশা অত্যন্ত যতœবান।

রাজা ভোদাপায়া ১৭৮৪ সালে আরাকান দখলের সময় আরাকানের বিচার ব্যবস্থা ছিল ইসলামি নিয়মনীতির আদলে। রাজা ভোদাপায়া আরাকানের বিচার ব্যবস্থা ও নিজস্ব মুদ্রা দেখে বিস্মিত হন। কারণ আরাকানের তুলনায় তখনকার বার্মা ছিল অনেক পেছনে। ইতিহাসের বর্ণনা অনুযায়ী তখনো বার্মার নিজস্ব কোনো মুদ্রা ছিল না। তাই আরাকানের আদলে বার্মায় বিচার ব্যবস্থা ও নিজস্ব মুদ্রা চালুর জন্য রাজা ভোদাপায় তিন হাজার সাত শ’ মুসলমানকে আভায় নিয়ে যান।
আগে থেকেই মুসলিম শাসন ব্যবস্থা ও সংস্কৃতির সাথে সম্পর্কের কারণে সমৃদ্ধ আরাকান আবার মুসলিম সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসে বাংলার সুলতানী আমলে। বৃহত্তর বাংলার সুলতান জালালুদ্দীন শাহ ১৪৩০ সালে আরাকান থেকে দখলদার বর্মী রাজাকে উৎখাত করে নরমিখলাকে ক্ষমতায় বসানোর মাধ্যমে আরাকানে সভ্যতার নবযাত্রা শুরু হয়। ১৪৩১ থেকে ১৫৩০ পর্যন্ত এক শ’ বছর আরাকান রাজারা গৌড়ের সুলতানদের কর দিতেন এবং মুসলিম উপাধি ধারণ করে রাজ্য পরিচালনা করতেন ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হলেও।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/249493