৩১ আগস্ট ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৮:০৮

শঙ্কা কাটেনি

কূটনৈতিক জোনে জঙ্গি হামলার রেশ এখনও কাটেনি। হলি আর্টিজানের নৃশংসতার পুনরাবৃত্তি রোধ এবং জনমনে আস্থা ফেরানো বিশেষত বিদেশি নাগরিক ও কূটনীতিকদের ভীতি দূর করতে সরকারের তরফে প্রচেষ্টার অন্ত নেই। কিন্তু নিরাপত্তা নিয়ে বিদেশিরা এখনও পুরোপুরি নিশ্চিন্ত নন। একাধিক কূটনীতিক এ নিয়ে সরকারি পদক্ষেপের প্রশংসা করলেও তাদের মনের ভয় দূর না হওয়ার কথাই জানান। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাও বিষয়টি স্বীকার করেন। বলেন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানিসহ অনেক দেশের কূটনীতিকরা ঢাকায় তাদের পরিবার রাখছেন না, এটা সত্য। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে তাদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দেয়া হচ্ছে। কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, হঠাৎ করে ভীতিকর এক পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে যাওয়া এবং দীর্ঘ সময় পরিবারকে দূরে রাখতে বাধ্য হওয়ায় অনেক কূটনীতিক স্বেচ্ছায় ঢাকা থেকে বদলি হয়ে গেছেন। এটি হোস্ট কান্ট্রির জন্য যেমন বিব্রতকর, তেমনি ওই কূটনীতিকের জন্যও। হলি আর্টিজানের হামলার পর থেকে পশ্চিমা দেশগুলো অনেকটা ঘোষণা দিয়েই তাদের কূটনীতিকদের পরিবারকে ঢাকা থেকে সরিয়ে নেয়। তারা হয়তো নিজ দেশে অথবা তৃতীয় কোনো দেশে এখন পরিবার রাখছেন। বিশেষ করে যাদের ১৮ বছরের কম বয়সী সন্তান রয়েছে। কূটনীতিকের পরিবার তো বটেই সাধারণ নাগরিকদের নিরাপত্তা নিয়েও পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো সচেতন। নাগরিকদের জন্য তারা নিয়মিতভাবে তাদের নিরাপত্তা সতর্কতা হালনাগাদ করে চলেছে। ঢাকার নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে ওই সব রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে মনিটরিং করা হয়। ঢাকা থেকে বিদেশি নাগরিক ও কূটনীতিকদের পরিবার সরিয়ে নেয়ার ফলে কূটনৈতিক জোনে থাকা আন্তর্জাতিক মানের অনেক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীও কমে গেছে! ঢাকার বর্তমান নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে সমপ্রতি কথা হয় কূটনৈতিক কোরের ডিন ও ভ্যাটিকানের রাষ্ট্রদূত আর্চবিশপ জর্জ কোচেরির সঙ্গে। তিনি অবশ্য পরিস্থিতি নিয়ে সামগ্রিক কোনো মূল্যায়ন বা মন্তব্যে রাজি হননি। তবে পোপের আসন্ন সফরে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার পাওয়া গেছে বলে জানান। এ নিয়ে পশ্চিমা এক কূটনীতিক সমপ্রতি মানবজমিনকে বলেন, ‘বাংলাদেশে সরকার সচেতন হয়েছে। নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নতিও হয়েছে। কিন্তু সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে গেছে মনে করে হাল ছেড়ে দেয়া তো ঠিক হবে না। এজন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে আমার রুটিনে কিছু পরিবর্তন এনেছি। আমার দেশ এবং দূতাবাসেরও কিছু নির্দেশনা রয়েছে। আমরা এটা মেনে চলার চেষ্টা করি।’ অন্য এক কূটনীতিক জানান, কেবল পশ্চিমারা নয়, নিরাপত্তার প্রশ্নে সবাই সচেতন। ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন দূতাবাসের এক কর্মকর্তার ঘটনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ওই কূটনীতিক মক্সিকোতে পরিবার নিয়ে ছুটি কাটাচ্ছিলেন। এমন সময় ঘটে গুলশানে জঙ্গি হামলার ঘটনা। যেখানে ১৭জন বিদেশি এবং দুজন পুলিশ কর্মকর্তাসহ ২২টি নিরীহ প্রাণ ঝড়ে যায়। অবশ্য সেনা-কমোন্ডোদের অপারেশনে অন্তত ১৭জন নারী, পুরুষ ও শিশুকে জঙ্গিদের জিম্মি দশা থেকে জীবিত উদ্ধার এবং ঘটনাস্থলে ৫ জঙ্গি নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে শ্বাসরুদ্ধকার সেই পরিস্থিতির অবসান হয়। ছুটিতে থাকা আমেরিকান ওই কূটনীতিক মেক্সিকোতেই গুলশানে হামলার ঘটনা জানতে পারেন। পরক্ষণেই তাকে বলা হয়, তার পরিবারকে ম্যাক্সিকো থেকে ওয়াশিংটনে বা অন্যত্র রেখে ঢাকায় ফিরতে। তিনি তা-ই করেছেন। পর্যায়ক্রমে আমেরিকান অন্য কূটনীতিকদের পরিবারকেও বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে নেয়া হয়। একইভাবে বৃটেন, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার কূটনীতিকরাও তাদের পরিবারকে নিজ নিজ দেশে পাঠিয়ে দেন। ওই ঘটনায় এতটাই আতঙ্কিত হয়েছিলেন কানাডা ও জার্মানির কয়েকজন কূটনীতিক, তারা দীর্ঘ সময় ছুটিতে কাটিয়ে পরে অন্যত্র বদলি হয়ে যান। কূটনীতিকদের মনের ভয় এখনও দূর না হওয়ার বিষয়টি আরো স্পষ্ট করেন ঢাকায় ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত মিখায়েল হেমনিটি উইন্টার। কূটনৈতিক রিপোর্টারদের সঙ্গে এক মতবিনিময় অনুষ্ঠানে তিনি অনেকটা খোলাখুলিভাবেই বলেন, গুলশান হামলার মতো ভয়াবহ আক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে কূটনীতিক ও বিদেশিরা এখন নিজেরাই নানামুখী পদক্ষেপ নিচ্ছেন। তারা নিরাপত্তা নিয়ে পুরোপুরি নিশ্চিন্ত নন। এ নিয়ে প্রতিনিয়ত নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা হয় জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা অবস্থা বুঝে আমাদের দৈনন্দিন রুটিনে কাটছাঁট করি। নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ বিবেচনায় রেখে বাইরে কোথাও যাওয়া বা না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। ২০১৬ সালের ১লা জুলাই’র ওই ঘটনার পর সরকার যে সব উদ্যোগ নিয়েছে তাতে কূটনীতিকরা খুশি বলেও জানান তিনি। তার মতে, পরিস্থিতি থেকে আপাতত মুক্তি মিলেছে। তবে তারা এখনো নিরাপত্তা ঝুঁকি অনুভব করেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আমেরিকাস অনুবিভাগের এক কর্মকর্তা মানবজমিন-এর সঙ্গে আলাপে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার কূটনীতিকদের অনেকের পরিবার এখনও ঢাকায় নেই। কারণ তাদের হেড কোয়ার্টার থেকেই এ নিয়ে আপত্তি রয়েছে। বিশেষ করে যাদের অপ্রাপ্ত বয়সী সন্তান রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের তরফে গত সপ্তাহেও মার্কিন নাগরিকদের জন্য নিরাপত্তা সতর্কতা হালনাগাদ করা হয়েছে। সেখানে অপ্রাপ্ত বয়স্ক মার্কিনিদের বাংলাদেশ ভ্রমণে আরও কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ওই কর্মকর্তা বলেন, এটি নতুন কিছু নয়। বরং আগের চেয়ে এবারে মার্কিন ভ্রমণ সতর্কতা (ট্রাভেল ওয়ার্নিং) কিছুটা শিথিল করা হয়েছে বলে আমরা মনে করি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তার দাবি সর্বশেষ সতর্ক বার্তায় মাইনর বা অপ্রাপ্ত বয়স্ক মার্কিনিদের বাংলাদেশ ভ্রমণ বা বসবাসে নিষেধাজ্ঞা জারির বিষয়টি স্পষ্ট করে সন্তান না থাকা কিংবা সন্তানকে অন্যত্র রেখে সঙ্গী (স্পাউস)কে নিয়ে ঢাকায় আসতে আগ্রহী কূটনীতিকদের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে ওয়াশিংটন। পরিবারকে বাইরে পাঠিয়ে দেয়ায় কানাডা মিশনেও কিছু জটিলতা ছিল স্বীকার করে ওই কর্মকর্তা দাবি করেন এখন আর সেই সঙ্কট নেই। ইউরোপ দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তা সমপ্রতি মানবজমিনকে বলেন, যুক্তরাজ্য ও জার্মানি ছাড়া ইউরোপের অন্য দেশগুলোর তরফে পরিবার ফেরত আনতে আর কোনো বাধা নেই। তবে অনেকে এখনও তাদের পরিবারকে ফেরাননি জানিয়ে তিনি বলেন, পরিস্থিতি উন্নতি হয়েছে এটা তারাও মানছেন। তাছাড়া ফ্রান্সসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে একের পর এক ঘটনা ঘটছে। ইউরোপিয়ানরা বিশ্ব বাস্তবতা এবং নিরাপত্তা প্রশ্নে বাংলাদেশ সরকারের আন্তরিকতাকে আমলে নেবেন বলে আশা ওই কর্মকর্তার।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=81197