৩১ আগস্ট ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৭:২২

ভারতীয় গরুর দাপটে উৎকণ্ঠায় খামারিরা

রাজধানীতে প্রচুর গরু, বেচাকেনা নেই

রাজধানীর কোরবানির পশুর হাটে এখনো বেচাকেনা জমে উঠেনি। তবে গরু-ছাগলের আমদানি হয়েছে প্রচুর। দেশী গরুর পাশাপাশি ভারতীয় গরুতে বাজার বোঝাই হয়ে গেছে। প্রতিবারের মতো দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ইতোমধ্যে ট্রাকের পর ট্রাক ভর্তি গরু-ছাগল আসছে। এখনো পথে রয়েছে আরো শত শত ট্রাক। ভারতজুড়ে এবার বন্যা থাকায় সেখান থেকে বিপুল গরু এসেছে। ফলে এ বছর কোরবানির পশুর কোনো সঙ্কট হবে না বলে ব্যবসায়ীরা ধারণা করছেন। তবে ভারতীয় গরু আসায় দেশী খামারিরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

এ দিকে রাজধানীর বিভিন্ন হাটে সর্বোচ্চ ১২-১৪ লাখ টাকা দামের গরু উঠেছে। সেগুলো দেখার জন্য দর্শকদের ভিড় থাকলেও এখনো কোনো ক্রেতা নজরে আসেনি। হাটগুলোতে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে গরু কিনলে ছাগল ফ্রি, কসাই ফ্রি, হোম ডেলিভারি ফ্রি ইত্যাদি অফার দেয়া হচ্ছে। এ ছাড়াও রাজধানীর আশপাশে গড়ে ওঠা বেশ কিছু গরুর খামারে বিদেশী উন্নতজাতের গরু বেচাকেনা হচ্ছে। যেগুলোর দাম ১৬ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত রয়েছে। ধনাঢ্য ব্যক্তিরা খামার থেকেই সরাসরি এসব গরু কিনে নিচ্ছে।

রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় ২৪টি হাট ইজারা দেয়া হয়েছে। এরমধ্যে বেশ কয়েকটি হাট টেন্ডার আহ্বান ছাড়াই দলীয় বিবেচনায় দেয়া হয়েছে। এর বাইরেও অলিগলিতে অবৈধভাবে স্থানীয় সরকার দলীয় প্রভাবশালীরা হাট বসিয়েছেন। সিটি করপোরেশনের নিয়ম অনুযায়ী ঈদের দিনসহ মোট চার দিন হাটে গরু-ছাগল আনার কথা থাকলেও এবার সাত-আট দিন আগে থেকেই পশু আসতে শুরু করে। এ কারণে হাটের সীমানা ছাড়িয়ে রাস্তা পর্যন্তও চলে গেছে। উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জেলায় বন্যার কারণে আগেই তারা গরু আনতে শুরু করেন বলে ব্যবসায়ীদের সূত্রে জানা যায়। তবে ঈদের আর মাত্র চার দিন বাকি থাকলেও কেনাবেচা তেমন জমেনি। মূলত রাজধানীতে গরু-ছাগল রাখার জায়গার সঙ্কটের কারণেই বেশি আগে কিনতে চান না কোরবানিদাতারা। তবে যাদের রাখার জায়গা আছে তারা পশু কেনা শুরু করেছেন। কয়েকটি হাট ঘুরে দেখা গেছে, হাটে দেশী গরুর সরবরাহই বেশি। দামও বেশ চড়া। ৬০-৭০ হাজার থেকে শুরু করে ১০-১২ লাখ টাকার গরু এনেছেন ব্যবসায়ীরা।
গাবতলী পশুহাটে ঢুকে এগোতেই বাঁ দিকে দেখা গেল বিশাল জটলা। একটা গরুকে ঘিরে আছে জনাপঞ্চাশেক ছেলে-বুড়ো ও মাঝবয়সী মানুষ। এগোতেই দেখা গেল বিশালাকৃতির একটি গরু। এটাই নাকি এ হাটের সবচেয়ে বড় গরু। ক্রেতা-দর্শনার্থীর এত আগ্রহের কারণ এটাই। গরুটি হাটে এনেছেন কুষ্টিয়ার দুর্বাচারা গ্রামের খামারি রুজদার বিশ^াস। কালো-হলদে মিশ্রণের রঙের গরুটি পাকিস্তানের শাহীওয়াল জাতের।

৩৩ বছর ধরে গরু লালন-পালন করা রুজদার বিশ^াস জানান, মাস ছয়েকের বাছুরটি কিনেছিলেন পাবনার এক গ্রাম থেকে। সেটাকেই পেলেপুলে বড় করেছেন। গরুর বয়স এখন চার বছর সাত মাস। প্রথম দিকে খাবার বেশি লাগত না। এখন বিভিন্ন ধরনের খাবার মিলিয়ে প্রতিদিন ১০ কেজির মতো খাবার খায়। খাবারের মধ্যে রয়েছে গমের ভুসি তিন কেজি। অ্যাংকর ১ কেজি, ধানের কুড়া ১ কেজি, ছোলা ১ কেজি ও খেসাড়ি ১ কেজি প্রতিদিন দিতে হয়। এর সাথে গৃহাস্থলি থেকে তৈরি হওয়া কিছু খাবার-দাবারও দেয়া হয়। সব মিলিয়ে ১০ কেজি খাবার দেয়া হয়। সাথে কিছু খড়ও খায়। বর্তমানে গরুটির ওজন প্রায় ৪০ মণ। কুষ্টিয়া থেকে ঢাকায় পৌঁছতে অনেক সময় লেগে গেছে। গরুটি দুর্বল হয়ে পড়েছে। এ জন্য শুয়ে আছে বলে দাবি করলেন রুজদার বিশ^াস। বিক্রেতা গরুটির দাম হাঁকছেন ১২ লাখ টাকা। তবে দরদাম করলে কিছু কমেও দিতে পারেন বলে কথাবার্তায় মনে হলো। গরুটি দেখেশুনে আরো বড় গরু হাটে উঠেছে কিনা কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করতেই তারা দেখিয়ে দিলেন আরেকটা গরু আছে সেটা এর চেয়েও বড়। একটু ভেতরে গিয়ে দেখা গেল কালো কুচকুচে রঙের ছোট্ট সিংওয়ালা আরেকটি গরু। আকারে মনে হলো আরেকটু বড়। সেটা দেখতেও ভিড়ের অন্ত নেই। এ গরুটি এনেছেন চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা থেকে হাফিজুর রহমান। এ গরুটির তিনি দাম চাইছেন ১২ লাখ টাকা। অস্ট্রেলিয়ান জাতের এ গরুটির বয়স ৩ বছর চার মাস। কাঁঠালের মওসুমে গরুকে অন্যান্য খাবারের পাশাপাশি শদুয়েক পাকা কাঁঠাল খাইয়েছেন বলে জানালেন হাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, তার বাড়িতে আরো গাভী গরু রয়েছে বেশ কয়েকটি। সেগুলো দুধ দেয়। ষাঁড় বাচ্চাগুলোকে লালন-পালন করে হাটে তোলেন। গাভীগুলোর দুধ বিক্রি করেন। তারই একটি গাভীর বাছুর থেকে এত বড় গরুতে পরিণত করেছেন তিনি। বর্তমানে গরুর খাবার হিসেবে কেবল গম ও খড় খাওয়াচ্ছেন। এ জন্যই প্রতিদিন তার ব্যয় হচ্ছে অন্তত ৫০০ টাকা।

গাবতলী পশুহাট ঘুরে দেখা যায়, বিভিন্ন জাতের গরুতে ভরে উঠেছে। ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক থেকে শুরু করে রায়েরবাজার অভিমুখে এক কিলোমিটার পর্যন্ত এগিয়েছে হাটের বিস্তৃতি। রাস্তার দুই পাশেও পশু রাখার শেড করা হয়েছে। এসব শেডে এখন কেবলই পশু। এ ছাড়া ট্রাকে ট্রাকে গরু আসছেই। সেগুলো তোলা হচ্ছে হাটে। ছোট, বড়, মাঝারি বিভিন্ন আকৃতির গরুতে পূর্ণ হাট। বেচাকেনা তেমন জমে উঠেনি। তবে দুয়েকটি বিক্রি হচ্ছে বলে জানালেন হাটের ইজারাদার লুৎফর রহমান। তার অভিমত বৃহস্পতি ও শুক্রবার হবে মূল বেচাকেনা। মূলত ওই দু’টি দিনকে উদ্দেশ্য করেই এখন কেবল হাটে পশু জমায়েত করছেন ব্যাপারী ও খামারিরা।

পশুগুলো যাতে সারিবদ্ধভাবে রাখা যায়, সে জন্য বাঁশের শেড করে দেয়া হয়েছে। বালু দিয়ে দেয়া হয়েছে নিচে। তারপরও প্রবেশপথটুকু দেখা গেল কাদাপানিতে সয়লাব হয়ে আছে।
কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের খামারি পল্টু জানান, হাটে এখন পর্যন্ত তেমন অব্যবস্থাপনা চোখে পড়েনি। জাল নোট শনাক্তের জন্য বিভিন্ন ব্যাংক বুথ বসিয়েছে। ব্যাংকে টাকা জমা দেয়ারও ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এ ছাড়া নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্যরা সার্বক্ষণিক তদারকি করছেন। পশু আমদানি প্রচুর হলেও দাম উঠছে না। ক্রেতারও দেখা নেই।

কুষ্টিয়ার আরেক খামারি বাবর জানান, তিনি নিজের খামারের দু’টি গরু হাটে এনেছেন। পথে কোনো চাঁদাও দিতে হয়নি। তবে পশুর দাম উঠছে না। ভারতীয় গরুও অনেক হাটে উঠেছে বলে এমন অবস্থা বলে তার অভিমত।
গরুর সাথে ছাগল ফ্রি : চুয়াডাঙ্গার চাঁন আলী ব্রাদার্স ইউনিয়ন সংলগ্ন বালুর মাঠে এ বছর একটি দেশী জাতের সাদা রঙের গরু এনেছেন। তিনি গরুটির দাম চাচ্ছেন ১০ লাখ টাকা। তিনি জানান, গরুটি কিনলে ক্রেতাকে একটি বড় সাইজের খাসি ফ্রি দেয়া হবে। তিনি জানান, খাসিটির দামও ৩০-৩৫ হাজার টাকার মতো হবে। তবে ক্রেতারা এখনো গরুটির উপযুক্ত দাম বলেনি বলে তিনি জানান।

ফ্রি হোম ডেলিভারি : রাজধানীর শ্যামপুর বালুর মাঠে গিয়ে দেখা যায় হাটটিতে প্রচুর কোরবানির পশুর সমাহার। তবে বেচাকেনা এখনো তেমন জমেনি। ক্রেতারা দেখছেনই বেশি। হাট ইজারাদার মাসুক রহমান জানান, শ্যামপুরের অনেক এলাকা জলাবদ্ধ। এ কারণে এসব এলাকার বাসিন্দারা কোরবানির পশু কিনলে তাদের বাসায় ফ্রিতে পৌঁছে দেয়া হবে। এ ছাড়া ঢাকার দূর-দূরান্তের ক্রেতারা এ হাট থেকে গরু-ছাগল কিনলে তাদেরও হোম ডেলিভারি দেয়া হবে।
খামারেও বেচাবিক্রি : মোহাম্মদপুরে বেড়িবাঁধে সাদিক এগ্রোতে বিভিন্ন জাতের প্রায় ৬০০ গরু রয়েছে। গতকাল এ খামার থেকে ১৬ লাখ টাকায় ব্রাক্ষèা জাতের একটি গরু কেনেন ইসলাম গার্মেন্টের মালিক শাকের আহমেদ। খামারি মালিক মো: ইমরান হোসেন জানান, আমেরিকার টেক্সাস থেকে তিনি ১১ মাস বয়সী গরুটি আনেন। এরপর তার নাম দেন সুলতান। বর্তমানে গরুটির বয়স ৩ বছর ৯ মাস। গরুটির ওজন ১ হাজার ১৫৬ কেজি অর্থাৎ একত্রিশ মণ। ইমরান আরো বলেন, এ জাতের গরু বাংলাদেশে এই প্রথম আনা হয়েছে।

অনলাইনে কোরবানির পশু : বাসায় কিংবা অফিসে ব্যস্ততার কারণে অনেকেই গরুর হাটে যেতে পারেন না। আবার গরু কিনে কাটাকাটির মানুষ ও সরঞ্জাম নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন অনেকে। এ ধরনের ব্যস্ত ও চিন্তিত তাদের জন্য ভার্চুয়াল গরুর হাটের ব্যবস্থা করেছে অনলাইনভিত্তিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। ওয়েলপ্লাজ ডটকম (িি.িবিষষঢ়ষুঁ.পড়স) তাদের একটি। সরাসরি ভিডিও দেখে গ্রামের চাষির গরু কেনার সুযোগ করে দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। এরইমধ্যে জমে উঠেছে বেচাবিক্রি। প্রায় ২ লাখ থেকে সর্ব নি¤œ ৭৫ হাজার টাকায় গরুর আয়োজন রয়েছে। গরু কিনলে কসাই সামগ্রী ফ্রির বিশেষ অফারের কারণে কোরবানির গরু কেনার পরের ঝঞ্ঝাটও কমছে বলে মনে করছেন ওয়েলপ্লাজের গরু ক্রেতারা। কোনো মধ্যস্বত্বভোগী না থাকায় সরাসরি কৃষকের গরু এখানে পাওয়ায় সাধারণত গরুর হাটের তুলনায় দামও অনেক কম বলে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির সিইও সুজন মাহমুদ।
ইতোমধ্যে প্রায় ৫০টির মতো গরু অর্ডার হয়েছে উল্লেখ করে তিনি জানান, গরু কেনার পাশাপাশি কাটাকাটির সামগ্রীও মিলছে এখানে। সেইসাথে ঈদের দিন ও ঈদের পরের দিনের জন্য কসাইও মিলছে। তবে স্টক সীমিত বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/248346