৩১ আগস্ট ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৭:৩১

দুর্ভোগে ঢাকা ছেড়েছেন ঈদে ঘরমুখো মানুষ

যান ও ফেরিজটের কারণে সিডিউল রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন বাস মালিকরা * নির্ধারিত সময়ে ছাড়েনি অন্তত ছয়টি ট্রেন * যানজট হবে না, এ নিশ্চয়তা দিতে পারি না -ওবায়দুল কাদের

দুর্র্ভোগের মধ্যেই ঈদ উদযাপন করতে ঢাকা ছেড়েছেন ঘরমুখো মানুষ। বাস, ট্রেন ও লঞ্চ টার্মিনালে দেখা গেছে যাত্রীদের বাড়তি চাপ। যানজট ও ফেরিঘাটে গাড়ির চাপ বেশি থাকায় প্রতিটি বাস ঢাকায় ঢুকতেই ৬-১০ ঘণ্টা দেরি হচ্ছে। ফলে সিডিউল ধরে রাখতে পারছে না বাস কোম্পানিগুলো। এছাড়া বাসে রয়েছে বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ। নির্ধারিত সময়ে ছাড়েনি অন্তত ছয়টি ট্রেন। এছাড়া আগাম টিকিট বিক্রির সময়ে যাত্রীরা ট্রেনের টিকিট না পেলেও মঙ্গলবার অনেকেই পেয়েছেন। আর ঢাকার ভেতরেও দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে যাত্রীদের। যানজটের পাশাপাশি ঈদ বকশিশের নামে সিএনজি অটোরিকশাগুলো আদায় করছে গলাকাটা ভাড়া। মঙ্গলবার ঘরমুখো যাত্রীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে এসব তথ্য। যাত্রীরা জানান, কাল বৃহস্পতিবার সরকারি ও বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠান ছুটি হবে। তখন ভোগান্তি আরও বাড়বে। তাই আগেভাগেই প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদ আনন্দ উপভোগ করতে ঢাকা ছাড়ছেন তারা। এখন পর্যন্ত দুর্ভোগ সহনীয় পর্যায়ে আছে বলেও স্বস্তি প্রকাশ করেন তারা।
এদিকে ঘরমুখো যাত্রীদের অবস্থা পরিদর্শন করেছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং রেলপথমন্ত্রী মুজিবুল হক। মঙ্গলবার ঢাকার সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে ভিজিলেন্স টিমের কার্যক্রম পরিদর্শনে গিয়ে ওবায়দুল কাদের জানান, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সড়কগুলো গাড়ি চলাচলের উপযোগী করা হয়েছে। তাই ঈদযাত্রায় রাস্তাঘাট নিয়ে তিনি মোটেও চিন্তিত নন। রাস্তা বা সড়কের জন্য যানজট হবে না। কিন্তু যানজট হবে না- এ নিশ্চয়তা আমি দিতে পারি না। মন্ত্রী আরও জানান, যাত্রীদের চলাচলের সুবিধার্থে সড়ক ও মহাসড়কে আজ বুধবার থেকে ভারি যান চলাচল বন্ধ থাকবে। অপরদিকে যাত্রীদের আশ্বস্ত করে রেলপথমন্ত্রী বলেছেন, এবার ঈদে সিডিউল বিপর্যয়ের কোনো আশঙ্কা নেই। তবে মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত ছেড়ে যাওয়া ৩০টি ট্রেনের মধ্যে দুটি কিছুটা দেরিতে ছেড়েছে। এদিকে নির্ধারিত সময়ে কয়েকটি পরিবহনের গাড়ি ছাড়তে না পারা ও বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ করেছেন কয়েক যাত্রী। দিনাজপুরের হিলির যাত্রী আরেফিন সিদ্দিক বলেন, হানিফ পরিবহনের হিলির বাস বেলা দু’টায় ছাড়ার কথা ছিল, তা আড়াইটায় ছেড়েছে। সকালের বাসগুলোও কমবেশি আধাঘণ্টা দেরিতে ছেড়েছে। আরেক যাত্রী জাহিদুর রহমান অভিযোগ করেন, রাজধানীর জিগাতলার কাউন্টার থেকে ঢাকা-লক্ষ্মীপুর রুটের ইকনো পরিবহনের ভাড়া দ্বিগুণ নেয়া হচ্ছে। সাধারণ সময়ে ঢাকা-লক্ষ্মীপুরের ভাড়া ৩৫০ টাকা। মঙ্গলবার সেই টিকিটই বিক্রি করা হয় ৭৫০ টাকায়। তিনি জানান, একইভাবে ঢাকা-নোয়াখালী রুটের রয়েল, হিমাচলসহ বেশ কয়েকটি পরিবহনে দ্বিগুণ ভাড়া নেয়া হচ্ছে। যাত্রীরা আরও অভিযোগ করেন, ঢাকা-যশোর রুটের পর্যটক পরিবহনে সাধারণ সময়ে রাজবাড়ী, নড়াইলের যাত্রীও নেয়া হয়। কিন্তু এখন যাত্রী যেখানেই যাক, যশোরের ভাড়া নেয়া হচ্ছে। এদিকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগে সায়েদাবাদে দোলা পরিবহনকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করেছে ভিজিল্যান্স টিম। ওই পরিবহনের কাউন্টার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। পরিবহন মালিকেরা জানান, ঢাকা থেকে নির্ধারিত সময়ে বাস ছাড়তে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। বেশ কয়েকটি কোম্পানি নির্ধারিত সময়ে গাড়ি ছাড়তে পারেনি। এতে ঢাকাতেই যাত্রী ভোগান্তি হয়েছে। পরিবহন কর্তৃপক্ষও বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছেন। বাস মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ও সোহাগ পরিবহনের মালিক ফারুক তালুকদার সোহেল বলেন, সময়মতো গাড়ি ছাড়তে পারছি না। দৌলতদিয়া ফেরিঘাটে বাস ও ট্রাকের দীর্ঘ যানজট থাকায় খুলনা ও বরিশাল বিভাগের জেলাগুলো থেকে ঢাকায় গাড়ি আসতে অতিরিক্ত ৮-১০ ঘণ্টা সময় লাগছে। ফেরিতে গরুবাহী ট্রাক বেশি পারাপার করায় এ অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। এ কারণে বাসের সংকট দেখা দিয়েছে। তবে ঢাকা থেকে ওই সব জেলায় যেতে খুব বেশি সময় লাগছে না। গাবতলীতে ঈগল পরিবহনের টিকিট বিক্রেতা মহব্বত আলী বলেন, সড়ক ও ফেরিঘাটে যানজট থাকায় বরিশাল থেকে একটি বাস ঢাকায় আসতে ৬ ঘণ্টার স্থলে ১৬-১৮ ঘণ্টা লাগছে। এতে সিডিউল রক্ষা করা কঠিন হচ্ছে। হানিফ পরিবহনের যাত্রীরা জানান, বেশ কয়েকটি রুটের গাড়ি আধাঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা দেরিতে ছেড়েছে। এ বিষয়ে হানিফ পরিবহনের জেনারেল ম্যানেজার মোশাররফ হুসেন বলেন, গাড়ির চাপ বেড়ে যাওয়ায় সড়কে গতি কমে গেছে। এ কারণে উত্তরাঞ্চলের গাড়িগুলোতে ৪-৫ ঘণ্টা অতিরিক্ত সময় ব্যয় হচ্ছে। ফলে দু’-একটি বাস নির্ধারিত সময়ে ছাড়তে পারিনি। তিনি বলেন, আমরা অনেক বাসের আগাম টিকিট বিক্রি করিনি। তাই কোনো গাড়ি ঢাকায় ফিরতে দেরি হলে ওই স্থলে বসে থাকা আমাদের অন্য একটি বাসে যাত্রী পাঠিয়ে দিচ্ছি। তিনি আরও বলেন, যখনই বাস ঢাকায় ঢুকছে, ওই বাসের টিকিট বিক্রি করা হচ্ছে। তাৎক্ষণিক গন্তব্যে চলে যাচ্ছে। আবার অনেকেই ট্রেনের টিকিট পাওয়ায় বাসের টিকিট ফেরত দিচ্ছে। মঙ্গলবার সরেজমিনে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে গিয়ে দেখা গেছে, ঘরমুখো মানুষ ব্যাগ-লাগেজ নিয়ে অপেক্ষা করছেন কাক্সিক্ষত ট্রেনের জন্য। অনেকেই ট্রেন ছাড়ার কয়েক ঘণ্টা আগেই স্টেশনে এসেছেন। প্রতিটি ট্রেন আসার পরই যাত্রীদের ওঠার প্রাণান্তকর চেষ্টা করতে দেখা গেছে। খুলনার যাত্রী আবদুস সালাম জানান, সুন্দরবন ট্রেন সকাল ৬টা ২০ মিনিটে ছাড়ার কথা থাকলেও ৮টায় তা ছাড়েনি। তবে ঈদের আগাম টিকিট বিক্রির সময়ে কাউন্টার থেকে টিকিট পাওয়া না গেলেও মঙ্গলবার তা বিক্রি করতে দেখা গেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, আগাম টিকিট বিক্রির সময়ে বিভিন্ন জনের নামে ওই সব টিকিট সার্ভারে ব্লক করে রাখা হয়েছিল। কিন্তু অনেকেই টিকিট সংগ্রহ না করায় তা আবার কাউন্টার থেকে বিক্রি করা হচ্ছে। রাজশাহীগামী বিপ্লব নামের এক যাত্রী জানান, কাউন্টারে কয়েক মিনিট দাঁড়াতেই সিল্কসিটির (টিকিট নম্বর ০৬৭৫৭১৫৩) দুটি টিকিট পেয়েছেন। তিনি অবাক হয়ে বলেন, টিভি ও পত্রিকায় দেখেছি, হাজার হাজার মানুষ লাইনে দাঁড়িয়েও ২৯ আগস্টের টিকিট পাননি। তাহলে এসব টিকিট এলো কোথা থেকে? একইভাবে টিকিট সংগ্রহ করেছেন মুন্সীগঞ্জের এমদাদুল উলুম মাদ্রাসার ছাত্র আব্দুল আউয়াল। তার টিকিট নম্বর ০৬৭৫৭১৫৪। একইভাবে কাউন্টার থেকে সিলেটগামী জয়ন্তিকা ট্রেনের আসনের টিকিট পেয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শুভ্র। তারা সবাই শোভন চেয়ারের টিকিট পেয়েছেন। টিকিট বিক্রেতারা জানান, অনেক ট্রেনের এসি টিকিটও রয়েছে।

আবার অনেক ট্রেনের কোনো ধরনের সিট নেই। তবে সব ট্রেন ছাড়ার আধাঘণ্টা আগে স্ট্যান্ডিং টিকিট বিক্রি করা হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সুন্দরবন ট্রেন ভোর ৬টা ২০ মিনিটে ছাড়ার কথা থাকলেও তা ২ ঘণ্টা ৫ মিনিট দেরিতে ৮টা ২৫ মিনিটে ছেড়েছে। এছাড়া দেওয়ানগঞ্জ ট্রেন ৮টার স্থলে ৮টা ৫০ মিনিটে, নীলসাগর ৮টার স্থলে ১০টা ৫ মিনিটে, অগ্নিবীণা ৯টা ৪৫ মিনিটের স্থলে ১০টা ৪০ মিনিটে, সিল্কসিটি ২টা ৪০ মিনিটের স্থলে ৩টা ২০ মিনিটে ছেড়েছে। এছাড়া চিত্রা এক্সপ্রেসও ছাড়তে দেরি হয়েছে। কমলাপুর রেলওয়ের স্টেশন ম্যানেজার সিতাংশু চক্রবর্তী যুগান্তরকে বলেন, নিয়ম মেনেই টিকিট বিক্রি করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম করা হচ্ছে না। তিনি জানান, দু-একটি ট্রেন কিছুটা বিলম্বে ছেড়েছে। বাকি সব ট্রেন নির্ধারিত সময়ে গন্তব্যে ছেড়ে গেছে। সদরঘাটে দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোর যাত্রীদের চাপ ছিল মোটামুটি। বাড়তি যাত্রী বহনে সদরঘাট ও আশপাশের ঘাটগুলোতে শতাধিক লঞ্চ ছিল অপেক্ষমাণ। বিআইডব্লিউটিএর যুগ্ম পরিচালক জয়নাল আবেদিন জানান, সাধারণ সময়ের চেয়ে এখন যাত্রীচাপ বেশি। ক্রমেই তা আরও বাড়বে। আমাদের সেই প্রস্তুতি রয়েছে। তিনি জানান, সোমবার গভীর রাত পর্যন্ত ৯১টি লঞ্চ বরিশাল, পটুয়াখালী, ভোলাসহ দক্ষিণাঞ্চলের উদ্দেশে ছেড়ে গেছে। মঙ্গলবার বিকাল ৫টা পর্যন্ত ৩৬টি লঞ্চ যাত্রী নিয়ে ছেড়ে গেছে।

http://www.jugantor.com/last-page/2017/08/30/152214