৩১ আগস্ট ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৭:৫০

রোহিঙ্গাদের মুখে লোমহর্ষক নির্যাতনের বর্ণনা

সীমান্তের ওপারে নির্যাতিত রোহিঙ্গারা কঠোর নিরাপত্তা সত্ত্বেও দলে দলে ঢুকছে এপারে। সঙ্গে ছোটখাটো জিনিসপত্রের পাশাপাশি গবাদি পশুও নিয়ে আসছে তারা। বাংলাদেশে প্রবেশ করা রোহিঙ্গারা জানিয়েছে, মিয়ানমারে মগরা রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি তল্লাশি করে মূল্যবান সহায়সম্পদ হাঁস-মুরগি, গবাদিপশু লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে যারা কিছু কিছু জিনিসপত্র ও গবাদিপশু নিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এপারে আসছেন, তারাও রয়েছেন বিপদে। নিজেদেরই থাকার ব্যবস্থা নেই। এসব রাখবেন কোথায়? পদে পদে বিপদ অতিক্রম করে আসা এসব রোহিঙ্গা উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালী, টেকনাফের নয়াপাড়া, লেদা ও শাপলাপুর রোহিঙ্গা বস্তিতে অবস্থান করছেন। রোহিঙ্গা বস্তিগুলোতে আগে থেকে থাকা আত্মীয়স্বজনরা তাদের আশ্রয় দিচ্ছেন। মিয়ানমারে সংঘাতের পর শুক্রবার থেকে সীমান্ত পার হয়ে অনুপ্রবেশ করতে শুরু করে রোহিঙ্গারা। মঙ্গলবার পর্যন্ত কত রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছেন তার সঠিক কোনো তথ্য নিশ্চিত করতে পারেনি সংশ্লিষ্টরা। ইউএনএইচসিআর পক্ষে সোমবার পর্যন্ত তিন হাজারের বেশি নতুন রোহিঙ্গা নিবন্ধিত ক্যাম্পে অবস্থান করার কথা নিশ্চিত করা হয়েছে। তবে রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক কয়েকটি সংস্থার তথ্যমতে, এর বাইরে অনিবন্ধিত ক্যাম্পে অবস্থান করছেন প্রায় ৭ হাজার। এ হিসেবে ১০ হাজার রোহিঙ্গা নতুন করে অনুপ্রবেশ করেছেন। তবে প্রকৃত অর্থে এ সংখ্যা ২৫ হাজারের বেশি বলে দাবি গোয়েন্দা সংস্থা, ক্যাম্প মাঝি ও স্থানীয় বাসিন্দাদের। তবে মিয়ানমারে গত ২৫শে আগস্ট সহিংসতা শুরুর পর মঙ্গলবার পর্যন্ত নতুন করে ১৮ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) প্রধান সংযুক্ত সাহানী। সংস্থার কক্সবাজার অফিসে বুধবার দুপুরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য জানানো হয়।
তিনি বলেন, নতুন আসা রোহিঙ্গাদের জীবন বাঁচাতে সহায়তা দেয়া হচ্ছে। সীমান্তে আরো শত শত রোহিঙ্গা আটকে রয়েছেন। যারা প্রবেশের চেষ্টা করছেন। গতকাল সকাল থেকে দুপুর ৩টা পর্যন্ত পাহাড়ি সীমান্তের আমতলী, গর্জন বনিয়া, ফাত্রাঝিরিসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ভয়াবহ চিত্র লক্ষ্য করা গেছে। এসব রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুক্রবার সকাল থেকে গতকাল পর্যন্ত প্রতিদিন কয়েক দফা করে মিয়ানমার সেনাবাহিনী, বর্ডার গার্ড পুলিশ বা বিজিপি ও স্থানীয় মগ রাখাইনরা যৌথভাবে রোহিঙ্গা মুসলিমপাড়াগুলোয় হামলা চালাচ্ছে। এদের আসতে দেখলে স্থানীয় পাড়াগ্রামের রোহিঙ্গারা নারী শিশুদের নিয়ে পার্শ্ববর্তী জঙ্গল ও পাহাড়ে উঠে আশ্রয় নেন। এসময় তারা রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি তল্লাশি করে যাদের পাচ্ছে তাদের বেদম মারধর করছে, কিরিচ ও চাপাতি দিয়ে রাখাইন ও মগরা রোহিঙ্গাদের কুপিয়ে হত্যা করছে। মিলিটারিরা হয় গুলি করছে, নয়তো বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে গুরুতর আহত করছে। অন্যদিকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ফকিরাবাজার ব্রিগেড থেকে বিভিন্ন রোহিঙ্গা গ্রামের আশপাশে ট্যাংক মোতায়েন করে রেখেছে। মংডু থেকে প্রায় প্রতিদিন কয়েক দফা হেলিকপ্টার এসে ফকিরাবাজার এলাকার বিভিন্ন রোহিঙ্গা মুসলিমপাড়া গ্রামের ওপরে চক্কর দিয়ে গানপাউডার ছিটিয়ে গুলি করে ও রকেট লাঞ্চার ছুটে এবং ট্যাংক থেকে কামানের গুলিবর্ষণ করে হতাহত করছে।
গতকালও দুপুরে কুতুপালং জামগাছের নিচে দেখা মিলে কয়েক শ নতুন আসা রোহিঙ্গার। তার মধ্যে বটতলী এলাকার মোক্তার আহমদ জানান, চার দিন সীমান্তের পারে অবস্থান করে তিনি কুতুপালং এসেছেন। এদিকে সীমান্তে এখনো অপেক্ষা করছে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা।
সীমান্তের আমতলী বিজিবি বিওপি কমান্ডার মো. জসিম উদ্দিন জানান, পাহাড়ি ঝিরি ও ছড়া খাল নিয়ে দুর্গম এ সীমান্ত নিরাপত্তায় নিয়োজিত বিজিবি সদস্যরা সার্বক্ষণিক সতর্ক রয়েছে। যতক্ষণ স্থানীয় লোকজন সচেতন হয়ে দেশের পক্ষে কাজ করতে এগিয়ে না আসবে ততক্ষণ বিজিবির একার পক্ষে সীমান্তের সার্বিক নিরাপত্তা বিধান করা কঠিন। এখানে কোনো রাস্তাঘাট নেই, পায়ে হেঁটে বিজিবিকে পাহাড় ঝিরি, জঙ্গল, খাল, ছড়া ভেঙে দায়িত্ব পালন করতে হয়। সীমান্তের দুর্গম বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে স্থানীয় লোকজন ও দালালদের সহায়তায় রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশ করে থাকতে পারে।

নাফ নদে রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকাডুবি
৪ লাশ উদ্ধার
বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টাকালে কক্সবাজারের টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপে রোহিঙ্গা বোঝাই একটি নৌকা ডুবে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। একই পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশের চেষ্টাকালে ভোর সাড়ে ৫টা পর্যন্ত ৭৫ রোহিঙ্গাকে আটক করে বিজিবির হেফাজতে রাখা হয়েছে।
বুধবার সকালে উপজেলার সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপ সমুদ্রসৈকত এলাকা থেকে চারজনের লাশ উদ্ধার করে স্থানীয় লোকজন।
সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি সদস্য নুরুল আমিন বলেন, রাতের কোনো এক সময় নাফনদে নৌকাটি ঢেউয়ের কবলে পড়ে ডুবে যায় বলে ধারণা করা হচ্ছে। সকালে খবর পেয়ে স্থানীয় লোকজন শাহপরীর দ্বীপ দক্ষিণপাড়া ও মাঝেরপাড়া সৈকত থেকে চারজনের লাশ উদ্ধার করে। ডুবে যাওয়া নৌকাটি অংশ বিশেষ সৈকতের বালুতে আটকে পড়ে রয়েছে। উদ্ধার চার লাশের মধ্যে দুজন নারী ও দুজন শিশুকন্যা রয়েছে।
তিনি বলেন, নৌকাটিতে অন্তত ১৫-২০ জন ছিল। অন্যদের ভাগ্যে কী ঘটেছে এখন কিছুই বলা যাচ্ছে না। লাশ পাওয়ার বিষয়টি স্থানীয় বিজিবি ও পুলিশকে অবহিত করা হয়েছে।
টেকনাফ ২ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল এসএম আরিফুল ইসলাম বলেন, স্থানীয়দের উদ্ধার করা চারজনের লাশসহ ৭৫ জন রোহিঙ্গা নাগরিককে মানবিক সহায়তা দিয়ে যেকোনো সময় মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হবে।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=81193