নিহত দম্পতি
৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭, সোমবার, ১০:০৭

নো-ম্যান্স ল্যান্ডের এক দম্পতি যেভাবে গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেল

ঈদের দিনেও নাফনদীর ওপারে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী গ্রাম ঢেঁকিবনিয়া ও ওয়াচিপং বেপরোয়া গুলি বর্ষণ করেছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। এই সময় তাদের গুলিতে ঘটনাস্থলে নিহত হয়েছে এক রোহিঙ্গা দম্পতি। ঈদের শনিবার বিকেল ৫টার সময় অন্যান্য মালামাল নিয়ে আসার সময় এই ঘটনা ঘটে। হত্যাকাণ্ডের শিকার রোহিঙ্গা দম্পতি হলেন ঢেঁকিবনিয়া ইউনিয়নের জাফর উল্লাহ (৩০) ও স্ত্রী আয়েশা খাতুন (২৬)। গত কয়েক দিন ধরে এ দম্পতি নো-ম্যানস ল্যান্ডে ছিলেন।
সীমান্তের প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, সকাল ১১টার দিকে উক্ত ঢেঁকিবনিয়া এলাকায় দেখা গেছে আগুনের ধোঁয়া। এসময় সীমান্তের খুব কাছে গোলাগুলির শব্দও শোনা গেছে। নো-ম্যানস ল্যান্ডে তাদের সাথে থাকা অন্য এক রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন,‘জাফর ও আয়েশা একটি ছোট শিশু নিয়ে দীর্ঘ গত কয়েকদিন ধরে নো-ম্যানস ল্যান্ডে ছিলেন। সঙ্গে থাকা খাবার শেষ হয়ে যাওয়ায় ঈদের দিন সকালে বাড়িতে গিয়ে তারা হত্যার শিকার হন।

ঢেঁকিবনিয়ায় বসবাসরত আজিজ উল্লাহ নামে আর এক রোহিঙ্গা বলেন, ‘সীমান্তের অভ্যন্তরে কাঁটাতারের ১ শ’ গজের মধ্যে জাফর ও আয়েশার বাড়ি। ঈদের দিন এসে মালামাল নিয়ে প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয়ের জন্য নো-ম্যাস ল্যান্ডে আসার সময় এই দম্পতিকে প্রথমে গুলি ও পরে গলাকেটে তাদের হত্যা করে সেনাবাহিনী। পরে জিরো পয়েন্টে অবস্থানকারী নিহতের নিকত্মীয় কয়েকজন যুবক মৃতদেহ উদ্ধার করে সীমান্তে নিয়ে আসে।

এছাড়া মংডু, বুথিদং, রাথিদং বৃহৎ ৩ জেলায় কোথাও ঈদ-উল আযহার নামাজের জামায়াত অনুষ্ঠিত হয়নি।রোহিঙ্গাদের কয়েকটি সুত্র জানিয়েছে, যেসব এলাকায় সেনাবাহিনী তান্ডব অব্যাহত রেখেছে সেইসব এলাকার রোহিঙ্গারা জানে না শনিবার ঈদ-উল-আযাহা। এইসব এলাকার রোহিঙ্গারা চরম আতংক, উৎকন্ঠা ও শঙ্কায় নিরাপদ আশ্রয়ের ছুটেছেন সীমান্তের দিকে।
সীমান্তের ওপারের বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ঈদের দিন শনিবার সকাল ১০টার দিকে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কিছু লোক নিয়ে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর একটি দল রাখাইন রাজ্যের ঢেঁকিবনিয়া এলাকায় ঢুকে বিভিন্ন মসজিদ ও মাদ্রাসায় অভিযান শুরু করে। এক পর্যায়ে জনশূন্য কয়েকটি গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেয়। ঈদের নামাজের সময় এমন ঘটনা ঘটায় অনেকেই নামাজ ছেড়েই ছোটাছুটি করতে থাকেন। এসময় রোহিঙ্গাদের বড় একটি অংশ চলে আসেন নো-ম্যানস ল্যান্ডে।

পালিয়ে আসা রোহিঙগারা জানিয়েছেন, ঢেঁকিবনিয়া ইউনিয়নের চাকমাকাটা গ্রামের ইদ্রিস বাড়ি, ফকিরপাড়া গ্রামের মৌলভী হোসেন আহমদের বাড়িসহ ছয়টি ঘরে আগুন দেওয়া হয়। এছাড়াও মংডুর বলিবাজার, আয়াচর, কিয়ামং, জুম্বাই, নরিক্যাং, শীলখালী, বালুখালী,এবং বুথিঢং, রাথিঢং, জেলার কৈয়ারবিল, নাইচং, নাইসাপ্রোসহ বিভিন্ন গ্রামে রোহিঙ্গা বসতিতে আগুন দেয়া হয়। এই সময় এলোপাতাড়ি গুলি ছোঁড়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। নাইচাপ্রো গ্রামের রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন, ‘‘সেনাবাহিনী খুব সকাল থেকে ‘নাইচাপ্রো’ গ্রামে তল্লাশি শুরু করে। কোরবানি দেওয়া তো দূরের কথা, কেউ ঈদের নামাজও পড়তে পারিনি। তাই অন্যদের মতো স্বজনদের নিয়ে সীমান্তের ওপারের একটি নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় নিয়েছি। এখন সুযোগ পেলেই প্রঅন বাচাঁতে সীমান্তে চলে যাবো।’’ একই গ্রামের আর এক রোহিঙ্গা নারী জানিয়েছেন, ‘ঈদের দিন খুব ভোরে বাংলাদেশ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে নো-ম্যানস ল্যান্ডে এসেছি। ভয়ভীতি নিয়েও এতদিন গ্রামেই ছিলাম। তবে রাতে তার গ্রামের কয়েকটি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় সেনাবাহিনী। তাই আজ চলে এসেছি।’
উখিয়ার পালংখালীর ইউপি সদস্য মোজাফফর আহমদ বলেন, ঈদের দিন ‘শনিবার সকাল থেকেই রাখাইন রাজ্যে দফায় দফায় গোলাগুলির শব্দ শুনেছি। দুপুর ৩টার দিকেও এমন শব্দ শুনতে পেয়েছি। এসময় সীমান্তের ওপারে রোহিঙ্গাদের চিৎকারও শোনা গেছে। রাখাইনের সীমান্ত এলাকায় ধোঁয়াও দেখেছি।’

গত ২৪ আগস্ট মিয়ানমারের আরকান রাজ্যে পুলিশ পোস্টে হামলা চালায় সে দেশের একটি বিদ্রোহী গ্রুপ। এতে ১২ পুলিশ সদস্যসহ রোহিঙ্গা হতাহত হয়। এ ঘটনায় বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিতে শুরু করেছে রোহিঙ্গারা। নাফ নদীর জলসীমানা থেকে শুরু করে স্থলসীমানা পার হয়ে জিরো পয়েন্টে অবস্থান নিয়েছেন হাজার হাজার রোহিঙ্গা। এর আগে, গত বছরের ৯ অক্টোবরের পর থেকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে একইরকম হামলার ঘটনা ঘটে। এসময় প্রাণের ভয়ে পালিয়ে আসেন প্রায় ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা। এরপর আন্তর্জাতিক মহল নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করে মিয়ানমার সরকারের ওপর। কিন্তু, এর কোনও তোয়াক্কা না করে আরকানে ফের সেনা মোতায়েন করলে বিদ্রোহী গ্রুপের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে সে দেশের সেনাবাহিনী ও পুলিশ। এতে উগ্রপন্থী ধরার নামে গত সপ্তাহের শুক্রবার থেকে পুরো আরকান রাজ্যজুড়ে চলছে সেনাবাহিনীর ত্রিমুখী নৃশংসতা।

এদিকে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণকারী রোহিঙ্গারাও জামায়াতের সাথে ঈদের নামাজ আদায় করতে পারেনি। তবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গারা জামায়াতের সাথে ঈদের নামাজ আদায় করেছে। তবে কোনো পশু কুরবানি করেনি। কোরবানি পশুর সংখ্যা পর্যাপ্ত নয় বলে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অনেকই এই কোরবানি থেকে বিরত থাকতে একটি পক্ষ মতামত ব্যক্ত করেন। অপর্যাপ্ত গোশত কাকে রেখে কাকে দিবে,এমন ভাবনা থেকে এমন সিদ্বান্ত নেন রোহিঙ্গা নেতারা।
উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, নতুনভাবে আসা রোহিঙ্গাদের চরম খাদ্য সংকট চলছে। পালিয়ে আসার সময় যেসব সহায় সম্পদ ছিল সেইসব সম্পদ সীমান্তের দুর্বত্তরা লুট করে নিয়েছে।অনেকই অনাহারে মানবেতর জীবন-যাপন করছে। ইতিমধ্যে বালুখালি ক্যাম্পে অনাহারে মারা গেছে এক রোহিঙ্গা নারী । ২ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা শিশু পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে বলে জানিয়েছেন ক্যাম্পের বাসিন্দারা।

৩ দিনে ২৯ রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার
মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নৃশংসতা থেকে প্রাণে বাচঁতে নাফনদী পাড়ি দিয়ে পালিয়ে আসার সময় ২১ জনের একটি রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকা ডুবে যায়। ঈদের দিন শনিবার বিকালে টেকনাফের হোয়াইক্যং বিজিবি ক্যাম্প-সংলগ্ন নাফনদীতে রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকা ডুবির ঘটনা ঘটে। এতে নাফনদীতে ডুবে মা ও মেয়ে মারা যায়। এই নৌকা ডুবির ঘটনায় ৪ জন শিশু নিখোঁজ রয়েছে। এই সময় ১ জন মুমুর্ষ শিশুকে কুতুপালং এনজিও পরিচালিত হাসপাতালে ভর্তি এবং নিহত মা-মেয়ের লাশ হোয়াইক্যং দাফন করা হয়েছে। একই দিনে শাহপরীর দ্বীপের নাফ নদীর মোহনা থেকে আরও এক রোহিঙ্গা নারীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। উখিয়ার রেজু আমতলী সীমান্তে আরও এক রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার করা হয়।
অপরদিকে শুক্রবার সকালে নাফ নদীর খারাংখালী, মৌলভীবাজার, গোদারপাড়া, সাবরাং, শাহপরীদ্বীপ জালিয়াপাড়া, ও টেকনাফ সদরের বেড়ি বাঁধের সন্নিকট থেকে পৃথক ২৬ রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশুর লাশ উদ্ধার করেছে টেকনাফ মডেল থানা পুলিশ। টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সহকারী কমিশনার (ভুমি) প্রণয় চাকমা উক্ত তথ্য নিশ্চিত করে জানান, তার এবং হোয়াইক্যং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুর আহমদ আনোয়ারী ও গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে লাশ গুলো উদ্ধার করে যথাযথ মর্যদায় দাফন করা হয়েছে। এর আগে গত বুধবার ও বৃহস্পতিবার টেকনাফ শাহপরীর দ্বীপ থেকে পৃথকভাবে ২৩ জন নারী ও শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়। এ নিয়ে গত এক সপ্তাহে মোট ৫২ জন রোহিঙ্গা নারী ও শিশুর মৃতদেহ উদ্ধার করা হলো।
ঈদের দিন শনিবার সন্ধ্যায় হোয়াইক্যং বিজিবি ক্যাম্প সংলগ্ন নাফ নদীর পারে নৌকা ডুবির ঘটনায় নিহত স্ত্রী ও মেয়ের লাশসহ আসা মিয়ানমারের মংডু থানাধীন মাংগালার পালংখালী গ্রামের সৈয়দ উল্লাহ (৬৩) জানান সকাল ১০টার দিকে ২টি নৌকায় করে ২৮ জন রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশু বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। কুমিরখালী অতিক্রম করার পর ২১ জন রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকাটি ডুবে যায়। খোঁজাখুজির পর স্ত্রী ফাতেমা খাতুন (৬০) এবং মেয়ে মিনারা আক্তারের (২২) মৃত দেহ পাওয়া গেলেও সাথে থাকা নিকট আত্মীয় অপর ৪ জন শিশু পাওয়া যায়নি। নিখোঁজ ৪ জন শিশুর মধ্যে ৩ জনই একই পরিবারের। এরা হলেন মৃত রমজান হাকিমের পুত্র মোঃ তুহাদ (৮), আসমত আরা (৬), জরিদা বেগম (৪)।
নিখোঁজ অপর ১ জন হলেন নুরুল ইসলামের পুত্র নুর কাবা (৫)। এ ঘটনায় মুমুর্ষ ও অজ্ঞান অবস্থায় উদ্ধার করে সাথে নিয়ে আসা মৃত ফজল হাকিমের শিশু কন্যা সুফাইরা বেগমকে (৮) কুতুপালং এনজিও পরিচালিত হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
২ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় ২টি মৃত দেহ এবং ১ জন মুমুর্ষ ও অজ্ঞান শিশু নিয়ে রোহিঙ্গার দলটি টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং বিজিবি ক্যাম্প সংলগ্ন নাফ নদীর পারে পৌঁছলে স্থানীয় লোকজন বিজিবি ও পুলিশকে খবর দেন। খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে পুলিশ ও বিজিবি পৌঁছে এদের উদ্ধার করে স্থানীয় ইউপি সদস্য সিরাজুল মোস্তফা লালু চৌধুরীর নিকট হস্তান্তর করেন। হোয়াইক্যং পুলিশ ফাঁড়ির আইসি উপ-পুলিশ পরিদর্শক মোহাম্মদ মহির উদ্দিন খান উর্ধতন কতৃপক্ষের নির্দেশক্রমে পুলিশ বিজিবি স্থানীয় মেম্বার ও গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে মা-মেয়ের লাশ দাফন করা হয়েছে। ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশী রোহিঙ্গা বোঝাই করার কারণে নৌকা ডুবির ঘটনা ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

রোহিঙ্গারা জানান, ঈদের দিনও তাঁদের এলাকায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হামলা শুরু হলে তড়িঘড়ি করে ঈদুল আযহার নামাজ পড়ে নৌকা যোগে এপারে আসার জন্য রওয়ানা হন। নাফ নদী হয়ে আসা কুমিরখালী স্থানে পৌঁছলে ডুবে যায় নৌকাটি। সারাদিন কষ্টে করে ওই মা মেয়ের মৃত দেহ পেলেও ৪ জনকে পাওয়া যায়নি।
উল্লেখ্য, গত ২৪ আগস্ট মিয়ানমারের আরকান রাজ্যে বিদ্রোহী গ্রুপের সঙ্গে সে দেশের সেনা বাহিনীর সহিংস ঘটনার পর সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে দলে দলে রোহিঙ্গা বাংলাদেশ সীমান্তে আশ্রায় নেয়। একইভাবে নাফ নদীর বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে জলসীমানা অতিক্রম করে রোহিঙ্গারা নৌকা নিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করার চেষ্টা করছে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/248996