৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭, সোমবার, ১০:১৩

‘সন্তানদের মুখের দিকে তাকাতে পারি না, খাবার নাই, ঈদ হবে কীভাবে?’

বাংলাদেশের ৩২ জেলার প্রায় এক কোটি মানুষ বন্যায় প্রায় নিঃস্ব হয়ে গেছেন। একবেলা এক মুঠো খাবারের জন্য হাহাকার করছেন বন্যা দুর্গতরা। এবারের ঈদুল আজহায় তাই তাদের মনে নেই কোন আনন্দ। বেঁচে থাকাটাই এখন তাদের জন্য বড় দায়।
বাংলাদেশের উত্তরের জেলা কুড়িগ্রামের সদর উপজেলার ঘোগাদহ ইউনিয়নের চৈতার খামার গ্রাম। ধরলা নদীর তীরে এই গ্রামের মোটামুটি সম্পন্ন কৃষক মোহাম্মদ ইব্রাহিম। ছয় বিঘা কৃষি জমি ছাড়াও তার নিজের বাড়ি ছিল। গত ঈদুল আজহায় কোরবানি দিয়েছেন। কিন্তু এবার তিনি নিঃস্ব। কোরবানিতো দূরের কথা সামনের সংকট কীভাবে সামাল দেবেন সেই চিন্তায় দিশেহারা তিনি। ‘‘আমার ছোট ছোট ছেলে-মেয়ের চোখের দিকে তাকাতে পারি না।
ওরাতো আর বোঝে না। গতবারও গরু কোরবানি দিয়েছি। এবারতো ঘরে খাবারই নাই। কোরবানি দেব কীভাবে? '' আহাজারি ইব্রাহিমের।
তিনি জানালেন তাঁর জমির সব ফসল ভেসে গেছে। এতদিন বাঁধের ওপর ছিলেন। পানি কমার পর ফিরেছেন বাড়িতে। কিন্তু ভাঙ্গা ঘর মেরামত করতে পারছেন না। জমিতে নতুন ফসল বুনতে বীজ লাগবে, সেটা কেনার টাকা নেই। ধার দেনা করে দু'মুঠো খাবার জোগাড় করছেন। কিন্তু সরকারের কোনো সহায়তা নেই। অনেকে ধারও দিতে চায় না। কেননা তার মত অনেক মানুষই বন্যায় সব হারিয়েছে। কত মানুষকে আর ধার দেবে তারা! ইব্রাহিমের কাছ থেকে জানা গেলো তাদের গ্রামের শতাধিক পরিবার বন্যায় নিঃস্ব হয়ে গেছে। এখানে ঈদের আনন্দ নাই। আছে কষ্ট আর দীর্ঘশ্বাস।

ঘোগাদহ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়াম্যান শাহ আলম জানালেন, ‘‘বন্যায় এই এলাকার চরম ক্ষতি হয়েছে। অনেক অবস্থাপন্ন পরিবারও পথে বসে গেছে। আমরা আমাদের সাধ্যমত তাদের সহায়তার চেষ্টা করছি। সরকারও কিছু ত্রাণ সামগ্রী দিয়েছে। তবে যে ক্ষতি হয়েছে, এই সামান্য সহায়তা তার তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল। অনেক পরিবারেই এবার ঈদের আনন্দ নেই। ''
উত্তরের আরেক জেলা নীলফমারীর ডিমলা উপজেলার ধানিসেন চরের হামিদুল ইসলাম এখনো বাঁধের ওপর বসবাস করছেন। বন্যায় ঘরবাড়ি ভেসে যাওয়ায় সেই যে বাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন পরিবার পরিজন নিয়ে এখনো সেখানেই থাকতে হচ্ছে তাঁকে। বললেন, ‘‘পানি কমে গেছে। কিন্তু ফিরবো কোথায়? বাড়ি ঘরতো আর নাই। বাঁধের ওপর কত দিন থাকতে হবে তাও জানি না। ঘর তুলবো তার জন্য টাকা কোথায় পাব?''

কোরবানির কথা জিজ্ঞেস করতেই দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে ওঠেন, ‘‘খাবারই জুটছে না, আবার কোরবানি! এই বাঁধে প্রায় ৫০টি পরিবার আমরা। আমাদের কেউ খোঁজও নেয় না। চেয়ারম্যান-মেম্বারদের দেখা নাই। ঈদ যে এসেছে তাও আমাদের মাথায় নাই। ''
হামিদুল ছোটখাট ব্যবসা করতেন। বন্যায় সেই ব্যবসাও বন্ধ। দোকান ঘরটিও বন্যায় ভেসে গেছে। বললেন, ‘‘পরিবার পরিজন নিয়ে ভালোই ছিলাম। কিন্তু এখন সামনে শুধু অন্ধকার দেখছি। কোরবানির মাংস এবার আমাদের কপালে নাই। সন্তানরাও বুঝে গেছে। তাই ওরাও কিছু বলে না। ''
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে ৩০শে আগস্ট রাত ৮টা পর্যন্ত দেশের মোট ৬৪ জেলার মধ্যে ৫০ শতাংশ অর্থাৎ ৩২ জেলা বন্যা কবলিত হয়েছে। এ সব জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মোট সংখ্যা ৭৪ লাখ ৮২ হাজার ৬৩৭ জন। বন্যার পানিতে ১০ হাজার ৫৮৩ হেক্টর ফসলি জমি সম্পূর্ণ এবং ৬ লাখ ৫৮৭ হেক্টর জমি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এবারের বন্যায় ১৩২ জনের মৃত্যু হয়েছে। ৬ লাখ ৬২ হাজার ১৫৬টি বসতভিটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ৭৫ হাজার ৩৩১টি ঘর সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গেছে।
মজুদ সংকটের কারণে এবার ঈদুল আজহায় ভিজিএফ (ভার্নারেবল গ্রুপ ফিডিং) কর্মসূচি বন্ধ রয়েছে। ফলে এই কর্মসূচির আওতায় তালিকাভুক্ত দেশের ৮৮ লাখ গরিব পরিবার এবারের কোরবানির ঈদে সরকারি এই সহায়তা পাচ্ছেন না। সরকারের এই কর্মসূচির আওতায় সুবিধাভোগী তালিকা অনুযায়ী প্রতিটি পরিবারকে বিনা মূল্যে প্রতি ঈদের সময় বছরে দুইবার ২০ কেজি করে চাল সহায়তা দেয়া হত।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব শাহ কামাল ভিজিএফ কর্মসূচি বন্ধের কথা স্বীকার করেন বলেন, ‘‘এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়। খাদ্য মন্ত্রণালয় যদি চাল বরাদ্দ না দেয় তাহলে দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবে কীভাবে? তবে অন্য কর্মসূচি যথানিয়মে চলবে। ''
সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চলের মানুষের অবস্থাও করুন। তাহেরপুর বাদাঘাট এলকার জয়পুর স্কুল-এর শিক্ষক নূরে আলম ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘এবার ঈদে ওই এলাকার দরিদ্র মানুষ ভিজিএফ-এর চাল পাচ্ছে না। ঈদের সময় কিছু নগদ টাকা দেয়ার কথা বলেছিল সরকার। কিন্তু তা দেয়নি। এখানকার মানুষ শুধু আটা খেয়ে বেঁচে আছে। কোরবানি দেয়ার প্রশ্নই আসে না। পুরো গ্রামে মাত্র একটি গরু কোরবানি হচ্ছে। ''

ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক হাদিউজ্জামান বলেন, ‘‘আমিসহ কয়েকজন মিলে একটি গরু ভাগে কোরবানি দিচ্ছি ধর্মীয় নিয়ম পালনের কারণে। কিন্তু আমাদেরও কোরবানি দিতে ভাল লাগছে না। এই মাংস আমরা খেতে পারব না। আমাদের চারপাশে এত অভুক্ত মানুষ। অনেকেই খাবার পায় না। এমনিতেই হাওর এলাকার মানুষ দরিদ্র। আর বন্যার কারণে তারা এখন বলতে গেলে নিঃস্ব। সরকারী কোন সহায়তাও নেই। এরা বড় কষ্টে আছে। এখানে ঈদের আনন্দ নেই, বেঁচে থাকাই দায়। ''
- ডিডাব্লিউ

http://www.kalerkantho.com/online/national/2017/09/03/538932