৩১ আগস্ট ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৮:১১

ফের জটের মুখে চট্টগ্রাম বন্দর

ফের জটের মুখে পড়তে যাচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর। সৃষ্টি হতে পারে কন্টেইনার ও জাহাজের দ্বিমুখী জট। গত ১ আগস্ট থেকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়ন করে সার্বক্ষণিক (২৪/৭) চট্টগ্রাম বন্দর এবং বন্দর-নির্ভর একক বৃহৎ রাজস্ব আহরণকারী প্রতিষ্ঠান কাস্টম হাউস সচল রাখা হয়েছে। কিন্তু উভয় প্রতিষ্ঠানের যারা মূল বন্দর ব্যবহারকারী বা স্টেক হোল্ডার তাদের বেশিরভাগই চলে গেছেন পবিত্র ঈদুল আযহার অবকাশ পালনের জন্য। গতকালসহ (বুধবার) কয়েকদিনে বন্দরে কন্টেইনার ও খোলা সাধারণ পণ্যসামগ্রী খালাসের তুলনায় অনেকাংশে কমে গেছে ডেলিভারি পরিবহন। তিন দিনের ঈদের ছুটিতে ও তার আগে-পরে বন্দরে স্বাভাবিক কাজে ভাটার টান বেশ কিছুদিন চলতে পারে এমনটি মনে করছেন পোর্ট-শিপিং-কাস্টমস খাতের সাথে সংশ্লিষ্টরা। সেই সাথে ভারী ও মাঝারি বিভিন্ন ধরনের অত্যাকশ্যকীয় যন্ত্রপাতির (ইকুইপমেন্টস) ঘাটতি এবং টার্মিনাল, জেটি-বার্থ, ইয়ার্ডসহ অবকাঠামোর অভাবে থমকে আছে বন্দরের স্বাভাবিক গতিশীলতা। অবশ্য বন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, আমদানি-রফতানি পণ্য দ্রæত খালাস ও জাহাজীকরণের জন্য পুরোদমে বন্দর প্রস্তুত। তবে বন্দর-কাস্টমসের সেবাগ্রহীতা বা ব্যবহারকারীরা যদি সময়মতো না আসে তাহলে খালাস ডেলিভারি কিছুটা বিঘিœত হতে পারে। তা যাতে না হয় এরজন্য কর্তৃপক্ষ কনসাইনিদের তাগিদ দিয়ে আসছে। বন্দরের অভ্যন্তরে আমদানিকৃত পণ্যবাহী এফসিএল কন্টেইনারের সংখ্যা অত্যধিক বেড়ে গেছে। এফসিএল কন্টেইনার ডেলিভারিতে ধীরগতির কারণে বন্দরের দৈনন্দিন স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে অবিলম্বে কন্টেইনার সরিয়ে নেয়ার জন্য আমদানিকারক, সিএন্ডএফ এজেন্টসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি ইতোমধ্যে নোটিশ দিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। অন্যথায় আমদানি পণ্যের এফসিএল কন্টেইনারের স্টোর রেন্ট শুরু হওয়ার দিন অর্থাৎ ৪ দিন ফ্রি-টাইমের পর থেকে বর্ধিত হারে পেনাল রেন্ট বা দÐ ভাড়া আরোপ করা হবে বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দিয়েছে। তবে ঈদ এসে যাওয়ার আগে থেকেই সেই ‘কড়া’ সতর্কতাও তেমন কাজে আসেনি। কেননা বন্দর ব্যবহারকারী সিংহভাগই কোরবানি ঈদের প্রস্তুতিকে ঘিরে যার যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। বন্দরের কাজে সংশ্লিষ্ট সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিকদের অনেকেই আগাম ছুটিছাঁটা নিয়ে চলে গেছেন চট্টগ্রামের বাইরে গ্রামের বাড়িতে।
এদিকে বন্দর-শিপিং সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রামকে সার্বক্ষণিক (সাত দিনে ২৪ ঘণ্টা) সচলের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি সময়োচিত ও যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত দেন। তবে সার্বিক সমন্বয়হীনতা, অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা, সর্বোপরি বন্দরের যুগোপযোগী প্রযুক্তি ও অবকাঠামোর অভাবে এর সাফল্য নিয়ে এখনো বাধা-সংশয় রয়েই গেছে। আমদানি-রফতানিমুখী ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনায় সেবার মান বৃদ্ধি, এর পাশাপাশি রাজস্ব আহরণ প্রক্রিয়া আরো সহজ ও গতিশীল করে বন্দর-কাস্টমস ভিত্তিক কর্মকাÐকে বিশ্বায়নের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২ জুলাই সচিবদের সভায় চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টম হাউস ২৪ ঘণ্টা সচলের কার্যক্রম গ্রহণের জন্য নির্দেশনা প্রদান করেন। এর মূল লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, প্রধান বন্দরের মাধ্যমে দেশের ৯২ শতাংশ আমদানি-রফতানি সম্পন্ন হয়। যার বার্ষিক পরিমাণ বর্তমানে প্রায় ৩৪ বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ। সময়ের প্রয়োজনে শিপিং বাণিজ্যে চাহিদা বেড়ে গিয়ে বিশেষত কন্টেইনারে পণ্য পরিবহনে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ১৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে, প্রতিবছরই তা বৃদ্ধির দিকে। আর ২৪ ঘণ্টা সচল থাকলে বন্দরজট নিরসন হবে।
অন্যদিকে সমুদ্র বন্দরের নিত্যদিনের কার্যক্রমের সাথে শুধুই চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (চবক) ও কাস্টম হাউসই নয়; আরও অনেকগুলো সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সম্পৃক্ত রয়েছে। এরমধ্যে আছে- বিএসটিআই, কোয়ারেন্টাইন কীটতত্ত¡ বিভাগ, নৌবাহিনী (ক্ষেত্র বিশেষে), সিএন্ডএফ এজেন্টস, শিপিং এজেন্টস, মেইন লাইন অপারেটর (এমএলও), বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ, বেসরকারি কন্টেইনার ইয়ার্ড (আইসিডি) তথা অফডক, স্টিভিডোরিং, ফ্রেইট ফরোয়ার্ডিং, ব্যবসায়ী-শিল্পোদ্যোক্তাদের সংগঠন-সমিতিসহ আরও বিভিন্ন ধরনের স্টেক হোল্ডার বা বন্দর ব্যবহারকারী। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানের সাথে চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টমসের মধ্যকার সুষ্ঠু সমন্বয় গড়ে না উঠার কারণে বন্দর কার্যক্রমে প্রত্যাশিত গতিশীলতা আসছে না। তবে এসব ক্ষেত্রে কার্যকর সমন্বয়ের জন্য চট্টগ্রাম বন্দর এবং কাস্টম হাউসের পূর্ণাঙ্গ অটোমেশনের ব্যাপারে তাগিদ দিয়ে আসছে পোর্ট-শিপিং বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষত ঈদের সময়ে বন্দরের কাজে ভাটা পড়ার মূল কারণ হচ্ছে সমন্বয়হীনতা। তাছাড়া ঈদকে ঘিরে ইতোমধ্যে পরিবহন খাতের লোকজনও বন্দর এলাকা ছেড়ে গ্রামে চলে গেছে বেশিরভাগ। ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, কন্টেইনার মোভার, ট্রেলার, ভারী ও মাঝারি ধরনের যন্ত্রপাতি চালক-শ্রমিকদের অধিকাংশই ঈদের আগে-পরে অন্তত এক সপ্তাহ থেকে দুই সপ্তাহ বন্দরে ফিরবে না। এ কারণে বন্দরে জটের পরিস্থিতি নাজুক হয়ে উঠতে পারে। গত ঈদুল ফিতরের সময়ও একই অবস্থা, সেই সাথে টানা দুর্যোগপূর্ণ আহাওয়ায় বন্দরের গতি থমকে যায়। সৃষ্টি হয় কন্টেইনারসহ কার্গো এবং জহাজের ভয়াবহ জট। যার রেশ এখনও পুরোপুরি কাটেনি। গত ঈদুল ফিতরের ছুটিসহ বৈরী আবহাওয়া এবং সিসিটিতে বিদেশী জাহাজের বেপরোয়া ধাক্কার ঘটনার জেরে কন্টেইনারের পাহাড় জমে উঠে প্রায় ৪১ হাজারের। অথচ বন্দরে স্বাভাবিক ধারণক্ষমতা ৩৬ হাজার ৩৫৭টি। আর বন্দরের বহির্নোঙরে অলস অপেক্ষমান জাহাজের সারি হয়ে উঠে দীর্ঘ। দিনে গড়ে অলস ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে ১২ থেকে ১৮টি কন্টেইনার জাহাজ। অথচ যে কোন সমুদ্র বন্দরে স্বচ্ছন্দে অপারেশনাল কার্যক্রম পরিচালনার স্বার্থে অন্তত ৩০ শতাংশ স্থান, ধারণক্ষমতা ও অবকাঠামো খালি রাখার বিধি-বিধান রয়েছে আঙ্কটাড ও অন্যান্য পোর্ট-শিপিং কনভেনশনে। আর চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্যভার উপচে পড়ছে বছরের অধিকাংশ সময়েই। জট সামাল দিতে হিমসিম খাচ্ছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। জটের বিপরীতে বিভিন্ন ধরনের মাশুল ও বন্দর-ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। তাৎক্ষণিকভাবে শত শত কোটি টাকার এই ক্ষতি ব্যবসায়ীদের দিতে হলেও পরবর্তীতে বাজারের নিত্য ও ভোগ্যপণ্য, সেবার মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে তার খেসারত দিতে হচ্ছে দেশের ভোক্তা সাধারণকেই।
চট্টগ্রাম বন্দর-শিপিংয়ে প্রবৃদ্ধির সমানুপাতে জেটি-বার্থ, টার্মিনাল, ইয়ার্ড-শেড, যান্ত্রিক সরঞ্জামসহ অত্যাবশ্যকীয় অবকাঠামোর সুযোগ-সুবিধা বাড়ছে না। বরং সঙ্কুচিত হয়ে এসেছে। চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ে প্রবৃদ্ধির হার ১৪ শতাংশেরও ঊর্ধ্বে। গত অর্থবছরে প্রায় ৮ কোটি মেট্রিক টন সাধারণ কার্গো এবং ২৪ লাখ ১৮ হাজার টিইইউএস কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করা হয়। অথচ চট্টগ্রাম বন্দর যন্ত্রপাতি বা ইকুইপমেন্ট সঙ্কটে ধুঁকছে দীর্ঘদিন ধরে। জরুরিভিত্তিতে ১১শ’ ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৬১ ধরনের আধুনিক যন্ত্রপাতি সংগ্রহ অনিশ্চিত ঝুলে আছে। এরমধ্যে রয়েছে ১০টি কী গ্যান্ট্রি ক্রেন, ২০টি রাবার টায়ারড গ্যান্ট্রি (আরটিজি) ক্রেন, পর্যাপ্ত স্ট্র্যাডল ক্যারিয়ার, রীচ স্ট্র্যাকার, কন্টেইনার মোভার, রেল মাউন্টেড গ্যান্ট্রি ক্রেন প্রভৃতি। তবে বন্দর কর্তৃপক্ষ সূত্র জানায়, যান্ত্রিক সরঞ্জাম সংগ্রহের ক্ষেত্রে জট খুলেছে। প্রায় ২৫০ কোটি টাকার যন্ত্রপাতির আংশিক বন্দরে এসে গেছে, আরও সংগ্রহের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। তাছাড়া প্রস্তাবিত পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল (পিসিটি), বে-টার্মিনাল বাস্তবায়িত হলে বন্দরে অবকাঠামো সমস্যা নিরসন হবে।

https://www.dailyinqilab.com/article/94128