নাড়ির টানে ঈদে বাড়ির পথে মানুষ। ঝুঁকি নিয়ে ট্রেনে উঠছেন যাত্রীরা। ছবিটি কমলাপুর রেল স্টেশন থেকে তোলা
২৯ আগস্ট ২০১৭, মঙ্গলবার, ১১:৫৬

ভোগান্তি নিয়েই ঘরমুখো মানুষের যাত্রা

ফেরিঘাটগুলোতে উপচে পড়া ভিড়; গাড়ি থামিয়ে চলছে রাস্তা মেরামত


সেই ভোগান্তি নিয়েই শুরু হয়েছে মানুষের ঈদযাত্রা। পথে পথে যানজট, ফেরিঘাটে দীর্ঘ লাইন, টার্মিনালগুলোতে অব্যবস্থাপনা, টিকিট না পাওয়া ইত্যাদি আরো অনেক ঝক্কি-ঝামেলা। তারপরেও নাড়ীর টানে বাড়ি যাচ্ছেন মানুষ। ঈদের অগ্রীম টিকিটে আরো দু’দিন আগে যাত্রা শুরু হলেও গতকাল থেকেই শুরু হয়েছে মূল ভিড়।
যারা চাকরি করেন তাদের অনেকেই মূলত আজ থেকে তিন দিনের ছুটি নিয়ে গতকাল দুপুরের পরই রওনা দিয়েছেন গ্রামের বাড়িতে। সকালেও রাজধানীর টার্মিনালগুলোতে ছিল উপচে পড়া ভিড়। তবে বিকেলের দিকে দেখা গেছে মানুষের মিছিল। এরা সবাই বাড়ি যাচ্ছেন। এই মানুষগুলো পথে পথে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিশেষ করে যানজটে তাদের দুর্ভোগের সীমা ছিল না। আরিফ নামের এক পথচারী জানান, তিন দিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি যাচ্ছেন। সকালেই প্রস্তুত হয়ে বের হয়েছিলেন বাসা থেকে। দুপুরের মধ্যে অফিসের সব কাজ শেষ করে তিনি রওনা দেন গুলিস্তানের উদ্দেশে। আগেই বাসায় ফোন করে স্ত্রী ও সন্তানদের গুলিস্তান বাসস্ট্যান্ডে আসতে বলেন। দেড়টার দিকে সেখানে পৌঁছে প্রায় দেড় ঘণ্টা পরে গাড়ি সিরিয়াল পান। পরে আরিফ মোবাইল ফোনে জানান, বিকেল ৫টায়ও তারা কেরানীগঞ্জ পার হতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘দুশ্চিন্তায় আছি, কখন পদ্মা পারি দিয়ে গাড়ি ওপাড়ে যাবে?’

গতকাল সকাল থেকেই রাজধানীতে ভিড় লক্ষ করা যায়। দুপুরের দিকে এই ভিড় তীব্র আকার ধারণ করে। রাজধানীর কোনো কোনো এলাকা এই সময় স্থবির হয়ে পড়ে। সন্ধ্যা ৭টায় এ রিপোর্ট লেখার সময়ও রাজধানীর অধিকাংশ এলাকায় ছিল উপচে পড়া ভিড়। ট্রাফিক কন্ট্রোল থেকে বলা হয়েছে হঠাৎ রাস্তায় যানবাহনের তীব্র চাপ পড়েছে। যে কারণে ভিড় লেগে গেছে। একাধিক সূত্র বলেছে, দুপুরের পর একই সঙ্গে ঘরমুখো মানুষের চাপ বেড়ে যায়। যে কারণে তীব্র আকার ধারণ করে যানজট।
মহাখালী টার্মিনালে বেলা ৩টার দিকে দেখা যায় মানুষ আর মানুষ। নাড়ীর টানে সবাই বাড়ি ফিরছেন। ময়মনসিংহের যাত্রী আবু তাহের জানান, এখানে গাড়ির কোনো সিরিয়াল নেই। যে যেভাবে পারছে গাড়ি ছেড়ে দিচ্ছে। টিকিটেরও বেশি মূল্য রাখা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।

গাবতলী টার্মিনালে গিয়ে দেখা যায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা গাবতলী টার্মিনাল থেকে আমিনবাজার ব্রিজ পর্যন্ত রাস্তাটি যানজটমুক্ত রাখার চেষ্টা চালাচ্ছেন। কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ পশুবাহী ট্রাক এসে ডান দিকে হাঁটের দিকে ঘুরতে গিয়ে জ্যাম লেগে যাচ্ছে। যে কারণে টার্মিনাল থেকে যাত্রীবাহী বাস বের হতে এক-দেড় ঘণ্টা বেশি লেগে যাচ্ছে। টার্মিনাল থেকে বের হতেই মানুষ পড়ছেন চরম ভোগান্তিতে।

সায়েদাবাদ থেকে গাড়িগুলো বের হতেও ওই একই অবস্থা। যাত্রাবাড়ী এলাকায় তীব্র যানজট। ও দিকে, ঢাকা-চিটাগাং রোড এবং ঢাকা-মাওয়া রোডে থেমে থেমে গাড়ি চলছে। যে কারণে যাত্রীরা পড়েছেন চরম ভোগান্তিতে।
ভুক্তভোগীরা বলেছেন, মহাসড়কগুলোতে তীব্র যানজট শুরু হয়েছে। কোথাও কোথাও যানজট না থাকলেও রাস্তার দুরবস্থার জন্য গাড়ি চলছে থেমে থেমে। ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের গাজীপুরের বিভিন্ন পয়েন্টে গত শনিবার থেকে কখনো থেমে থেমে, কখনো তীব্র যানজট লক্ষ করা যায়। তবে গতকাল সোমবার ওই জট তীব্র আকার ধারণ করে। মহাসড়কের বিভিন্ন অংশে ভাঙাচোরা থাকায় এলোমেলো যানবাহন চলাচল, অবৈধ অটোরিকশা, যানবাহন ওভারটেক ও অতিরিক্ত যানবাহনের চাপে এ যানজটের সৃষ্টি হয়। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েন যাত্রী ও পরিবহন শ্রমিকেরা। পশুবাহী ও পণ্যবাহী ট্রাকের চাপ এবং সড়কের চন্দ্রা ও সফিপুরে জোড়াতালির সংস্কার হচ্ছে। ওই স্থানগুলোতে যানবাহন থামিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে যানজট।
গাজীপুরের কোনাবাড়ি থেকে কালিয়াকৈর উপজেলার সূত্রাপর এলাকা পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার এবং কালিয়াকৈর-নবীনগর সড়কের উপজেলার চন্দ্রা থেকে কবিরপুর এলাকা পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার ওই যানজট অব্যাহত রয়েছে।
এ দিকে ঢাকা-চিটাগাং রোডের মেঘনা ব্রিজ থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার যানজট অব্যাহত রয়েছে বলে ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন।

এ দিকে ঢাকা-মাওয়া রোড এবং ঢাকা-পাটুরিয়া রোডে যানজট ছাড়াও ঘাট দু’টোতে তীব্র যানজট রয়েছে। দুই ঘাটেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা যাত্রীরা আটকে থেকে চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।
মুন্সীগঞ্জের লৌহজং থেকে আমাদের প্রতিনিধি গোলাম মঞ্জুরে মাওলা অপু জানিয়েছেন, পদ্মা পাড়াপাড়ের লক্ষ্যে আর দুই-একদিনের মধ্যেই রাজধানীসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ঘরমুখো মানুষের ঢল নামবে দক্ষিণবঙ্গের অন্যতম প্রবেশদ্বার শিমুলিয়া ফেরিঘাটে। এবার ঈদে ঘরমুখো যাত্রীদের জন্য শিমুলিয়া ঘাটে ও ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কে সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও পদ্মায় তীব্র স্রোত ও উত্তাল ঢেউয়ের কারণে বিপর্যয়ে পড়তে পারে শিমুলিয়া কাঁঠালবাড়ি রুটের ফেরি চলাচল। ঘাট এলাকার মুখেই মূল পদ্মায় স্রোতে ফেরি চলাচল বিঘিœত হচ্ছে। এরই মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় শিমুলিয়া পয়েন্টে পদ্মার পানিপ্রবাহ ৯ সেন্টিমিটার কমলেও গত রাত থেকে এ রুটে নতুন করে যোগ হয়েছে উত্তাল ঢেউ। বর্তমানে বৈরী আবহাওয়ার কারণে ডাম্প ফেরিগুলো চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। ফলে অনাকাক্সিক্ষত এ উভয়মুখী সমস্যার কারণে ফেরি পারাপারে কিছুটা বিপর্যয়ের সৃষ্টি হলে ঈদে দীর্ঘ যানজটের কবলে ঘরমুখো হাজার হাজার যাত্রী চরম দুর্ভোগে পড়ার আশঙ্কা করছেন শিমুলিয়া ফেরিঘাট সংশ্লিষ্টরা।
এ দিকে গতকাল সোমবার সকাল থেকে শিমুলিয়ার তিনটি ঘাটে ফেরি পারাপারের জন্য যানবাহনের বাড়তি চাপ ছিল। এ সময় রাজধানী থেকে ছেড়ে আসা দূরপাল্লার বেশির ভাগ যাত্রীবাহী যানবাহনই ফেরি পারাপারের জন্য অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেরিঘাটে আটকে থেকে চরম দুর্ভোগে পড়েন ঘরমুখো ফেরির যাত্রীরা। একপর্যায়ে কাঁঠালবাড়ি থেকে কিছু খালি ছোট ফেরি শিমুলিয়া ঘাটে এনে চাপ সামাল দেয়া হয় বলে জানান বিআইডব্লিউটিসির সহকারী ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) মো: সাফায়েত হোসেন। তবে গতকাল ৩০০ পণ্যবাহী ট্রাক ফেরিঘাটে আটকে থাকলেও বিকেল ৪টার আগেই যাত্রীবাহী যানবাহনগুলো ঘাটশূন্য হয়ে পড়ে বলে জানা গেছে।

শিমুলিয়া বিআইডব্লিউটিসির একাধিক সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি পদ্মায় পানি বৃদ্ধি পেয়ে শিমুলিয়া ঘাট থেকে লৌহজং টার্নিং পর্যন্ত বড় নদীতে স্রোত বিরাজ করতে থাকে। এ সময় মাঝ পদ্মায় এ স্রোতের বেগ বৃদ্ধি পেতে থাকলে ফেরি চলাচল মারাত্মক বিঘিœত হয়। প্রায় দুই-তিন কিলোমিটার এ পয়েন্টে পানির স্রোত অনেক বেশি হওয়ায় ফেরি চালাতে প্রতিকূল অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে রো-রো ফেরি, কে টাইপ ও ডাম্প ফেরিগুলো ঘাট ধরতে অতিরিক্ত আধা ঘণ্টা লাগছে। এ দিকে রোববার রাত থেকে এ রুটে নতুন করে যোগ হয়েছে উত্তাল ঢেউ। বর্তমানে বৈরী আবহাওয়ার কারণে গত রাতে ডাম্প ফেরিগুলো চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। অপর দিকে আগামী কিছুদিনের মধ্যে পদ্মায় পানিপ্রবাহ কমতে শুরু করলে তখন ডুবোচরের কারণে নৌরুটে নাব্য সঙ্কট সৃষ্টি হতে পারে বলে তারা আরো আশঙ্কা করছেন।

এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএর নির্বাহী প্রকৌশলী (ড্রেজিং) সুলতান উদ্দিন আহমেদ জানান, নাব্য সঙ্কটের কারণে ফেরি চলাচলে বড় ধরনের কোনো সমস্যা বর্তমানে দেখা না দিলেও নির্বিঘেœ ফেরি চলাচলের লক্ষ্যে আমাদের তিনটি ড্রেজার নৌরুটে পলি অপসারণ কাজ অব্যাহত রেখেছে। তবে লৌহজং টার্নিংয়ে স্রোতের কারণে সিনোহাইড্রো কোম্পানির একটি ড্রেজার দিয়ে সাময়িকভাবে পলি অপসারণ কাজ বন্ধ রয়েছে। এ ছাড়া যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় আমাদের আরো চারটি ড্রেজার নৌরুটে অবস্থান করছে বলে তিনি জানান।

মাওয়া বিআইডব্লিউটিসির মেরিন অফিসার আহমেদ আলী ও টাগ আইটি-৯১ মাস্টার ইনচার্জ ইলিয়াস আহমেদ জানান, বর্তমানে এখানে মূল সমস্যা দেখা দিয়েছে ঘাট এলাকা সংলগ্ন মূল পদ্মায় (বড় নদীতে) পানির ¯্রােত।এ কারণে ফেরি চলাচল বিঘিœত হওয়ার সাথে সাথে গত রাত থেকে নৌরুটে উত্তাল ঢেউয়ের কারণে ডাম্প ফেরি চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে। গতকাল সোমবারও ঢেউ অব্যাহত রয়েছে বলে তারা আরো জানান।
শিমুলিয়া বিআইডব্লিউটিসির সহকারী মহাব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) খন্দকার খালিদ নেওয়াজ জানান, নৌরুটের লৌহজং টার্নিংয়ের কাছে মূল নদীতে স্রোতের কারণে ফেরি চলাচলে সমস্যা দেখা দিলেও এখনো এ রুটে চারটি রো রোসহ মোট ১৬টি ফেরি চলাচল করছে। তবে ঈদে যাত্রীসেবা বাড়ানোর লক্ষ্যে মঙ্গলবার থেকে এ নৌরুটে মোট ১৯টি ফেরি চলবে বলে তিনি আরো জানান।
এ দিকে রাজধানীর সদরঘাটেও গতকাল যাত্রীদের বাড়তি ভিড় লক্ষ করা গেছে। আজ থেকে সদরঘাটে উপচে পড়া ভিড় হবে বলে জানিয়েছে ঘাটসূত্র।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/248078