মগসেনাদের আগুনে জ্বলছে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ঘরবাড়ি। ছারখার হচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম
৩১ আগস্ট ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৮:০৫

আরো ১৩টি মুসলিম গ্রামে মগসেনাদের হত্যাধর্ষণ অগ্নিসংযোগ

কামাল হোসেন আজাদ ও শাহনেওয়াজ জিল্লু, কক্সবাজার : আরাকানের চৌপ্রাং আন্দাং মংডুসহ আরোও বেশ কয়েকটি এলাকা নিশ্চিহ্ন করে এবার গতকাল বুধবার সকাল ১১টা থেকে আরো বহু এলাকায় অগ্নিসংযোগ হত্যা ধর্ষণসহ নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে মিয়ানমারের মগসেনা বাহিনী, স্থানীয় উগ্রপন্থী রাখাইন এবং অংসান সুচির রাজনৈতিক দলের ধর্মীয় উগ্রপন্থী সমর্থকরা। বুধবার সকাল ১১টা থেকে নতুন করে শিন্দিপ্রাং, রাথিদং, তুলাতুলি, তেইল্যারডিয়া, শাপ্রাং, তং বাজারসহ আরোও ১৩টি রোহিঙ্গা গ্রাম ও পল্লীতে আগুন দিয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। এসময় পালিয়েও আসতে দেয়নি রোহিঙ্গা নারী পুরুষ যুবকদের। সবাইকে সামনে ও পিছন থেকে গুলী করে কুপিয়ে হত্যা করেছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের কমপক্ষে ৫০ কিলোমিটারজুড়ে আগুন জ্বলছে। সীমান্তের এপারে বাংলাদেশের স্থানীয় বাসিন্দারা মঙ্গলবার সকাল থেকে বুধবার দুপুর পর্যন্ত মিয়ানমার সীমান্তে আগুনের লেলিহান শিখা দেখেছে। এরমধ্যেই সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্ঠা করে যাচ্ছে।
সীমান্তে পালিয়ে আসা শাপ্রাংয়ের একজন মুহাদ্দিস জানিয়েছেন, শাপ্রাং জ্বালিয়ে দেয়ার সময় তেইল্যারডিয়া হয়ে আসার পথে ২/৩ শ’ নারীপুরুষকে মগসেনারা ধরে ফেলে এবং তাদের পাশ্ববর্তী একটি জঙ্গলে নিয়ে গলা কেটে হত্যা করে। নারীদের ধর্ষণ করে। কেউ কেউ বিব্রস্ত অবস্থায় পালিয়ে সীমান্তে চলে আসার চেষ্ঠা করছে। তিনি আরোও জানিয়েছেন, তার এলাকায় কমপক্ষে ১৪শ রোহিঙ্গা রয়েছে। যাদের মধ্যে বেচে আছে মাত্র ৪শ’ জন মত। আর বাদবাকী হাজার খানেক সবাই গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। তার মধ্যে সে তার আতœীয় মাওলানা ইউনুসের পরিবারকে সপরিবারে হত্যা করতে দেখেছে বলে জানিয়েছে। তার দুই ছেলে স্থানীয় একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাস্টার ও মৌলভী দুজনকেই তার সামনে হত্যা করতে দেখেছে সে। মাওলানা সাহেবের স্ত্রীকে ধরে নিয়ে গেছে। স্কুল পড়–য়া যুবকদের কাউকেই রেহাই দেয়নি তারা। ধরে ধরে সবাইকে হত্যা করেছে।
এদিকে সীমান্তে রোহিঙ্গাদের অবস্থান নেওয়ার ব্যাপারে কক্সবাজার বিজিবির ৩৪ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক মনজুরুল হাসান খান জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের অনেকেই সীমান্তের জিরো পয়েন্টে অবস্থান করছে। পরিবেশ শান্ত হলে তারা স্বদেশে ফিরে যাবে।
টেকনাফ ২ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্ণেল এসএম আরিফুল ইসলাম জানিয়েছেন, এ পর্যন্ত ৮ শতাধিক রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানো পাঠানো হয়েছে। বুধবার দুপুর পর্যন্ত নতুন কোন রোহিঙ্গা ফেরত পাঠানো হয়নি।
এদিকে সীমান্তে অবস্থানকারী এবং বাংলাদেশে ঢুকে পড়া নির্যাতিত রোহিঙ্গারা জানিয়েছে, রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে সে দেশের সেনাবাহিনীর নজিরবিহীন তান্ডব চলছেই। প্রতিদিন একের পর এক গ্রাম জালিয়ে দেয়া হচ্ছে। গুলীবর্ষণ করা হচ্ছে সাধারণ মানুষের ওপর। যাকে যেভাবে পাচ্ছে হত্যা করা হচ্ছে নির্মমভাবে।
বুধবার সকালে থেকে মিয়ানমারের বালুখালী, দারোগাপাড়া, জাম্যান্না, ফুটখালীর আকাশে আগুনের লেলিহান শিখা দেখা যাচ্ছে। ওইসব এলাকায় সাধারণ লোকজনকে গুলী করে, গলা কেটে হত্যা করা হচ্ছে বলে জানান পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা।
মিয়ানমারের রাসিদং এর শাপ্রাং পাড়া থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা জানান, মঙ্গলবার দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তাদের এলাকায় ১৪শ মানুষের মধ্য থেকে এক হাজার মতো গুলী করে হত্যা করা হয়েছে। দেশটির সেনারা জালিয়ে দিয়েছে তাদের বসতভিটা। চোখের সামনে স্বজনদের হত্যা করেছে। জীবন বাজি রেখে তারা এপারে পালিয়ে এসেছে।
তারা জানায়, মংডু, বুদিদং, রাথিদং, শাপ্রাং পাড়ার অবস্থা নাজুক। বুধবার ভোররাত থেকে সেখানে নতুন করে বসতবাড়ীতে অগ্নিসংযোগ করা হচ্ছে। মেয়েদের উপর নির্যাতন চলছে।
এদিকে টেকনাফের নাফনদীর শাহপরীরদ্বীপ উপকূলে রোহিঙ্গা বোঝাই একটি নৌকা ডুবির ঘটনা ঘটেছে। এতে ৪ জনের প্রাণহানি হয়েছে। নিখোঁজ রয়েছে আরো অন্তত ১০ জন। খবর নিশ্চিত করেছেন স্থানীয় স্থানীয় ইউপি সদস্য নুরুল আমিন।
প্রসঙ্গত, গত ২৪ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের পুলিশ পোস্টে সে দেশের একটি বিদ্রোহী গ্রুপ হামলা চালানোর অভিযোগ এনে রোহিঙ্গাদের উপর ইতিহাসের জঘন্যতম বর্বরতা চালিয়ে আসছে সেদেশের সরকার ও সেনাবাহিনী। এঘটনার পর প্রতিদিনই বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে আসছে অসংখ্য রোহিঙ্গা। নাফ নদীর জলসীমানা থেকে শুরু করে স্থল সীমানা পার হয়ে জিরো পয়েন্টে অবস্থান নিয়েছে হাজার হাজার রোহিঙ্গা। এর আগে গত বছরের ৯ অক্টোবরের পর থেকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে একইভাবে হামলার ঘটনা ঘটে। তখন প্রাণ ভয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে প্রায় ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা। এরপর আন্তর্জাতিক মহল নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করে মিয়ানমার সরকারের ওপর। কিন্তু এর কোনও তোয়াক্কা না করে রাখাইনে ফের সেনা মোতায়েন করলে বিদ্রোহী গ্রুপের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে সে দেশের সেনা বাহিনী ও পুলিশ।
হিন্দুরাও রক্ষা পাচ্ছেনা বর্মী হানাদার বাহিনীর হাত থেকে !

আরাকানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সনাতন ধর্ম্বালম্বী সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ও রক্ষা পাচ্ছেনা বর্মী হানাদার বাহিনীর হাত থেকে। রোহিঙ্গা মুসলমানদের সাথে তাদেরকেও হত্যা, ধর্ষণ, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও উচ্ছেদ করা হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের সাথে হিন্দুরাও আশ্রয় পাওয়ার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের সীমান্তে পালিয়ে এসেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশে আশ্রিত ৭ জন আরাকানী হিন্দু নারীর সাক্ষাতকারের একটি ভিডিও পাওয়া গেছে। সাক্ষাতকারে এসব নারীরা তাদের প্রতি বর্মী বাহিনী ও উগ্রপন্থী রাখাইনের নৃশংসতার বর্ণনা দেন।

সাক্ষাতকারদাতা ৭ নারীর একজন হলেন মংডু জেলার ২ নম্বর ওয়ার্ডের ফকিরা বাজারের নিকুঞ্জের পূত্র রঞ্জিতের স্ত্রী। তিনি বলেন, “রোহিঙ্গারা নয়, আমাদেরকে নির্যাতন করছে মগ ও রাখাইনরা। তারা সেখানে বোমা মারছে, হামলা করছে, কিরিছ দিয়ে মানুষ কাটছে। রোহিঙ্গা মুসলমানেরা আমাদেরকে এখানে আসার জন্য সহযোগিতা করেছে।”
এসময় প্রশ্নকারী তাদের কাছ থেকে জিঙ্গেস করেন, রাখাইন ও মঘেরা তো মুসলমানদের মারছে বলে আমরা জানি, কিন্তু আপনারা পালিয়ে এলেন কেন? এর প্রতি উত্তরে একই এলাকার বিনিশায্যার পূত্র স্বপনের স্ত্রী বলেন, “আমাদের স্বামীদেরকে রাখাইনরা তাদের সাথে যোগ দিয়ে মুসলমানদের হত্যা করার জন্য বলেছিল। কিন্তু আমাদের স্বামীরা তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে আমাদের বিরুদ্ধেও হত্যাকান্ড চালাচ্ছে। অনেক হিন্দুকে তারা মেরে ফেলেছে।”
সাক্ষাতকারদাতা ৭ নারীর অপর ৫ জন হলেন, একই এলাকার মিলনের মেয়ে, মিনিংগ্যার স্ত্রী, বিনন্দের স্ত্রী, ধইল্যা বাইন্যার পূত্র সীমান্ত বাইন্যার স্ত্রী। আরেক নারীর পরিচয় জানার আগে ভিডিওটি শেষ হয়ে যায়।

প্রাপ্ত তথ্যমতে, এসব হিন্দু নারীদের মধ্যে একজনের স্বামী মালয়েশিয়ায় ৩ বছর যাবৎ সেলুনের কাজ করে। আর বাকিদের স্বামী ফকিরাবাজারে সেলুন এবং জুয়েলারী কাজ করতো। তাদের স্বামীরা এখন বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে তা তাদের জানা নেই। বাংলাদেশ যাওয়ার সময় অনেক রোহিঙ্গা তাদের সহযোগিতা করেছেন বলেও জানান।
এদিকে স্টেট কাউন্সিলর দপ্তর থেকে প্রকাশিত স্টেটমেন্ট অনুযায়ী বার্মার বিভিন্ন গণমাধ্যম সংবাদ প্রচার করেছে, আরাকানে ৬ জন হিন্দুকে হত্যা করেছে রোহিঙ্গা স্বাধিকারের জন্য আন্দোলনকারী দল আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা)। কিন্তু বাংলাদেশে আশ্রিত হিন্দু নারীরা বলছে তার বিপরীত কথা। রোহিঙ্গারা নয়, তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছে রাখাইন ও মগসেনারা। এর দ্বারা এটি প্রতিয়মান হচ্ছে যে, হিন্দুদের হত্যা করে তার দায় রোহিঙ্গাদের কাঁধে তোলে দেয়ার অপচেষ্টা চালাচ্ছে সেদেশের সরকার। যাতে রোহিঙ্গা মুসলমানদেরকে বিশ্বের সামনে জঙ্গি হিসেবে পরিচিত করে তোলতে পারে, এবং জঙ্গির বিরুদ্ধে অভিযানের নামে রোহিঙ্গা ও হিন্দুদের গণহত্যা চালানো যায়।

গত ২৪ আগস্ট দিবাগত রাত থেকে শুরু হওয়া বর্মী সামরিক বাহিনীর কিলিং অপারেশনে দুই সহস্রাধীক যেসব নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে. তৎমধ্যে অর্ধশতাধিক হিন্দুও রয়েছে বলে একটি সূত্র জানিয়েছে। তিনি জানান, বেশ কিছু হিন্দু পাড়া পুড়িয়ে দিয়েছে রাখাইনরা। সেখানে প্রচুর ফায়ারিং করেছে সৈন্যরা। তাতে মুসলমানদের সাথে বহু হিন্দুও মারা গেছে। কিন্তু ঘটনাস্থলে যাওয়ার সুযোগ না থাকায় হতাহতের সংখ্যা নিশ্চিত করা মুশকিল।
এপারেও চলছে জুলুম!

জানা গেছে, সীমান্ত পাড়ি দেয়ার সময় রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে অনৈতিক চাঁদাবাজী, ছিনতাই ও ধর্ষণের শিকার হয়েছে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা লোকজন। এরসাথে জড়িত রয়েছে স্থানীয় প্রভাবশালী একটি অসাধুচক্র। যার মধ্য থেকে গতকাল বেলাল নামে একজনকে রোহিঙ্গা যুবতীকে ধর্ষণের দায়ে ৬ মাসের জেল দিয়েছে উখিয়া প্রশাসন। এছাড়াও কাঞ্জর পাড়া এলাকার শামসুর ছেলে বাবুল নামে নামে একজন রোহিঙ্গা নারীদের কাছ থেকে ৭ভরি স্বর্ণসহ পুটলি ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়। এভাবে নির্যাতিত মানুষগুলোর কাছে থাকা বিপদের সম্বলটুকুও কেড়ে নেয় দুস্কৃতিকারীরা। সীমান্তরক্ষী বিজিবি’র হাতে তোলে দেয়ার ভয়-ভীতি দেখিয়ে রোহিঙ্গা রমণীদের নির্জন স্থানে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করার মত জঘন্য অপরাধকান্ডও করে থাকে চক্রটি। এমন কিছু গুরুতর অভিযোগে এসেছে রোহিঙ্গা নারীদের কাছ থেকে।

বলাবাহুল্য, ২০১৬ সালের অক্টোবরে সহিংসতার শিকার হয়ে যখন রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে যাচ্ছিল, তখন শতাধিক রোহিঙ্গা নারীকে শাহপরীর দ্বীপ এলাকার বেশ কিছু অসাধূচক্র জিম্মি করে ধর্ষণ ও পাচার করেছিল।

http://www.dailysangram.com/post/298203