১ সেপ্টেম্বর ২০১৭, শুক্রবার, ১০:৪০

ব্যাপক চাহিদার মুখেও বাজার থেকে টাকা তুলে নিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক

সাত দিনে সাড়ে ১৭ হাজার কোটি টাকা উত্তোলন

ঈদের সামনে ব্যাংকগুলোতে নগদ টাকার চাহিদা বেড়ে যায়। গ্রাহকেরা তাদের প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করতে বছরে অন্য সময়ের চেয়ে ঈদের আগে ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন করেন বেশি হারে। এ কারণে ঈদকেন্দ্রিক অনেক ব্যাংকেরই নগদ টাকার সঙ্কট দেখা দেখা দেয়। সঙ্কট মেটাতে ব্যাংকগুলো আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার থেকে ধার করে থাকে। এবারো বেশ কয়েকটি ব্যাংক বিপুল পরিমাণ নগদ টাকা ধার করেছে এ বাজার থেকে। এমনি এক মুহূর্তে নগদ টাকার চাহিদা যখন তুঙ্গে তখন মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের নামে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজার থেকে টাকা তুলে নিচ্ছে। গত সাত দিনে ব্যাংকিং খাত থেকে তুলে নিয়েছে সাড়ে ১৭ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে গতকালই উত্তোলন করেছে পাঁচ হাজার ৮০৫ কোটি টাকা। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রতি ১০০ টাকার জন্য ব্যয় করতে হয়েছে ২ টাকা ৯৮ পয়সা পর্যন্ত।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ, অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসবহুল পণ্য আমদানিতে লাগাম টানা, অনুৎপাদনশীল খাত ও ভোক্তা ঋণের চাহিদা কমানোর ল্েয এসব পদপে নেয়া হয়েছে। বাজারে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এলে প্রয়োজনে আবার টাকার প্রবাহ বাড়ানো হবে।

এদিকে ঈদে কেনাকাটায় প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে গতকাল দিনভর রাজধানীর সব ব্যাংকে নগদ টাকা উত্তোলনের জন্য গ্রাহকের ছিল উপচে পড়া ভিড়। টাকা উত্তোলনের জন্য দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় গ্রাহকের। একই দৃশ্য চোখে পড়ে রাজধানীর এটিএম বুথগুলোতে।
ঈদের আগে গতকাল বৃহস্পতিবার ছিল শেষ ব্যাংক কার্যদিবস। এদিনে রাজধানীর প্রতিটি ব্যাংকের শাখাতেই গ্রাহকের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। গ্রাহকের প্রয়োজন মেটাতে গতকাল অনেক ব্যাংকের শাখাতেই নির্ধারিত সময়ের চেয়ে বাড়তি সময়ে লেনদেন করতে দেখা যায়।
এদিকে গতকাল নগদ টাকার সঙ্কটে পড়া প্রায় আড়াই ডজন ব্যাংক আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে (কলমানি মার্কেট) থেকে ধার করেছে। নগদ টাকার সঙ্কট মেটাতে গতকাল এ বাজার থেকে ধার নিয়েছে প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা। গতকাল ১০০ টাকা ধার নিতে ব্যাংকগুলোকে সর্বোচ্চ সুদ গুনতে হয়েছে সাড়ে চার টাকা থেকে পাঁচ টাকা পর্যন্ত।

এমনি পরিস্থিতিতে গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংক সাত দিন মেয়াদি বাংলাদেশ ব্যাংক বিলের মাধ্যমে তিন হাজার ১৪০ কোটি টাকা তুলে নিয়েছে ১৪টি ব্যাংক থেকে। আর ১৪ দিন মেয়াদি ব্যাংক বিলের মাধ্যমে তিনটি ব্যাংকের কাছ থেকে তুলে নিয়েছে দুই হাজার ৫৪০ কোটি টাকা এবং ৩০ দিন মেয়াদি বাংলাদেশ ব্যাংক বিলের মাধ্যমে তিনটি ব্যাংকের কাছ থেকে তুলে নিয়েছে ১২৫ কোটি টাকা। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে পরিশোধ করতে হবে প্রতি ১০০ টাকার জন্য ২ টাকা ৯৭ পয়সা থেকে ২ টাকা ৯৮ পয়সা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, দেশে বিনিয়োগ না হওয়ায় ঋণের চাহিদা বাড়ছে না। এর ওপর বেসরকারি উদ্যোক্তারা বৈদেশিক ঋণ আনছে। ফলে বাজারে দেশীয় মুদ্রা এবং বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহের পরিমাণ বেড়ে গেছে। এসব মুদ্রাবাজারে অপ্রয়োজনীয় চাহিদা সৃষ্টি করছে। ফলে মূল্যস্ফীতির হার বাড়িয়ে দিচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নানা উপকরণ ব্যবহার করে মুদ্রার সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে এখন বাজার থেকে টাকা তুলে নেয়ার উপকরণগুলো ব্যবহার করছে।
ওই কর্মকর্তা জানান, বলতে গেলে নতুন বিনিয়োগের চাকা পুরোপুরি থেমে গেছে। নতুন কোনো বিনিয়োগই আসছে না। আর বিনিয়োগ না আসার কারণে ব্যাংকে অলস টাকার পরিমাণ বেড়ে চলছে। এ অলস টাকার কারণেই বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বেড়েছে। এতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্যই বাংলাদেশ ব্যাংক বাজার থেকে টাকা তুলে নিচ্ছে।

জানা গেছে, মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক কয়েকটি উপকরণ ব্যবহার করে। বাজারে টাকার প্রবাহ বেড়ে গেলে রিভার্স রেপোর (বাজার থেকে টাকা তুলে নেয়ার উপকরণ) মাধ্যমে টাকা তুলে নেয়া হয়। বিনিময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকগুলোকে বাজার অনুযায়ী ব্যাংকগুলোকে মুনাফা দেয়। এর বাইরে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে ব্যাংকগুলোর বাধ্যতামূলক নগদ জমা (সিআরআর) হার বাড়িয়ে দেয়। এর পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক বিলের মাধ্যমে টাকা তুলে নেয়া হয়।
আর বাজারে টাকার সঙ্কট দেখা দিলে বাংলাদেশ ব্যাংক রেপো ও বিশেষ তারল্য সহায়তার মাধ্যমে টাকার জোগান দেয়। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর হাতে থাকা ট্রেজারি বিল ও বন্ড বন্ধক রেখে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকগুলোকে টাকার জোগান দেয়। এর বিনিময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে বাজার অনুযায়ী সুদ আদায় করে।
সাম্প্রতিক সময়ে বিনিয়োগ মন্দায় ব্যাংকগুলোর হাতে প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকা উদ্বৃত্ত তারল্য জমা রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় বেশির ভাগ অর্থই সরকারের ট্রেজারি বিল ও বন্ড আকারে রয়েছে। বিনিয়োগযোগ্য তহবিল ব্যাংকগুলোর হাতে থাকায় ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেড়ে চলছে। সামনে ব্যাংকগুলোর লোকসানের আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাজার থেকে টাকা তুলে নিচ্ছে গত কয়েক মাস ধরে। কিন্তু ঈদকেন্দ্রিক বাজারে নগদ টাকার চাহিদা বেড়ে গেছে। এ পরিস্থিতিতে বাজার থেকে টাকা তুলে না নিলে তারল্য ব্যবস্থাপনার ওপর চাপ কমে যেত। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ পরিস্থিতিতেও টাকা তুলে নিচ্ছে, এতে তাদের ওপর চাপ বেড়ে গেছে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/248811