কমলাপুর রেলস্টেশনে ট্রেনে যাত্রীদের উপচেপড়া ভিড়
৩১ আগস্ট ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৮:১৩

আনন্দের যাত্রায় শুধুই ভোগান্তি

গলাকাটা ভাড়া আদায় ; পথে পথে যানজট ; ছাদেও মানুষের ঠাঁই হচ্ছে না

শিমুলিয়া-কাঁঠালবাড়ি ঘাট হয়ে একটি যাত্রীবাহী বাসের ১৫-১৬ ঘণ্টা লাগছে পিরোজপুরের ভাণ্ডারিয়ায় পৌঁছতে। বাসটি সায়েদাবাদ হয়ে পোস্তগোলা ব্রিজ পার হতে সময় লাগছে কমপক্ষে দুই ঘণ্টা। ঢাকা-মাওয়া রোডের বিভিন্ন স্থানে থেমে থেমে আরো প্রায় দুই ঘণ্টা লাগছে শিমুলিয়া ঘাটে পৌঁছতে। ঘাটে গিয়ে থেমে থাকতে হচ্ছে আরো ২-৩ ঘণ্টা। পদ্মায় প্রবল স্রোতের কারণে ফেরি ওপারে পৌঁছতে ৩-৪ ঘণ্টা লাগছে। এভাবে পদ্মা পার হয়ে একটি বাস ওপারে উঠতেই প্রায় ১০ ঘণ্টা লেগে যাচ্ছে। এভাবেই পথে পথে দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে ঘরমুখো মানুষ। আনন্দের যাত্রায় এভাবে শুধুই ভোগান্তি পোহাচ্ছে মানুষ।
ভুক্তভোগীদের অনেকেই জানান, বাসা থেকে বের হওয়ার পর থেকেই তাদেরকে ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে। গাবতলী টার্মিনালে দিনাজপুরগামী যাত্রী ছিদ্দিকুর জানান, সকালে বাসা থেকে বের হয়েই ভোগান্তিতে পড়েন। ঝিগাতলা থেকে গাবতলী যাওয়ার জন্য সকালে বাসা থেকে বের হয়ে এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয় সিএনজি অটোরিকশার জন্য। পরে গাবতলী গিয়ে গাড়ির জন্য বসে থাকতে হয় দুই ঘণ্টা।
ছাদেও মানুষ
কমলাপুর বিআরটিসি বাস ডিপো এবং গাবতলী, সায়েদাবাদ ও মহাখালী বাস টার্মিনালে দেখা যায় এখনো মানুষ টিকিটের জন্য ঘুরছেন। কিন্তু কাউন্টারে কোনো টিকিট নেই। যারা টিকিট পাননি তারা অতিরিক্ত যাত্রী হিসেবে গাড়িতে উঠছেন। তাদের অনেকেই গাড়ির ভেতর দাঁড়িয়ে আছেন। অনেকে ছাদে চড়েছেন। আবার কোনো কোনো বাসের ছাদেও মানুষের ঠাঁই হচ্ছে না। কমলাপুর স্টেশনে গিয়ে দেখা যায় ট্রেনে যে যাত্রী আছেন তার চেয়ে বেশি যাত্রী আছেন দাঁড়িয়ে ও ছাদের ওপর।
অনেকে ছুটছেন বিকল্প পথে
যারা বাস বা ট্রেনে সিট পাননি তারা প্রাইভেট কার, মাইক্রো বাস, মিনি বাস, আবার কেউ কেউ খোলা ট্রাকে করেই ছুটছেন গন্তব্যে। রাজধানীতে চলাচলকারী অনেক বাস এখন দূর পাল্লার যাত্রী বহন করছে। এসব গাড়িতেও ঝুঁকি নিয়ে মানুষকে চড়তে হচ্ছে। কিসলু নামের এক যাত্রী জানালেন, বাধ্য হয়েই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ওই বাসে উঠতে হয়েছে।

অতিরিক্ত ভাড়া আদায়
ঈদে ঘরমুখো মানুষ পদে পদে অতিরিক্ত ভাড়া গুনছেন। গুলিস্তান থেকে মাওয়ার ভাড়া ৭০ টাকা। কিন্তু ভাড়া নেয়া হচ্ছে ১২০ টাকা। ঢাকা-পাটুরিয়ার বাসেও অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। সায়েদাবাদ গিয়ে দেখা যায় কুমিল্লা, মুন্সীগঞ্জ, সোনারগাঁওসহ বিভিন্ন এলাকার স্বল্পপাল্লার যেসব বাস রয়েছে, সেসব বাসে দ্বিগুণেরও বেশি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। প্রশাসনের নাকের ডগায় এভাবে বাড়তি ভাড়া আদায় করা হলেও দেখার কেউ নেই। ঢাকা-শিমুলিয়া ও ঢাকা-পাটুরিয়া রুটে যেসব বাস চলাচল করছে, তা ফেরিঘাটের দু-তিন কিলোমিটার দূরে যাত্রীদের নামিয়ে দিয়ে চলে আসছে। তাতে যাত্রীরা চরম ভোগান্তির মধ্যে পড়ছেন। এত পথ তাদেরকে হেঁটে যেতে হচ্ছে বলে একাধিক যাত্রী জানিয়েছেন।

লঞ্চে উপচে পড়া ভিড়
গতকাল বিকেলে দেখা গেছে লঞ্চগুলোতে উপচে পড়া ভিড়। কোনো নিয়মনীতি না মেনে লঞ্চগুলোতে যাত্রী বহন করা হচ্ছে। এ দিকে লঞ্চগুলোতে বাড়তি ভাড়া আদায়ের পরও অতিরিক্ত অর্থ নেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। সিট বাণিজ্য করে লঞ্চের শ্রমিকেরা বাড়তি অর্থ আদায় করে নিচ্ছে। সূত্র জানায়, ঈদ মওসুম এলেই অসাধু শ্রমিকেরা এ কাজ করে থাকে। লঞ্চ মালিক ও প্রশাসনের লোকজন এসব জেনেও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ও ডেকের সিট বাণিজ্য নিয়ে প্রায়ই যাত্রীদের সাথে শ্রমিকদের বিবাদ হচ্ছে। শ্রমিকেরা অনেক যাত্রীকে প্রতিদিনই নাজেহাল করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
ফেরিঘাটে তীব্র জট
গতকাল সকাল থেকেই মাওয়া ফেরিঘাটে তীব্র জট লক্ষ করা যায়। প্রতিটি ফেরিঘাটেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা পরিবহন আটকে থাকছে। আর এ সুযোগে ফেরিঘাটের কিছু অসাধু কর্মচারী ও পুলিশ সদস্য সিরিয়াল ভেঙে বাড়তি উপার্জনে নেমেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সায়েদাবাদের পরিবহন মালিক নেতা তানভীর রানা বলেছেন, একটি বাস বরিশালের নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছতে ১৫-১৬ ঘণ্টা লেগে যাচ্ছে। এতে যাত্রীরা চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছে।
চলছে লক্কড়ঝক্কড় যানবাহন

ঈদ মওসুমে বাড়তি উপার্জনের জন্য একশ্রেণীর অসাধু পরিবহন মালিক লক্কড়ঝক্কড় যানবাহন রাস্তায় নামিয়েছে। এমনকি নামী-দামি কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধেও এ অভিযোগ পাওয়া গেছে। ঈদ মওসুম এলেই অসাধু মালিকেরা এই সুযোগটি নিয়ে থাকে। সূত্র জানায়, মালিকদের এই অতি মুনাফার লোভে সাধারণ যাত্রীরা চরম দুর্ভোগের মধ্যে পড়তে পারেন। এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। শুধু বাসই নয়, নৌযানের ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটছে। ফিটনেসবিহীন বেশ কিছু নৌযান এই ঈদ মওসুমে যাত্রী পরিবহনে নেমেছে বলে জানা যায়। অভিযোগ রয়েছে, যাদের বিষয়টি তদারকির কথা তাদেরকে ম্যানেজ করেই অসাধু ব্যবসায়ীরা সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে।
নিরাপত্তা ব্যবস্থা বিঘিœত
এ দিকে চরম নিরাপত্তাহীনতায় যাত্রীদেরকে ঘরে ফিরতে হচ্ছে। রাজধানীর গাবতলী, মহাখালী, গুলিস্তান, সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল এবং কমলাপুর রেলস্টেশন ও সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল ঘুরে দেখা গেছে যতটা নিরাপত্তা দেয়ার কথা বলা হচ্ছে, তার সিকি ভাগও নেই। আর এ সুযোগে দুর্বৃত্তরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। গতকাল অজ্ঞান পার্টির কবলে পড়ে একজন সর্বস্ব হারিয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্যাম্প স্থাপন হলেও মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন বলে অনেকেই জানান। একাধিক যাত্রী বলেছেন, তারা টিকিট কেটেও লঞ্চে ও গাড়িতে চড়তে পারেননি। কিন্তু এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অভিযোগ করে কোনোই প্রতিকার পাওয়া যায়নি।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/248565