২৯ আগস্ট ২০১৭, মঙ্গলবার, ১১:৫৫

চামড়ার দাম নিয়ে শঙ্কা

আসন্ন কোরবানি ঈদে পশুর চামড়ার দাম নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। হাজারীবাগ থেকে সাভারে চামড়া শিল্প স্থানান্তরের পর সৃষ্ট জটিলতার কারণে এমনটি হতে পারে বলে চামড়া ব্যবসায়ীরা মনে করছেন। এদিকে সাভারের চামড়া শিল্প নগরীতে যাতায়াত ব্যবস্থা খারাপ হওয়ায় কোরবানির পশুর চামড়া পরিবহনের কারণে নষ্ট হতে পারে এমন আশঙ্কাও করেছেন চামড়া ব্যবসায়ীরা। প্রতি বছর পশু কুরবানির পর সারা দেশ থেকে সংগৃহীত কাঁচা চামড়া রাজধানীর পোস্তগোলাসহ বিভিন্ন আড়তে সংরক্ষণ করা হয়। এর দুই-একদিন পর থেকে ট্যানারির মালিকরা এসব চামড়া কিনে নিজস্ব ট্যানারিতে নিয়ে সংরক্ষণ করেন। চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে সুবিধামতো সময়ে পাকা করা হয়। কিন্তু পরিবেশ দূষণের দায়ে ইতোমধ্যে হাজারীবাগের সব ট্যানারি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এসব ট্যানারির মধ্যে মাত্র ৬৭টি সাভার চামড়া শিল্প নগরীতে স্থানান্তর হয়ে উৎপাদনে যেতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু প্লট পাওয়া ১৫৫টি ট্যানারির বাকিগুলোর কারখানা নির্মাণের কাজ শেষ হয়নি। ফলে এসব ট্যানারির কারখানা কাঁচা চামড়া সংরক্ষণে উপযুক্ত নয়। অর্থ সংকটে এসব ট্যানারির নির্মাণ কাজেও গতি নেই। এ অবস্থায় কোরবানির চামড়া সংগ্রহ করা এসব ট্যানারির জন্য অনেকটাই কঠিন হয়ে পড়েছে। জানা গেছে, সাভারের চামড়া শিল্পনগরী পুরোপুরি চালু হতে এখনো অনেক ঘাটতি রয়েছে। ধীরগতিতে চলছে অবকাঠামো নির্মাণের কাজ। এতে কোরবানি ঈদের প্রায় এক কোটি চামড়ার মধ্যে ৩৫-৪০ লাখ পিস কাঁচা চামড়ার ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বে। এখানে পানি ও বিদ্যুত পাওয়া গেলেও গ্যাস সংযোগ দেয়া হচ্ছে না। ১৫৪ টি শিল্প প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এখন পর্যন্ত ৬২টি চামড়া উৎপাদন শুরু করেছে। ট্যানিং ড্রাম স্থাপন করেছে ৭৭টি প্রতিষ্ঠান। আর কারখানা চালুর জন্য ৭২টি প্রতিষ্ঠান বিদ্যুতের জন্য আবেদন করেছে। তিতাস গ্যাস সংযোগ দিয়েছে মাত্র ২০টি প্রতিষ্ঠানে। এ ছাড়া পানির সংযোগ নিয়েছে ৫৫টি প্রতিষ্ঠান। জানা যায়, হাজারীবাগের ট্যানারিগুলো স্থায়ীভাবে বন্ধ হওয়ার পর সাভারে কারখানা স্থানান্তর প্রক্রিয়া হচ্ছে, তবে তা ধীরগতিতে। তাই আসন্ন কোরবানির ঈদে সংগৃহীত কাঁচা চামড়ার ভবিষ্যৎ কী হবে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন উদ্যোক্তারা। এ অবস্থায় এবারের কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে কোনো প্রস্তুতি নেই মালিকদের। আর সাভারের চামড়া শিল্পনগরী প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোরবানি ঈদের আগে যাতে অন্তত ১০০টি শিল্প প্রতিষ্ঠান পুরোপুরি চালু করা যায় সে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। কয়েক বছর ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে দরপতন ও চাহিদা কমার অজুহাত তুলে কোরবানির পশুর চামড়ার দাম কমিয়ে নির্ধারণ করছেন ট্যানারি মালিক, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানিকারকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। অথচ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান বলছে, আন্তর্জাতিক বাজার বিশেষ করে ভারত, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে গতবারের তুলনায় এবার কাঁচা চামড়ার দাম বেশি। এ ছাড়া এ দেশের পশুর চামড়ার মান বিশ্বে এক নম্বর হওয়ায় দামও আন্তর্জাতিক বাজারে বেশি হওয়াটা স্বাভাবিক। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ঘোষণা অনুযায়ী, এ বছর ট্যানারি ব্যবসায়ীরা ঢাকায় প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া কিনবেন ৫০-৫৫ টাকায়, ঢাকার বাইরে এর দাম হবে ৪০-৪৫ টাকা। এ ছাড়া সারাদেশে খাসির চামড়া ২০-২২ এবং বকরির চামড়া ১৫-১৭ টাকায় সংগ্রহ করা হবে। গত বছরও একই মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। চামড়ার দাম ভারতের চেয়ে কম নির্ধারণ করায় পাচারের সুযোগকে সহজ করা হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ভারতে বর্তমানে প্রতি বর্গফুট গরুর কাঁচা চামড়ার মূল্য প্রায় ৯০ টাকা, যা বাংলাদেশের নির্ধারিত দরের প্রায় দ্বিগুণ। ভারতের তুলনায় বাংলাদেশের চামড়ার মান ভালো অথচ দাম অনেক কম থাকায় প্রতি বছরই ভারতে চামড়া পাচারের আশঙ্কা থাকে। পাচার ঠেকাতে দেশের ভেতরে কাঁচা চামড়ার দাম না বাড়িয়ে ট্যানারি মালিকরা বরাবরই সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপের আরজি জানান। কিন্তু এতে তেমন ফল পাওয়া যায় না। কয়েক বছর ধরে বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সীমান্তে নজরদারি জোরদার করলেও ভারতে চামড়া পাচার ঠেকানো যাচ্ছে না।

দেশের ট্যানারি শিল্পের প্রধান উপাদান কাঁচা চামড়ার প্রায় ৬০-৭০ শতাংশই আসে কোরবানির ঈদে। গরু ও ছাগল মিলে কোরবানি ঈদে প্রায় এক কোটি পিস কাঁচা চামড়া আসবে। এই চামড়া সংরক্ষণে লবণের প্রয়োজন হবে ৩০ হাজার টনের। কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে লবণের দাম বৃদ্ধির কারসাজি হচ্ছে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। ইতোমধ্যে বাজারে লবনের দাম ২৫-৪০ টাকা করা হয়েছে। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, চাহিদা অনুযায়ী ৩০ হাজার টন লবন পাওয়া না গেলে এবার কাঁচা চামড়া রক্ষা করা সম্ভব নয়। ২৫-৪০ টাকা দরে লবণ কিনে কেউ চামড়া সংরক্ষণ করবে না। আর কাঁচা চামড়ায় লবণ দেয়া না হলে তা পচে যাবে। এ বছর সংরক্ষণের অভাবে কাঁচা চামড়াগুলো দেশের বাহিরে পাচার হবে বলে সংশ্লিষ্ঠরা মনে করছেন। কারণ গত বছরও একই ধরনের সমস্যায় ভারতে পাচার হওয়ার পাশাপাশি সঠিক সংরক্ষণের অভাবে নষ্ট হয়েছিল কোরবানির মৌসুমের প্রায় ২৫ শতাংশ চামড়া। তাই আগেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে এবারো চামড়া পাচারের পাশাপাশি কাঁচা চামড়া নষ্টের হারও বাড়তে পারে।

বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শাখাওয়াত উল্লাহ মানবজমিনকে বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্ধারিত দাম দিয়েই চামড়া কেনা হবে। গরুর দাম বাড়া বা কমার সঙ্গে চামড়ার দামের কোন ব্যবধান থাকবে না। তিনি বলেন, সাভারে ১৫৫টি ট্র্যানারি কারখানার জন্য প্লটের মধ্যে ঈদের আগে ১০০টি কারখানা প্রস্তুত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিছু অসাধু ব্যবসায়ীরা কোরবানি ঈদ এলে লবণের দাম বাড়িয়ে দেয়। এ বছরও তাই করেছে। এক্ষেত্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় মনিটরিং করলে ব্যবসায়ীরা লবণের দাম বাড়াতে পারবে না।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=80907