১ সেপ্টেম্বর ২০১৭, শুক্রবার, ১০:৩৮

কষ্টের আনন্দ যাত্রা

সকাল থেকে বৃষ্টি। ছিল পরিবহন সংকট। সব মিলিয়ে গতকাল ঈদযাত্রায় ঘরমুখো মানুষেরা ঢাকাতেই ভোগান্তির শিকার হন। পরিবহন সংকটের কারণে অনেক কষ্টে তারা হাজির হন রেলওয়ে স্টেশন ও বিভিন্ন বাস টার্মিনালে। শেষ পর্যন্ত পরিবারের সঙ্গে ঈদুল আজহার আনন্দ উদযাপন করতে গতকাল ঢাকা ছেড়েছেন অগণিত মানুষ। যাবেন আজও। গতকাল ছিল সপ্তাহের শেষ কর্মদিবস। আর এবার ঈদের ছুটি শুরু হচ্ছে আগামীকাল শুক্রবার থেকে। গতকাল সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত তুমুল বৃষ্টিতে ভোগান্তিতে পড়তে হয় ঢাকা ছেড়ে যাওয়া অগণিত মানুষকে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল পরিবহন সঙ্কট। যে কারণে গতকাল দিনভর সেই পরিচিত ঢাকাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। দেখা যায়নি যানজটে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা সারি সারি গাড়ি। গণপরিবহন সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রতিটি ঈদের দু’দিন আগে থেকেই রাজধানীর প্রায় সব রুটের বাস ‘খ্যাপ’ মারতে চলে যায় ঢাকার বাইরে। ঈদ যাত্রায় নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে দ্বিগুণ তিনগুণ বেশি ভাড়া পাওয়া যায় এসব খ্যাপে। যে কারণে রাজধানীর অভ্যন্তরে চলা পরিবহনগুলোর বেশির ভাগই চলে যায় রাজধানীর বাইরে। এবারের ঈদেও এর ব্যতিক্রম ছিল না। গতকাল দিনভর পরিবহন সঙ্কট ছিল রাজধানীতে। গতকাল রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, গুলিস্তান, পল্টন, শাহবাগ, ফার্মগেট, আগারগাঁও, মিরপুর ১০ নম্বর, ১২ নম্বর এলাকা ঘুরে দেখা গেছে গণপরিবহন সঙ্কট। আর এজন্য ঢাকা ছেড়ে যাওয়া মানুষেরা সকাল থেকেই চরম দুর্ভোগ পোহান। যারা ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার জন্য গতকালের দিনটি বেছে নিয়েছিলেন তারা সকালে রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে এসে বাস, সিএনজি চালিত অটোরিকশার জন্য হাপিত্যেশ করেন। উপায়ন্তর না দেখে অনেকে হেটে, রিকশায় করে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনসহ রাজধানীর বিভিন্ন বাস টার্মিনালে যান। তবে, রাজধানীর ভেতরে ভোগান্তির শিকার হলেও বেশির ভাগ ট্রেন ও বাস সময়মতো গন্তব্যের উদ্দেশে রাজধানী ছেড়ে যাওয়ায় ঈদ যাত্রা অনেকটাই ছিল স্বস্থির। এদিকে গতকাল ছিল ট্রেনে ঈদযাত্রার পঞ্চম দিন। ভোর থেকে রাজধানীর কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন, বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন ছিল ঘরমুখী মানুষের উপচেপড়া ভিড়। রেলওয়ে স্টেশনের কর্মকর্তারা জানান, ভোর থেকে স্টেশনে যাত্রীর চাপ বেশি থাকলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই চাপ কিছুটা কমে আসে। আবার বিকাল থেকে যাত্রীর চাপ আবারো বাড়তে থাকে। সকালের দিকে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মগুলোতে ঘরমুখো মানুষের উপচেপড়া ভিড় দেখা গেছে। স্বজনদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে ট্রেনের অপেক্ষায় ছিলেন তারা। একেকটি ট্রেন স্টেশনে আসতেই বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ছিলেন ট্রেনের দরজার সামনে। ট্রেনের বগিতে জায়গা না পেয়ে অনেকেই ঝুঁকি নিয়ে ছাদে উঠে বসেন। স্টেশন ছেড়ে যাওয়া প্রায় প্রতিটি ট্রেনের ছাদই ছিল লোকে লোকারণ্য। গতকাল কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে বিলম্বে আসার কারণে বেশকিছু ট্রেন স্টেশন থেকে দেরিতে ছেড়ে যায়। কিন্তু ট্রেন একটু দেরিতে স্টেশন ছাড়লেও ক্ষোভ ছিল না যাত্রীদের। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, গতকাল ভোর থেকে বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত ২৬টি ট্রেন দেশের বিভিন্ন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। আর গতকাল সারা দিনে ৬৭টি ট্রেন কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে ছেড়ে যায়। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের ব্যবস্থাপক সীতাংশু চক্রবর্তী সাংবাদিকদের বলেন, এখন যাত্রীদের অতিরিক্ত ভিড়। যেখানে যাত্রী ওঠানামার জন্য বরাদ্দ মাত্র দুই মিনিট সেখানে এখন যাত্রী ওঠাতে ও নামাতে ১০ থেকে ১৫ মিনিট সময় লেগে যায়। ট্রেন বিলম্বে আসার কারণেই স্টেশন ছেড়ে যেতে দেরি হচ্ছে।

এদিকে গতকাল ঢাকা ছেড়ে যাওয়া মানুষদের আনাগোনায় মুখর ছিল। রাজধানীর সায়েদাবাদ, মহাখালী, গাবতলী বাস টার্মিনাল। ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ নিজ নিজ গন্তব্যে যাওয়ার জন্য হাজির হন বাস টার্মিনালগুলোতে। বাস টার্মিনালের দায়িত্বরতরা জানান, টার্মিনালগুলো প্রায় সকল বাসই সঠিক সময়ে টার্মিনাল ছেড়ে গেছে। তবে, কিছু কিছু বাসে বেশি ভাড়া নেয়ার অভিযোগ উঠলেও নাড়ির টানে বাড়ি ফেরার আনন্দে সেই অভিযোগও ছিল কিছুটা ম্লান।
পাটুরিয়ায় যানবাহনের দীর্ঘ সারি, ভোগান্তি
রিপন আনসারী, মানিকগঞ্জ থেকে: সড়ক পথের ভোগান্তির অন্যতম ঠিকানা এখন পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌ পথ। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ঈদে ঘরমুখো মানুষ ফেরি পার হতে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন পাটুরিয়া ঘাটে। যানবাহনের অতিরিক্ত চাপ, ফেরি স্বল্পতা আর নদীতে তীব্র স্রোতের কারণে এই দুরবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। একই সঙ্গে অভিযোগ রয়েছে এই ঈদে ভিআইপি দেখিয়ে সিরিয়াল ভঙ্গ করার। সব মিলিয়ে পাটুরিয়া ঘাট এখন যাত্রী দুর্ভোগে নাভিশ্বাস হয়ে উঠেছে। গতকাল সরজমিন পাটুরিয়া ঘাটে গিয়ে দেখা গেছে, যানবাহনের অতিরিক্ত চাপ। ফেরি ঘাট ও লঞ্চ ঘাট জুড়ে মানুষ আর যানবাহনের বিশাল লম্বা সারি। তিনটি ফেরি ঘাট দিয়ে যানবাহন পারাপার করা হচ্ছে সেখানে। ৩ ও ৪ নং ফেরি ঘাট দিয়ে বড় যানবাহন আর ৫নং ফেরি ঘাটটি ব্যবহার করা হচ্ছে প্রাইভেটকার ও মাইক্রোবাসের জন্য। সবগুলো ঘাট অতি ব্যস্ত। ৩ এবং ৪ নং ঘাট ছাড়িয়ে যাত্রীবাহী বাস, কোচের লাইন চলে গেছে প্রায় কিলোমিটার। এ চিত্র বেলা ১২টার। ৫নং ঘাট থেকে ছোট গাড়ির লাইন চলে গেছে প্রায় চার কিলোমিটার। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যানবাহনের অতিরিক্ত চাপ বাড়ে পাটুরিয়া ঘাটে। বাড়ে যাত্রী দুর্ভোগও। ঈগল পরিবহনের যাত্রী আলী আফরাফ জানান, পরিবারের চার সদস্য নিয়ে সকাল ৮টায় পাটুরিয়া ঘাটে এসেছেন। কিন্তু বেলা ১১টা বেজে গেলেও তিনি পৌঁছাতে পারেননি ৩নং ফেরি ঘাটের কাছে। গোল্ডেন লাইন পরিবহনের যাত্রী নাসিমা আক্তার বলেন, ঘাটে তিন ঘণ্টা ধরে বাসের ভেতর বসে রয়েছি। কখন ফেরি পাবো আর কখনোই বা বাড়ি ফিরতে পারবো জানি না। দিগন্ত পরিবহনের চালক জানান, আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেরির অপেক্ষায় ঘাটে জটলার মধ্যে থাকলেও ভিআইপি গাড়িগুলো চোখের সামনেই পার হয়ে যাচ্ছে।

হানিফ এন্টারপ্রাইজের যাত্রী সাইফুল ইসলাম বলেন, সকাল সাড়ে ৯টা থেকে পাটুরিয়া ঘাটে পড়ে আছি, এখন বেলা সাড়ে ১২টা। অথচ পাশ দিয়ে ভিআইপি গাড়িগুলো চলে যাচ্ছে। আমরা আর কত সময় ঘাটে বসে থাকবো। বিআইডব্লিউটিসি আরিচা কার্যালয়ের ডিজিএম আজমল হোসেন বলেন, ঈদ উপলক্ষে ১৯টি ফেরি চলাচলের কথা থাকলেও বর্তমানে ১৫টি ফেরি দিয়ে যানবাহন পারাপারের কাজ চলছে। বড় দু’টি ফেরি হামিদুর রহমান ও শাহ্ আলী হঠাৎ করে বিকল হয়ে পড়েছে। আর একটি ফেরি সময় সময় নষ্ট হয়ে পড়ছে আর একটি ফেরি এখনো বহরে যুক্ত হতে পারেনি। নিয়ম ভঙ্গ করে ভিআইপি গাড়ি পার হচ্ছে কিনা- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ভিআইপি গাড়ি পারাপারে কিছু সুবিধা তো দিতেই হয়। কারন মন্ত্রী, এমপি এবং কিছু ভিআইপি সেসব গাড়িতে থাকেন। মানিকগঞ্জের পুলিশ সুপার মাহফুজুর রহমান বলেন, সিরিয়াল ভঙ্গের অভিযোগ পাটুরিয়া ঘাটে কম। কারন আমরা সিসিটিভি, মোবাইল এবং ল্যাপটপ দিয়ে সবকিছু মনিটর করছি। এরপরও দু’-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটে। শুনেছি বিকাশের মাধ্যমে টাকা লেনদেন করে এই সব কাজ করা হচ্ছিল। জানার পর কয়েকজনকে আমরা ধরেছি এবং আইনি ব্যবস্থা নিয়েছি।
ঢাকা-টাঙ্গাইল ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যানবাহনের বাড়তি চাপ
স্টাফ রিপোর্টার, গাজীপুর থেকে: ঈদ যাত্রায় গাজীপুরের ঢাকা-টাঙ্গাইল ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যাত্রীদের ভিড় ও যানবাহনের বাড়তি চাপ থাকায় যানবাহন চলছে ধীর গতিতে। ধীর গতি থাকলেও যানজটের তেমন ভোগান্তি নেই বলে জানা গেছে। তবে, গাড়ি কম থাকায় যাত্রীরা ভোগান্তিতে রয়েছেন। যে কারণে অনেকেই কম ভাড়ায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাসের ছাদে চড়ে গন্তব্যে যাচ্ছেন। গাজীপুর হাইওয়ে পুলিশ জানায়, গতকাল সকাল থেকেই ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের চন্দ্রা ত্রিমোড়, কোনাবাড়ী, সফিপুরসহ যানজট প্রবণ এলাকাগুলোয় গাড়ির গতি কম ছিল। তবে, মহাসড়কে অনেটা স্বাভাবিক গতিতেই যানবাহন চলাচল করেছে। একই অবস্থা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কেও। ভোগড়া বাইপাস, বোর্ডবাজার ও টঙ্গী স্টেশন রোড এলাকায় যানবাহনের গতি খুবই কম। তবে ভোগান্তি নেই। হাইওয়ে পুলিশ আরো জানায়, সড়ক যানজট মুক্ত করে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক রাখতে পুলিশের সঙ্গে ১ হাজার কমিউনিটি পুলিশ সদস্য কাজ করছেন।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=81334