৩১ আগস্ট ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৭:২১

সাত ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি সাড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকা

সরকারি ৫ ব্যাংকেরই সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা

বড় আকারের মূলধন ঘাটতির মুখে পড়েছে সরকারি পাঁচ ব্যাংকসহ সাত বাণিজ্যিক ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী, ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে জুন শেষে সাড়ে ১১ শতাংশ হারে মূলধন সংরক্ষণের কথা থাকলেও ব্যাংকগুলো তা অর্জন করতে পারেনি। বরং জুন শেষে এ সাত ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি হয়েছে সাড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মূলধন ঘাটতির মুখে পড়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের ২ হাজার ৬১৯ কোটি টাকা, বেসিক ব্যাংকের ২ হাজার ২১০ কোটি টাকা এবং বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ৭ হাজার ৩১৮ কোটি টাকা। সব মিলে রূপালী ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকসহ সরকারি ও বিশেষায়িত ৫ ব্যাংকেরই মূলধন ঘাটতি সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরে বেসরকারি খাতের সমস্যকবলিত বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ৩১২ কোটি টাকা এবং আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ১ হাজার ৭৫ কোটি টাকা দেখা দিয়েছে।

জানা গেছে, সংশোধিত ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, বছরের পর বছর কোনো ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি থাকতে পারবে না। আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি সর্বোচ্চ ২ বছর পর্যন্ত মেনে নেবে। ২ বছরের পর মূলধন ঘাটতি হলে ওই ব্যাংককে হয় মার্জার অর্থাৎ অন্য কোনো ব্যাংকের সাথে একীভূত হয়ে যেতে হবে, অথবা বন্ধ হয়ে যাবে। এ কারণে কোনো ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি হলে, তাকে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে কিভাবে মূলধন ঘাটতি পূরণ করবে তার পরিকল্পনা জমা দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক সময়ে সময়ে তা মনিটরিং করবে। এভাবে দুই বছর পর আইন অনুযায়ী ওই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।

বিশ্লেষকদের মতে, ব্যাংকিং খাতে মূলধন ঘাটতিতে সামগ্রিক ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতাই ফুটে ওঠে। এর ফলে শুধু ব্যাংকিং খাতে নয়, পুরো অর্থনীতিতেই বিপর্যয় নেমে আসার আশঙ্কা থাকে। বিদেশী বিনিয়োগেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে ঘাটতির মুখে পড়া ব্যাংকগুলোর সাথে বিদেশী ব্যাংকগুলো লেনদেন করতে আস্থার সঙ্কট দেখা দেয়। এতে পণ্য আমদানি-রফতানিতে গ্যারান্টি হিসেবে তাদের বাড়তি ফি দিতে হয়, যার প্রভাবে ব্যবসা ব্যয় বেড়ে যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক মানদে উন্নীত করতে দেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য রোডম্যাপ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০১৫ সালে দেয়া এ রোডম্যাপ অনুযায়ী আগামী ২০১৮ সালের মধ্যে দেশের ব্যাংকিং খাতকে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে সাড়ে ১২ শতাংশ হারে মূলধন সংরক্ষণ করতে হবে। ইতোমধ্যে চার বছরের সময়সীমার ২ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু রোডম্যাপ অনুযায়ী মূলধন সংরক্ষণ করতে পারছে না ব্যাংকগুলো। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত জুন শেষে ব্যাংকিং খাতে মূলধন সংরক্ষণ হয়েছে ১০ দশমিক ৮৬ শতাংশ হারে, যা ডিসেম্বরে ছিল ১০ দশমিক ৮ শতাংশ। অথচ এ সময়ে হওয়ার কথা ছিল ১১ দশমিক ২৫ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এ জন্য প্রধান বাধা হিসেবে দেখছে সরকারি ব্যাংকগুলো। এ কারণেই আন্তর্র্জাতিক মানদে দেশের ব্যাংকিং খাত পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, হলমার্ক ঋণ কেলেঙ্কারিসহ ব্যাংকিং খাতে ভুয়া ঋণ বেড়ে গেছে। শত শত কোটি টাকার জামানতবিহীন ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। এতে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ বেড়ে গেছে। এ সম্পদের বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণ করতে পারছে না ব্যাংকগুলো। অপর দিকে, বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ অবকাঠামো সুবিধার অভাব, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় ব্যবসাবাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়েছে। এর ফলে ব্যবসায়ীরা ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না। এতে বেড়ে গেছে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার অর্থই হলো ব্যাংকের ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ বেড়ে যাওয়া।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সোনালী ব্যাংকের জুন শেষে ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদ বেড়ে হয়েছে ৪৫ হাজার ৬৭৬ কোটি টাকা। এর বিপরীতে ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণ করার কথা ছিল ৪ হাজার ৫৬৭ কোটি টাকা; কিন্তু আলোচ্য সময়ে মূলধন সংরক্ষণ করা হয়েছে ১ হাজার ৯৪৮ কোটি টাকা। এ সময়ে ব্যাংকটির মূলধন ঘাটতি হয়েছে ২ হাজার ৬১৯ কোটি টাকা।
রূপালী ব্যাংকের জুন শেষে ১৯ হাজার ৭১৩ কোটি টাকার ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণ করার কথা ছিল ১ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। কিন্তু আলোচ্য সময়ে ব্যাংকটি মূলধন সংরক্ষণ করতে পোরেছে ১ হাজার ২৩০ কোটি টাকা। ফলে এ সময়ে ঘাটতি হয়েছে ৭৪০ কোটি টাকা।

বেসিক ব্যাংকের জুন শেষে ১২ হাজার ১৮৪ কোটি টাকার ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণ করার কথা ছিল ১ হাজার ২১৮ কোটি টাকা। কিন্তু আলোচ্য সময়ে তারা কোনো মূলধন সংরক্ষণ করতে পারেনি, ফলে সামগ্রিকভাবে ঘাটতি হয়েছে ২ হাজার ২১০ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, আগামী দ্ইু বছরের মধ্যে সরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিস্থিতি রাতারাতি উন্নীত হওয়া সম্ভব নয়। এমনি পরিস্থিতিতে আগামী দুই বছরের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের রোডম্যাপ অনুযায়ী ব্যাংকিং খাতের মূলধন সংরক্ষণ কিভাবে সাড়ে ১২ শতাংশে উন্নীত হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক মানদ অনুযায়ী মূলধন সংরক্ষণ করতে না পারলে নানাবিধ সমস্যা দেখা দেবে। এর মধ্যে অন্যতম হলো আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নিষ্পত্তিতে ব্যয় বেড়ে যাবে। কারণ, মূলধন ঘাটতি থাকলে ব্যাংকিং খাতের রেটিং খারাপ হবে। ফলে পণ্য আমদানিতে দেশীয় ব্যাংকগুলোর গ্রহণযোগ্যতা কমে যাবে। ফলে থার্ড পার্টি গ্যারান্টির মাধ্যমে পণ্য আমদানি করতে হবে। এতে ব্যয় স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যাবে। এ পরিস্থিতিতে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে প্রতিবেশী ভারত ও শ্রীলঙ্কা। পরিস্থিতির উন্নতি করতে হলে ব্যাংকগুলোকে আরো সতর্কতার সাথে ঋণ বিতরণ করতে হবে। পাশাপাশি খেলাপি ঋণ আদায়ে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/248356