৩১ আগস্ট ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৭:৪৭

মুক্ত জীবন-রুদ্ধ প্রাণ

নির্বাচনের সৌন্দর্য বজায় রাখতে হবে

বাংলাদেশের সংবিধানে উল্লেখিত এক হিসাব অনুযায়ী জাতীয় সংসদের নির্বাচন আগামী বছরের শেষপ্রান্তে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। আরেক হিসাব অনুযায়ী যে কোনো সময় এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে, তবে তা প্রধান নির্বাহীর ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। অবশ্য এর সবকিছুই নির্ভর করবে বিকাশমান রাজনীতির গতিধারার ওপর। যেহেতু নির্বাচনের সৌন্দর্য নিয়ে দুটি বড় পক্ষের মধ্যে এখনও কোনো সমঝোতা হয়নি বা সমঝোতা দৃশ্যমান নয়, তাই অনিশ্চয়তা থেকেই যায়। সাম্প্রতিক সময়ে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী সম্পর্কে সুপ্রিমকোর্টের রায়ের পর বেশকিছু ঝামেলা দেখা দিয়েছে। কেউ কেউ নির্বাচনের বাইরে ভিন্ন ব্যবস্থার কথাও বলেছেন। সেসব ভিন্ন কথা।

নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নতুন করে কিছু কথা আবার সামনে আসছে। সম্প্রতি বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা যে বলবে তার হাত পুড়ে যাবে। এ হাত পুড়ে যাওয়ার বিষয়টি সামনে এলো কেন? তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টি নিয়ে কি কেউ আলোচনা তুলেছে? যাদের উদ্দেশ করে তিনি এ মন্তব্য করেছেন, সেই প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি তো এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলছে না, বলছে সহায়ক সরকারের কথা। যখন সহায়ক সরকারের রূপরেখা প্রকাশিত হবে তখন এ বিষয়ে আলোচন করা যাবে।

বাণিজ্যমন্ত্রী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলে পুরনো স্মৃতিকে উসকে দিয়েছেন। ১৯৯৫-৯৬ সময়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিরোধী দলগুলো ক্ষমতাসীন বিএনপির বিরুদ্ধে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে যে আন্দোলন করেছিল, বর্তমানে অনেকেই হয়তো তা ভুলে গেছেন। এমন কোনো হিংসাশ্রয়ী পদ্ধতি ছিল না যা ওই আন্দোলনে ব্যবহৃত হয়নি। জ্বালাও-পোড়াও থেকে শুরু করে হরতাল, গুলি, হত্যা সবকিছুই হয়েছে সে আন্দোলনে।

অবশ্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ফর্মুলা আওয়ামী লীগের উদ্ভাবন নয়। এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় এ প্রস্তাব উত্থাপন করেন জামায়াত নেতা গোলাম আযম। এরশাদের পতনের পর যে নির্বাচন হয়েছিল তখনও এ প্রস্তাব নিয়ে কেউ তেমন একটা উচ্চবাচ্য করেননি। কিন্তু ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর আওয়ামী লীগ উপলব্ধি করে বিদ্যমান ব্যবস্থানুযায়ী ভবিষ্যতে যখন দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে তখন তারা জয় নিশ্চিত করতে পারবেন না। কারণ, ভোটের মাঠে তাদের মোকাবেলা করতে হবে ক্ষমতাসীনদের লোকবল ও পেশিশক্তিকে। এর সঙ্গে যুক্ত হবে প্রশাসন। তাই এমন একটি সরকারব্যবস্থা প্রয়োজন যেখানে এ তিনটি ক্ষেত্রে তারা সমানভাবে প্রতিপক্ষের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারেন। সে জন্যই সংবিধানবহির্ভূত জেনেও তারা এ আন্দোলন করেছিলেন।

ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! এ আওয়ামী লীগই ক্ষমতায় গিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপ করল। অজুহাত- তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চরিত্রহীন হয়ে গেছে। তাতেও হয়তো অসুবিধা ছিল না। কিন্তু আদালত যে তার হাত-পা বেঁধে দিয়েছেন, তাই কিছু করার ছিল না। বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের সমন্বয়ে গঠিত সংসদের ক্ষমতা আদালত কতখানি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, অতি সম্প্রতি তা আবারও প্রকাশিত হয়েছে।

আগামী নির্বাচন সম্পর্কে ইতিমধ্যে অনেক কথা চালাচালি হচ্ছে। নতুন নির্বাচন কমিশন একটি সুন্দর নির্বাচনের আশায় বিভিন্ন মহলের সঙ্গে সংলাপ করছেন। এ সংলাপ প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে বেশকিছু মন্তব্য এসেছে, যা যুক্তি বা নৈতিকতার বিচারে গ্রহণযোগ্য নয়। তবে সর্বশেষ যে বক্তব্য, অর্থাৎ পর্দার আড়ালে তারা দূতিয়ালি করতে পারেন, এমন কথায় মনে হচ্ছে তারা সমস্যাটা কিছুটা হলেও উপলব্ধি করেছেন। আবার অংশীদারদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনঃনির্ধারণের উদ্যোগ গ্রহণ করে ঝামেলা পাকাতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন।

সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রত্যাশা প্রত্যেক মানুষের। দলীয় সরকারের অধীনে এমন একটি নির্বাচন সম্ভব নয় সেটা তারা জানেন। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনে অনিয়ম, ডাকসু নির্বাচনে ব্যালট বাক্স ছিনতাই- এ ঐতিহ্য আওয়ামী লীগই সৃষ্টি করেছে।

নির্বাচনের সৌন্দর্য বজায় রাখতে হলে নির্বাচনের যে ক’টি পক্ষ আছে তাদের মাঝে সমঝোতা প্রয়োজন। সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ক্ষমতাসীন সরকারের অঙ্গীকার। বর্তমান সরকারের আমলে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনে যা ঘটেছে তাতে পরিচ্ছন্ন নির্বাচনের সম্ভাবনা সম্পর্কে অনেকেই শঙ্কিত। দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব একথা বলে সরকার কতগুলো মেয়র নির্বাচনের উদাহরণ টানে। এর জবাব সোজা। সংবিধানে ব্যক্তির মতপ্রকাশের যে স্বাধীনতা দেয়া আছে তা ব্যক্তির নয়, সরকারের স্বাধীনতা। এ আইন দিয়ে তারা স্বাধীনতা নির্ধারণ করে দিতে চান। মেয়র নির্বাচনেও সুষ্ঠুতার দাবি সেরকমই। আমি চেয়েছি বলেই সুষ্ঠু হয়েছে, অন্যথায় হতো না। আমিই নির্বাচনের সুষ্ঠুতা ঠিক করে দেব।

নির্বাচনী সৌন্দর্য নিশ্চিত করতে হলে নির্বাচনপূর্ব পরিবেশকে কথার আক্রমণ দিয়ে বিষিয়ে তোলার কিছু নেই। নির্বাচনী সৌন্দর্যের জন্য নির্বাচন কমিশন ও সরকারকে অনেক কিছুই করতে হবে। সেসব ব্যবস্থার তালিকা বেশ দীর্ঘ।

জাতিসংঘের মানবাধিকার সম্পর্কিত সার্বজনীন ঘোষণাপত্রের ২১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, জনগণের ইচ্ছাই হবে সরকারের কর্তৃত্বের ভিত্তি এবং এ ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটবে নিয়মিত ভিত্তিতে সত্যিকারের নির্বাচনের মাধ্যমে, যেখানে সার্বজনীন ভোটাধিকার প্রদত্ত হবে গোপন ভোটের মাধ্যমে। বাংলাদেশ এ ঘোষণাপত্রকে অনেক আগেই মেনে নিয়েছে।

এদেশে গণতন্ত্রের কথা বলা হয়। কিন্তু গণতন্ত্র যে নেতা নির্বাচনের স্বাধীনতা দেয় সে কথা কেউ মানতে চান না। গণতন্ত্রে নির্বাচনই নাগরিকদের নেতা নির্বাচনের স্বাধীনতা দেয়। তাই একদিনের জন্য হলেও নির্বাচনের সময় ক্ষমতা যায় জনগণের হাতে। এ স্বাধীনতার অবর্তমানে জাতীয় জীবনে যে বিপর্যয় নেমে আসে তার উদাহরণ অনেক দেশেই আছে। নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ শুধু নেতাই নির্বাচন করেন না, দেশের ভবিষ্যৎ চলার পক্ষেও রায় দেন। এসবই তাত্ত্বিক কথা। বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও নির্বাচনের এ ব্যাখ্যা অনেকেই মেনে নেবেন না। আগামী নির্বাচনেও এ অবস্থার পুনরাবৃত্তি হতে পারে। যদিও মুখে একটি সুন্দর নির্বাচনের কথা বলা হচ্ছে।

সবশেষে যে কথাটি গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে শত আবেদন-নিবেদনের পরও যদি বর্তমান ব্যবস্থায় নির্বাচন হয় এবং সে নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল যদি হেরে যায়, তাহলে তারা কি সেই পরাজয় মেনে নেবেন? যারা জিতে যাবেন তাদের জন্য এ প্রশ্ন প্রযোজ্য নয়। ক্ষমতায় থেকে নির্বাচনী রায় মেনে না নিলে কী হয় সেটা ১৯৭১ সালে আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। ক্ষমতাসীন দলের চেয়ে এ কথা আর কেউ ভালো করে জানে না।

নির্বাচনের সৌন্দর্য কোনো অলীক কল্পনা নয়। বাস্তবতা হচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলোকে এটা মেনে নিতে হবে। ক্ষমতার ঔদ্ধত্য নিয়ে দেশ শাসন করলে তা শেষ পর্যন্ত হিতকর হয় না।

মাহফুজ উল্লাহ : শিক্ষক ও সাংবাদিক

http://www.jugantor.com/sub-editorial/2017/08/31/152529