৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭, মঙ্গলবার, ৯:৫২

বিড়ম্বনামুক্ত কোরবানির ধারণা

সুশাসন

ইকতেদার আহমেদ

মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। আমাদের দেশের মুসলিম জনমানুষের কাছে ঈদুল ফিতর রোজার ঈদ নামে সমধিক পরিচিত। অপর দিকে ঈদুল আজহা কোরবানির ঈদ নামে অভিহিত। কোরবানির পশু সাধারণত গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ, উট ও দুম্বা হয়ে থাকে। ঈদুল আজহায় সামর্থ্যবান মুসলমানেরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে গরু অথবা ছাগল আল্লাহর উদ্দেশ্যে কোরবানি করে থাকেন। কোরবানির পশু হিসেবে ভেড়া ও মহিষের ব্যবহার তুলনামূলক কম। অনেক মুসলিম দেশে ব্যাপক হারে উট ও দুম্বা দিয়ে কোরবানির কাজ সমাধা করা হয়। যে ব্যক্তির ওপর জাকাত ফরজ, তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব। কোরবানির পশু ঈদুল আজহার নামাজ আদায়ের পর জবাই করতে হয়।

আর্থিক সঙ্গতিসম্পন্ন প্রত্যেক মুসলমানকে কোরবানি করতে হয়। এটি আল্লাহর বিধান। শুধু গোশত বা রক্তের নাম কোরবানি নয়, বরং আল্লাহর নামে সর্বস্ব বিলিয়ে দেয়ার এক আন্তরিক শপথের নাম কোরবানি। কোরবানির মাধ্যমে মুসলমানের ঈমান ও তাকওয়ার পরীক্ষা হয়ে থাকে। আর এ তাকওয়াই হচ্ছে কোরবানির প্রাণশক্তি। আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে কোরবানির যে পশু জবাই করা হয় তার রক্ত বা গোশত আল্লাহ পাকের কাছে না পৌঁছলেও পশু কোরবানির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি যদি নিজেকে সব ধরনের পঙ্কিলতা ও অন্যায় থেকে মুক্ত করতে পারে, তখন তার কোরবানি হয় সার্থক। কোরবানি দেয়া পশুর গোশত কোরবানিদাতা নিজে পরিবারসমেত খাওয়ার জন্য সম্পূর্ণ রাখতে পারেন অথবা তিন ভাগের এক ভাগ নিজের ও পরিবারের জন্য রেখে অবশিষ্ট দুই ভাগের অর্ধেক আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের মধ্যে এবং অপর অর্ধেক দরিদ্রদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে পারেন। তবে তিন ভাগের এক ভাগ নিজেদের জন্য রেখে অবশিষ্টটুকু বিলিবণ্টন করাই উত্তম।

আমাদের দেশে কোরবানি করার জন্য জবাইখানা ও দৃষ্টির আড়াল হয়, এমন পর্যাপ্ত স্থান না থাকায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে লোকালয়ের মধ্যে বাড়ির আঙিনায় অথবা বাড়ির সামনের সড়কে কোরবানি করা হয়। এতে দেখা যায়, পশু জবাইয়ের কাজটি শিশু ও মহিলাদের সামনে বা দৃষ্টির মধ্যে সম্পন্ন হয়। শিশু ও মহিলাদের সামনে পশু জবাই করা হলে তা তাদের অনেককে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করতে পারে। আর এ কারণে জবাই কাজটি সমাধা করার সময় এদের দৃষ্টির আড়ালে করাই শ্রেয়। হজরত ইব্রাহিম আ: আল্লাহর আদেশ পেয়ে যখন নিজপুত্র হজরত ইসমাইল আ:কে কোরবানি করার জন্য মনস্থির করলেন, তখন তিনি তাকে নিয়ে লোকালয় থেকে অনেক দূরে জনমানবহীন পাহাড়ে গিয়েছিলেন। আল্লাহর নির্দেশে হজরত ইসমাইলের পরিবর্তে যদিও একটি পশু কোরবানি হয়েছিল, কিন্তু কাজটি সমাধা হয়েছিল লোকালয় থেকে দূরে জনমানবহীন এলাকায়। এর দ্বারা প্রতীয়মান হয়, কোনো পশু কোরবানির কাজ জনমানুষ বিশেষত মহিলা ও শিশুদের দৃষ্টির বাইরে সম্পন্ন হওয়া আল্লাহ পাকের কাছে পছন্দনীয়।

কোরবানির পশুর রক্ত ও সমজাতের পশুর রক্ত খাওয়া ইসলাম ধর্ম মতে মানুষের জন্য হারাম। পশুর রক্তে অনেক দূষিত পদার্থ থাকে। আর তাই লোকালয়ে বা বাড়ির আঙিনায় উন্মুক্ত মাটি অথবা ঘাস দিয়ে আচ্ছাদিত স্থানে পশু জবাই করা হলে জবাই করা স্থানে রক্ত জমাট বেঁধে পরে উৎকট দুর্গন্ধের সৃষ্টি করে। সরকারের স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে শহরাঞ্চলের নির্ধারিত স্থানে কোরবানির কাজ সমাধার জন্য জনসাধারণের কাছে আবেদন করা হলেও তা বহুলাংশেই উপেক্ষিত হয়েছে। তা ছাড়া বিগত দুই দশকের মধ্যে এ বছরই ঈদুল আজহার নামাজের সময় ও নামাজ-পরবর্তী দুপুর অবধি বৃষ্টি অব্যাহত ছিল। বিভিন্ন স্থানীয় কর্তৃপক্ষ শহরগুলোর নির্ধারিত স্থানে কোরবানির যে ব্যবস্থা করেছিল তাতে বৃষ্টির কথা মাথায় রেখে স্থানগুলোর উপরিভাগে কোনো ধরনের ছাউনির ব্যবস্থা করা হয়নি। আর তাই নির্ধারিত স্থানে কোরবানি দেয়ার জন্য অনেকের আগ্রহ থাকলেও ছাউনি না থাকায় সে আগ্রহে ভাটা পড়ে।

লোকালয়ের মধ্যে বর্জ্য অপসারণের যথাযথ ব্যবস্থা নেই যত্রতত্র এমন স্থানে পশু কোরবানি করা হলে তা পরিবেশে মারাত্মক দূষণ সৃষ্টি করে। এরূপ দূষণ জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। আমাদের দেশে বিভিন্ন স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কোরবানির পশুর বর্জ্য অপসারণের ঘোষণা দিলেও তারা সব ক্ষেত্রে সফলকামÑ এ কথা বলা যাবে না। তা ছাড়া শহরের নির্ধারিত বর্জ্য ফেলার স্থান থেকে এ বর্জ্যগুলো নিয়ে চূড়ান্তভাবে যেখানে ফেলা হয় তা শহরের সন্নিকটে ও উন্মুক্ত হওয়ায় পরিবেশের ক্ষতির দিক এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না।

পৃথিবীর সব উন্নত দেশে এবং অনেক মুসলিম দেশে পশু জবাইয়ের কাজ জবাইখানায় সম্পন্ন হয়। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা প্রভৃতি অমুসলিম দেশ হলেও সেসব দেশে জবাইখানায় হালালভাবে পশু জবাইয়ের ব্যবস্থা আছে। সেসব দেশে বসবাসরত ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা পশু ক্রয়, জবাই ও কাটাকাটিসংক্রান্ত যাবতীয় কাজ কসাইখানাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের দিয়ে থাকেন এবং তারা দায়িত্বপ্রাপ্ত হওয়ার পর যাবতীয় কাজ সুচারুরূপে সম্পন্ন করে গোশত সুন্দর মোড়কে আবৃত করে সরবরাহের ব্যবস্থা করেন। সাধারণত দেখা যায়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জবাই করা পশুর গোশত ঈদের পরদিন সরবরাহের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়।
মুসলমানদের পুণ্যভূমি মক্কা নগরীতে ঈদুল আজহার সময় হজ সংশ্লেষে বিপুল পশু কোরবানি করা হয়। অতীতে এসব পশু জবাই-পরবর্তী কোরবানিদাতার পক্ষ থেকে পশুগুলোর সামান্য অংশ খাওয়ার জন্য রেখে অবশিষ্ট অংশ বুলডোজারের মাধ্যমে মাটিচাপা দেয়া হতো। কয়েক বছর ধরে সেখানে আধুনিক জবাইখানা স্থাপনের কারণে এ অপচয় রোধ সম্ভব হয়েছে। এখন জবাই করা পশুর অবশিষ্টাংশ বিভিন্ন মুসলিম দেশের দরিদ্র মানুষের মধ্যে সৌদি সরকার ও সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সরকারের বিশেষ ব্যবস্থায় বিলিবণ্টন করা হয়।
পৃথিবীর যেসব দেশে জবাইখানা রয়েছে, সেসব দেশে জবাই করা পশুর কোনো কিছুই ফেলে দেয়া হয় না। এগুলোর গোশত খাওয়া হয়, রক্ত ও নাড়িভুঁড়ি দিয়ে মাছ ও হাঁস-মুরগির খাদ্য প্রস্তুত করা হয়, নাড়িভুঁড়ির অভ্যন্তরের বর্জ্য জৈবসার প্রস্তুতে ব্যবহার করা হয়, হাড় ও শিং ওষুধের ক্যাপসুলের খোলস এবং মাছ ও হাঁস-মুরগির খাদ্য তৈরিতে ব্যবহার হয় এবং চামড়া জুতা, স্যান্ডেল, ব্যাগ, জ্যাকেট, ব্লেজার প্রভৃতি প্রস্তুতে ব্যবহার হয়।
মুসলিম দেশ হিসেবে আমাদের দেশে সারা বছরই ব্যাপক পশু জবাই করা হয়। আমাদের দেশে বছরব্যাপী যে পশু জবাই হয়, তা-সহ কোরবানির ঈদের সময় জবাই করা পশুর বেশির ভাগ দেশীয় পদ্ধতিতে অনভিজ্ঞ ব্যক্তিদের দিয়ে জবাই, চামড়া ছাড়ানো ও কাটাকাটির কাজ সম্পন্ন করায় এগুলোতে ত্রুটি থেকে যায়; যা গোশত ও চামড়ার গুণগতমানের জন্য ক্ষতিকর।
কোরবানির ঈদের সময় হাট থেকে পশু কিনে বাড়ির আঙিনায় দু-তিন দিনের জন্য রাখা, পশু জবাই ও কাটাকাটি সংশ্লেষে প্রচুর শ্রমের প্রয়োজন হয়। শহরে বসবাস করে, এমন অনেক নাগরিকের পক্ষে এ ধরনের শ্রম দেয়া বেশ দুরূহ। এদের একটি অংশ নির্ঝঞ্ঝাটে কোরবানির কাজ সমাধার জন্য তা জবাইখানার মাধ্যমে সম্পন্ন করতে আগ্রহী। আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত এ ধরনের কাজ করার জন্য একটি বড় ধরনের স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানের কারখানা রাজধানী শহরবহির্ভূত জেলায় অবস্থিত। এ বছর যারা এ প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে কোরবানির কাজ সমাধা করেছেন, তাদের জবাই করা পশুর গোশত ঈদের পরদিন অথবা এর পরদিন সংস্থাটির ঢাকার কার্যালয়ে সরবরাহের জন্য প্রস্তুত ছিল।
কোরবানির পশুর গোশত উৎকৃষ্ট আমিষ। আমাদের দেশে এমন অনেক মানুষ রয়েছেন, যাদের নিয়মিত আমিষ গ্রহণের সুযোগ কম, তাদের জন্য কোরবানির সময় এটি অবারিত হয়ে যায়। তবে বিশেষত শহরে খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যে এমন অনেকে রয়েছেন, যাদের গোশতপ্রাপ্তির পরিমাণ প্রয়োজনাতিরিক্ত; এদের একটি অংশ সামান্য গোশত রেখে অবশিষ্ট অংশ নগণ্য মূল্যে বিক্রি করে দেয়। আবার কোরবানি দেয় না, এমন অনেক মানুষ ও অনেক হোটেল ব্যবসায়ী এ সময় কমমূল্যে গোশত কিনে আর্থিকভাবে লাভবান হতে সচেষ্ট থাকে।

দেশে আধুনিক জবাইখানার অনুপস্থিতিতে লোকালয়ে যেখানে সেখানে উন্মুক্ত স্থানে নারী ও শিশুদের দৃষ্টিসীমার মধ্যে কোরবানির পশু জবাই করায় এর পরিবেশগত ক্ষতি ও মানসিক বিপর্যয় থেকে আমরা নিরাপদ নই। আমাদের কোরবানির পশু জবাই, চামড়া ছাড়ানো ও কাটাকাটি আধুনিক জবাইখানার মাধ্যমে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে করতে পারলে এর এমন কিছু অবশিষ্ট থাকবে না, যার উপকার থেকে আমরা বঞ্চিত হব। আধুনিক কসাইখানা ও দক্ষ জনবলের অভাবে আমরা পৃথিবীর উন্নত রাষ্ট্রের মতো কোরবানির পশুর সর্বাত্মক উপযোগিতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। এ বছর নামাজ-পরবর্তী বৃষ্টি হওয়ায় পশু জবাই, চামড়া ছাড়ানো, কাটাকাটি, বর্জ্য অপসারণ প্রতিটি কাজই বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এমন বিপর্যয় ভবিষ্যতেও হতে পারে। সে কথা চিন্তা করে এবং সার্বিকভাবে দেশের মানুষ, পরিবেশ ও অর্থনীতির বিষয় মাথায় রেখে আমরা যত দ্রুত লোকালয়ে জবাইয়ের ব্যবস্থা পরিহার করব, তত দ্রুতই আমরা এর সুফল ভোগে সক্ষম হব।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
E-mail: iktederahmed@yahoo.com

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/249164