আন্তর্জাতিক গুম দিবস উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখছে এক শিশু
৩১ আগস্ট ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৭:২০

কাঁদলেন ও কাঁদালেন গুম হওয়া মানুষের স্বজনেরা

কাঁদলেন ও কাঁদালেন সবাইকে। এরা সবাই গুম হওয়া মানুষের স্বজন। গতকাল তারা জড়ো হয়েছিলেন জাতীয় প্রেস ক্লাবের এক অনুষ্ঠানে। আজ ৩০ আগস্ট আন্তর্জাতিক গুম দিবস সামনে রেখে ‘মায়ের ডাক : ঈদুল আজহার পূর্বে গুম হওয়া সন্তানদের মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিন’ শিরোনামে ওই অনুষ্ঠানে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গুম হওয়া মানুষের স্বজনেরা হাজির হয়েছিলেন।

অনুষ্ঠানে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, আমরা এমন এক সরকার চাই যে মানুষের হাহাকার বুঝতে পারে। আমরা এমন এক প্রধানমন্ত্রী চাই যার মন-কান সব কিছু পরিষ্কার। তাহলে সে মানুষের এসব হাহাকার বুঝতে পারবে। তিনি বলেন, বর্তমানে যারা ক্ষমতায় আছেন তাদের মানবতা নেই। তারা মনে করে সম্পদ আহরণের জন্য মানুষ হত্যা, গুম সব করা যায়।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন অধিকারের পরিচালক এ এস এম নাসির উদ্দিন, আইন ও সালিস কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল, নারীপক্ষের সদস্য শিরীন হক প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে গুম হওয়া ব্যক্তিদের ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়ে আসিফ নজরুল বলেন, ‘গুম হওয়া ব্যক্তিরা যত দিন ফিরে না আসবে, তত দিন মনে করব প্রধানমন্ত্রীর কানে এ কান্না যাচ্ছে না।’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে প্রশ্ন করে তিনি বলেন, ‘আপনি গুম হতে রাজি আছেন?’ শিরীন হক বলেন, ‘আমরা সবাই অসহায় হয়ে গেছি। আমরা কার কাছে যাব? আমাদের কারো কাছে যাওয়ার জায়গা নেই।’

২০১৪ সালের মার্চে নিখোঁজ হওয়া কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক কাজী রাকিবুল হাসান শাওনের বাবা কাজী আবদুল মতিন বীরবিক্রম খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধা। তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর দেহরক্ষী। গতকাল ওই অনুষ্ঠানে মতিন জানান, আড়াই বছর ধরে ছেলের সন্ধানে নানা জায়গায় ধর্না দিয়েও কোনো ফল হয়নি। টানা ছয় মাস স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে যোগাযোগের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর সাবেক পিএস আব্দুল মালেকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় পর্যন্তও গিয়েছেন তিনি। র্যাবের বিরুদ্ধে ছেলেকে তুলে নেয়ার অভিযোগ করে তিনি বলেন, ‘সম্ভাব্য সব জায়গায় যোগাযোগ করে পাওয়া গেছে শুধু আশ্বাস আর সান্ত্বনা।’

প্রধানমন্ত্রীর কাছে বাবাকে ফিরিয়ে দেয়ার আকুতি জানায় নিখোঁজ ছাত্রদল নেতা পারভেজ হোসেনের পাঁচ বছরের মেয়ে আদিবা ইসলাম হৃদি। ২০১৩ সালের ২ ডিসেম্বর শাহবাগ এলাকা থেকে নিখোঁজ হন বংশাল থানা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক পারভেজ। ঠিকমতো বাবাকে চেনার আগেই তাকে হারায় হৃদী। মাতুয়াইলের একটি কিন্ডারগার্টেনের নার্সারির এই ছাত্রী অনুষ্ঠানে যোগ দেয় মা ফারজানা আক্তারের সঙ্গে; হাতে ধরে রাখা বাবার ছবি দেখিয়ে সে বলে, ‘এটা আমার বাবার ছবি। আমি তার সাথে ঘুরতে চাই, অনেক কিছু কিনতে চাই।’
ছবির বাবাকে কাছে পাওয়ার আকুতি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্দেশে এই শিশু বলে, ‘হাসিনা আন্টি, হাসিনা আন্টি... আমার বাবাকে ফিরিয়ে দিন। আমি বাবার সাথে ঈদ করতে চাই, ঘুরতে যেতে চাই। চাচ্চুরা আমাকে বলে, বাবা দ্রুত আসবে, আসে না।’
স্বামীকে হারানোর পর দুই সন্তান নিয়ে এখন বাপের বাড়ি থাকেন বলে জানান পারভেজের স্ত্রী ফারজানা। পারভেজ যখন নিখোঁজ হন তখন তিনি ছিলেন সন্তানসম্ভবা। পারভেজ নিখোঁজ হওয়ার পর তার বাবা ও শ্বশুর দু’জনই মারা গেছেন।
প্রেস ক্লাবে উপস্থিত হয়েছিলেন গুম হওয়া ২৯ জনের স্বজনরা। যাদের মধ্যে ছাত্রদলের সূত্রাপুর থানার একটি ওয়ার্ডের সভাপতি খালেদ হাসান সোহেলের শিশু সন্তানও ছিল। ২০১৪ সালের ২৮ নভেম্বর থেকে নিখোঁজ খালেদ। খালেদের শিশু সন্তান আরিয়ান তার বাবাকে দেখতে চায়। তার বাবাকে ফেরত পাওয়ার আকুলতায় কেঁদে ফেলে ছোট্ট এই শিশুটি। সাত বছরের আরিয়ান জানায়, তার বাবা বেঁচে থাকলে তার সব বায়নাই হয়তো মেটাতেন তিনি।

অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে নিখোঁজ হওয়া ২৫ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম সুমনের মা হাজেরা বেগম। তার ছেলের সঙ্গে একই স্থান থেকে আরো সাতজন নিখোঁজ হওয়ার কথা তুলে ধরতে গিয়ে গলা ধরে আসে ষাটোর্ধ্ব এই নারীর। তিনি বলেন, ‘র্যাব-১ লেখা তিনটি গাড়ি এসে ওদের নিয়ে গেছে। ছাউনিওয়ালা পিকআপের মতো গাড়িও ছিল, অস্ত্রশস্ত্র ছিল। কিন্তু অনেক খুঁজেও ছেলেকে আর পেলাম না। আমার সুমন যেন ফিরে আসে।’

সুমনের বোন সানজিদা ইসলাম কেঁদে কেঁদে বলেন, ‘আমরা চাই, মৃত্যুর আগে যেন আমার ভাই ফিরে আসে। জানি না কোন টর্চার সেলে আমার ভাই আছে। দুঃসহ আরেকটা দিনও আমরা পার করতে চাই না।’
পূর্ব নাখালপাড়ার বিএনপি কর্মী আবদুল কাদির ভূঁইয়া মাসুমের মা আয়েশা আলী পুরো সময়টাই কেঁদে কেঁদে আঁচল দিয়ে চোখ মুছেছেন। তার কান্না দেখে অনেকের চোখেই পানি আসে। তিনি বলেন, ‘ঘুণে ধরা কাঠের মতো বেঁচে আছি আমরা। কেবল ওপরের অংশটি আছে। তিন বছর আট মাস হলো ছেলেকে হারালাম। তার দাদা-দাদী, খালাও মারা গেছেন ইতোমধ্যে। অনেক জায়গায় ধর্না দিয়েছি। এখন কোথায় কী বলতে হবে, বুঝতে পারি না।’

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/248226