৩১ আগস্ট ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৭:৪৭

বিচারটা না হয় জনগণই করুক

বিবিধ প্রসঙ্গ

মাসুদ মজুমদার


ক’দিন আগেও পরিস্থিতি ছিল সরকারের একক নিয়ন্ত্রণে। পরিস্থিতি পাল্টেছে। কারো ধারণা ঘন ঘোর অন্ধকারের দিকে দেশ এগোচ্ছে। কেউ মনে করেনÑ সরকার কোণঠাসা। সব প্রতিক্রিয়ায় ভাটার টান, সব হাঁকডাক ভীতির গান। তারপরও সবাই মনে করেন, কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। যাই ঘটুক, পরিস্থিতি ঘোলাটে। তাই দুর্বিষহ এবং অনিশ্চিত পরিবেশ-পরিস্থিতির মধ্যে আমাদের বসবাস। সবার মনে একটা প্রশ্নÑ কী হতে যাচ্ছে। মানুষের মন যখন কু-গায়, তখন কিছু একটা ঘটেই যায়। বিশেষত বিচার বিভাগের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে নির্বাহী বিভাগ। দেশের ইতিহাসে এমন পরিস্থিতি নজিরবিহীন। সাবেক বিচারপতি খায়রুল হক এবং শামসুদ্দিন মানিক ছাড়া আইন, বিচার ও যুক্তি মেপে চলেন এবং বলেন; এমন কোনো মানুষ আপিল বিভাগের রায় ও পর্যবেক্ষণ নিয়ে প্রান্তিক মন্তব্য করেননি। আওয়ামী লীগ নেতাদের কথা আলাদা। সুশীল ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার জগতের কোনো মানুষ রায় ও পর্যবেক্ষণ নিয়ে প্রান্তিক মন্তব্য করেননি। উল্টো সহমত পোষণ করেছেন। পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থানটা রাজনীতিবিদদের। সাবেক অন্য কোনো বিচারপতিও লাগামহীন মন্তব্য করে ওপরের দিকে থু থু ছিটাননি। রায়ের পর্যবেক্ষণ নিয়ে ুব্ধ হতে পারত বিএনপি-জাতীয় পার্টি। আওয়ামী লীগ নানা কারণে ুব্ধ। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কথা বলাটা আবেগ ছড়ানোর অর্থহীন চেষ্টা। তাদের ধৈর্যের বাঁধ অনেক আগেই টুঁটে গেছে। সন্দেহবাতিক ঐতিহ্যবাহী দলটিকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। নিজেদের ছায়া দেখলেও তারা আতঙ্কিত হয়ে উঠছেন। যে রায়ের পর্যবেক্ষণে বিএনপি-জাতীয় পার্টির মুখ খোলার কথাÑ সেখানে আওয়ামী লীগ এতটাই বেসামাল হয়ে পড়েছে কেন, সেটা রীতিমতো গবেষণার বিষয়। শামসুদ্দিন মানিকের বিচারিক সক্ষমতা ও সাধারণ ভদ্রতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিএনপি নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। শামসুদ্দিন মানিক ব্যক্তিগত আক্রোশটা আড়ালে রাখতে পারেননি। তাই এস কে সিনহাকে দেশছাড়া করতেই পারেন। তার আচরণে এটি প্রতিষ্ঠিত যে ক্ষ্যাপাটে আচরণ তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। তার ব্যাপারে প্রশ্নটি না তুললে আইনের শাসনে বিশ্বাসী সব মানুষ দায়বদ্ধ থেকে যেতেন। বর্তমান প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে যারাই অসহিষ্ণু মন্তব্য করেছেনÑ তারা নিজেদের বিবেকের কাছেই ছোট হয়ে গেছেন।

এখন পর্যন্ত এস কে সিনহা ব্যক্তি নন, প্রধান বিচারপতি। যার প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা রয়েছে। দেশের হাতেগোনা ক’জন দলবাজ ছাড়া আর কোনো মানসম্পন্ন বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী, সংবিধান বিশেষজ্ঞকে প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে অরুচিকর মন্তব্য করতে শুনিনি; বরং সবাই বলছেন, অ্যাটর্নি জেনারেলের অবিন্যস্ত ও যুক্তিহীন যুক্তিতর্ক খণ্ডন করে রায়ের সাথে আপিল বিভাগ একটি দীর্ঘ পর্যবেক্ষণ দিতে বাধ্য হয়েছেন। যার ভেতর দেশ-জাতির বাস্তব পরিস্থিতি দলমতের ঊর্র্ধ্বে নির্মোহভাবে উঠে এসেছে। সব পর্যবেক্ষণের সাথে সব লোক একমত হওয়া জরুরি নয়। তবে পর্যবেক্ষণের অদৃশ্য বিড়াল ইঁদুর ধরতে পেরেছেÑ এটাই বড় কথা। এখন পর্যবেক্ষণ থাকল কি থাকল নাÑ সেটা গৌণ বিষয়।

একজন বাংলাদেশী নাগরিক এস কে সিনহার ব্যক্তিগত কপাল মন্দ কি না, সময় বলে দেবে। তিনি দেশ ছাড়তে বাধ্য হবেন, না শামসুদ্দিন মানিক পালাবেনÑ সেটাও সময়ের হাতে। শামসুদ্দিন চৌধুরীর মতো হঠকারী বক্তব্য দিলে, প্রধান বিচারপতিকে ছুটি শেষে আদালতে বসতে না দিলে, দল, দেশ ও রাজনীতি ডোবানোর জন্য আর বাড়তি কারো প্রয়োজন পড়বে না। কারণ শামসুদ্দিন চৌধুরী ইতোমধ্যে প্রধান বিচারপতিকে আদালতে বসতে না দেয়ার আবদার করেই বসেছেন। তবে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদায় টান দিলে হাত পুড়ে যাবে। সেটা ব্যক্তিগত বিষয় থাকবে না। এখনো আমরা জানি না প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গওহর রিজভীর দূতিয়ালির ফর্র্মুলা কী ছিল। ‘কাদের মিশন’ সম্পর্কেও জাতি অন্ধকারে। রাষ্ট্রপতির অবস্থান সম্পর্কে কারো ধারণা স্পষ্ট নয়। তবে আওয়ামী লীগ দল হিসেবে যে দিকেই হাঁটুক, নতুন করে কিছুই অর্জন করবে না। যা হারিয়েছে তা আর দলের কাছে ফিরে আসবে না। এস কে সিনহাকে নিয়ে যারাই বাড়াবাড়ি করুক, সব ক্ষেত্রে ভুল বার্তা যাবে। তাকে জোর করে ছুটিতে পাঠালে, অবসরে যাওয়া পর্যন্ত কাজ করতে না দিলে কিংবা এনবিআর, দুদকÑ বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে খোঁচাতে গেলেও আওয়ামী লীগের জেদের রাজনীতির খেসারত হবে পয়েন্ট হারানো। এস কে সিনহা কতটা ধোয়া তুলসিÑ তা মাপতে চাইলেও আওয়ামী লীগের ক্ষতির মাশুল বাড়বে। তাকে বিশেষ বিবেচনায় আওয়ামী লীগ সরকারই প্রধান বিচারপতির আসনে বসিয়েছে।

এখন পর্যন্ত দেশ জাতির জন্য কল্যাণজনক পথ একটাই খোলা আছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনের জন্য এমন পরিবেশ সৃষ্টি করে দেয়া, যাতে সব দল আস্থার সাথে নির্বাচনে গিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অবারিত সুযোগ পায়। সে লক্ষ্যে জাতিকে নির্বাচনমুখী করে তোলাই আওয়ামী লীগের জন্য অধিকতর মঙ্গলজনক। গ্রহণযোগ্য নির্বাচন রাজনীতিকে স্থিতি দেবে। ক্ষোভ-দুঃখ সব ভোটের বাক্সে ঢুকবে। এটি নিরাপদ অবতরণের সবচেয়ে মসৃণ রানওয়ে।
জেদ ও গাঁজার নৌকা নাকি পাহাড় ডিঙাতে পারে, বাস্তবে পারে না। হ্যাঁ, আওয়ামী লীগ আট বছরের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো চরম হতাশায় নিমজ্জিত। সরকারের কার্যকর প্রাতিষ্ঠানিক গ্রন্থি শিথিল হয়ে গেছে। সাজানো সেটআপ আগের মতো কাজ করবে না। এখন যেকোনো নেগেটিভ কাজকে জনগণ ধরে নেবে প্রতিহিংসাপরায়ণতা ও যুক্তিহীন জেদ হিসেবে, যা ভোটের রাজনীতির জন্য আত্মঘাতী হয়ে যাবে।

সরকার সোজা পথ চিনতে না চাইলে ভাগ্য বেঁকে বসবে। সুযোগ নেবে যেকোনো তৃতীয় পক্ষ। সে ক্ষেত্রে জনগণের সামনে ‘স্বাগতম’ বলা ছাড়া আর কিই বা করার থাকবে। তলস্তয় প্রায়ই বলতেন, অল্পে তুষ্ট মানুষের জীবন মধুুময় হয়। শেখ সাদির ভাষায় মানোত্তীর্ণ মানুষের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে অল্পে তুষ্টি এবং ধৈর্য। আওয়ামী লীগের সামনে এখন ধৈর্যের কোনো বিকল্প নেই। আওয়ামী লীগ প্রবীণ দল। আমরা চাই টানা এত দিন ক্ষমতাচর্চার পর দলটি দেখে এবং ঠেকে শিখুক। বারবার ক্ষমতায় আসুক। কিন্তু রগচটা মেজাজ আর মাস্তানি দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে নয়। কারণ পেছনে তাকিয়ে দেখুন, বিগত আট বছর দলটি ক্ষমতাচর্চা করতে গিয়ে কত বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি করেছে। কত মানুষের জীবনকে বিষিয়ে তুলেছে। অনেক সমর্থক বিগড়ে গেছে। অনেক সুহৃদ আর বন্ধু নেই। সুবিধাভোগীরা পার্শ্বপরিবর্তন করতে শুরু করেছে। বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্তরা প্রতিপক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়ে নিয়েছে। প্রয়োজনে রায়ের পর্যবেক্ষণের ওপর জরিপ চালিয়ে দেখুন, ক্ষমতার বরফই শুধু গলে যায়নিÑ প্রতিপক্ষ ও ভিন্নমতের প্রতি জনগণের সহমর্মিতা বিন্দু থেকে সিন্ধুতে পরিণত হয়েছে। তারপরও সব বিতর্কের অবসান ঘটাতে অভিযোগ নিয়ে জনতার আদালতে যাওয়াই সবার জন্য কল্যাণ, বিচারটা না হয় জনগণই করুক।হ
masud2151@gmail.com

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/248522