২৯ আগস্ট ২০১৭, মঙ্গলবার, ১১:৩২

সীমান্তে রোহিঙ্গাদের আর্তনাদ

বোমা মেরে জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে গ্রামের পর গ্রাম

দিনভর শোনা যায় গুলি-বোমার শব্দ, দেখা যায় ধোঁয়ার কুণ্ডলী * তরুণদের ধরে বর্বর নির্যাতন ও গুলি করে হত্যা * শিশুদেরও রেহাই দিচ্ছে না সেনাবাহিনী * রাখাইনে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১০৪ * সহিংসতার জন্য ত্রাণকর্মীদের দায়ী করলেন সুচি * ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর সরকারি বাহিনীর নির্যাতন অব্যাহত আছে। সেনাবাহিনীর সদস্যরা বোমা মেরে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে। জঙ্গিগোষ্ঠীর সদস্য দাবি করে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মুসলিম তরুণদের। পরে তাদের ওপর বর্বর নির্যাতন চালানো হচ্ছে। যাদের ধরতে পারছেন না, তাদের গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে। রোববার সন্ধ্যার পর থেকে সোমবার দিনভর ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে থেমে থেমে গুলি-বোমার শব্দ শোনা গেছে। মাঝে মাঝে দেখা গেছে ধোঁয়ার কুণ্ডলী। ঘর-বাড়ি ছেড়ে ধানক্ষেত, গমক্ষেতে গিয়ে লুকাচ্ছে লোকজন।

এদিকে সোমবারও সীমান্তের জিরো পয়েন্টে হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ, শিশু ও বৃদ্ধকে অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় থাকতে দেখা যায়। অনেকে খোলা আকাশের নিচে, অনেকে তাঁবু টানিয়ে অবস্থান করছেন। স্থানীয়রা তাদের মাঝে খাবার-পানি বিতরণ করেন। এদিন বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের সময় ২২০ জন রোহিঙ্গাকে আটক করে ফেরত পাঠিয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ। রোহিঙ্গারা জানান, রাখাইনে শত শত রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে। তবে মিয়ানমার সরকার জানায়, শুক্রবার থেকে এ পর্যন্ত ১০৪ জন নিহত হয়েছে। ইউরোপভিত্তিক রোহিঙ্গা অ্যাক্টিভিস্ট ও ব্লগার রো নাই স্যান লুইন জানান, সর্বশেষ সহিংসতায় ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হয়েছে।

কক্সবাজার থেকে যুগান্তর প্রতিনিধি সায়ীদ আলমগীর জানান, কক্সবাজারের উখিয়ার উপজেলার রহমতেরবিল ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে থেমে থেমে শোনা যাচ্ছে গুলির শব্দ ও মানুষের আর্তচিৎকার। মাঝে মাঝে শোনা যায় বোমার শব্দও। সোমবার দিনভর এমন শব্দ কানে আসছিল সীমান্তে জড়ো হওয়া রোহিঙ্গাদের। এ সময় ফেলে আসা আপনজনদের নিয়ে অজানা আতঙ্কে কাঁদতে থাকেন অনেকে।

সীমান্তের ওপারের আকাশে দেখা যায় কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী। রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা জানান, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী বোমা মেরে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে। তারা গণহারে রোহিঙ্গা তরুণদের আটক করে নিয়ে যাচ্ছে। যাদের ধরতে পারছে না তাদের গুলি করে মারছে।

রাখাইন রাজ্যের ঢেঁকিবনিয়ার উত্তরপাড়ার আহমদ হোসেন মুঠোফোনে জানান, রোববার খুব ভোরে সেনাবাহিনীর একটি দল গ্রামে ঢুকে স্থানীয় জহির, করিম ও আবদুর শুক্কুরকে আটক করে নিয়ে যায়। এ সময় তারা পালিয়ে পাশের পাহাড়ে আশ্রয় নেন। পরে ওই তিন তরুণের ওপর বর্বর নির্যাতন চালিয়ে অজ্ঞান অবস্থায় জঙ্গলে ফেলে দেয়া হয়।

ঢেঁকিবনিয়া পূর্বপাড়ার আবছার কামাল জানান, সেনাবাহিনী সন্ধ্যার পর বাড়িতে বাড়িতে তল্লাশি শুরু করে। যেসব বাড়িতে মানুষ পায় না সেসব বাড়ি বোমা মেরে জ্বালিয়ে দেয়। যাকে পায় ধরে নিয়ে যাচ্ছে।

সোমবার সকালে উখিয়ার পালংখালী আঞ্জুমানপাড়া সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢোকা আহমদ শফি জানান, ফকিরপাড়ায় দু’দিন ধরে সেনাবাহিনী বর্বর নির্যাতন চালাচ্ছে। কাউকে প্রকাশ্যে গুলি মেরে হত্যা করছে।

তাদের মতে, শাঁখের করাতে পড়েছেন রোহিঙ্গারা। একদিকে নিজ দেশে বর্মী বাহিনীর নিপীড়ন, অন্যদিকে সীমান্ত পার হতে বিজিবির বাধা। জিরো পয়েন্টে তাদের খোলা আকাশই আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছে। ঘুমধুম ও তামব্রু সীমান্তের জিরো পয়েন্ট এলাকায় হাজারো রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় আছে। অনেকে তাঁবু টানিয়ে অবস্থান করছে। স্থানীয়রা তাদের মাঝে খাবার বিতরণ করছেন। তারা মনে করছেন, হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুর অনুপ্রবেশ ঠেকানোই এখন বিজিবির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। তাদের সীমান্তে রেখে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর কথা বলছেন তারা।

উখিয়ার পালংখালী ইউপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মোজাফফর আহমদ বলেন, নাফ নদী পার হয়ে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা নদীর পাড়ে অবস্থান করছে। ওপারে প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ পাচ্ছি। শুধু তাই নয় শোনা যাচ্ছে নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের কান্নার আওয়াজও।

কক্সবাজার ৩৪ বিজিবি অধিনায়ক লে. কর্নেল মঞ্জুরুল হাসান খানও মিয়ানমার সীমান্তের অভ্যন্তরে গুলির শব্দ শোনার কথা জানান।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে রাখাইন পরিস্থিতি : শুক্রবার শুরু হওয়া লড়াইয়ে এ পর্যন্ত ১০৪ জন নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে দেশটির সরকার। তবে বেসরকারি সূত্রগুলো বলছে, এ পর্যন্ত সেনা ও বিদ্রোহীসহ কয়েকশ’ বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে। রোহিঙ্গাদের অধিকার নিয়ে কাজ করা আইনজীবীদের বরাত দিয়ে আল জাজিরা বলেছে, এ পর্যন্ত প্রায় ৮০০ জন নিহত হয়েছে। তবে নিহতের এ সংখ্যা নিরপেক্ষ সূত্র থেকে যাচাই করা সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছে সংবাদ সংস্থাটি।

রয়টার্স জানায়, রাখাইনের উত্তরাঞ্চলীয় ওই এলাকা থেকে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক কয়েকটি ত্রাণ সংস্থার কর্মীরাও সরে যেতে বাধ্য হয়েছেন। শুক্রবার রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরা লাঠি, ছুরি ও ঘরে তৈরি বোমা নিয়ে ওই এলাকায় পুলিশের ৩০টি চৌকি ও সেনাবাহিনীর একটি ঘাঁটিতে একযোগে হামলা চালায়। তারপর থেকে দু’পক্ষের মধ্যে শুরু হওয়া লড়াই তিন দিন পরও অব্যাহত রয়েছে।

মংডু, বুথিডায়ুং ও রাথেডায়ুং শহর ঘিরে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান শুরু করেছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। এ তিন অঞ্চলে প্রায় ৮০ হাজার লোকের বসবাস। সেখানে সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কারফিউ জারি রাখা হয়। মংডুর বাসিন্দা আজিজ খান বলেন, শুক্রবার সকালে সেনাবাহিনী তাদের গ্রামে হানা দেয় এবং বাড়ি ও গাড়িতে নির্বিচারে গুলি চালাতে থাকে। তিনি আরও বলেন, পুলিশ ও সেনাবাহিনী তাদের গ্রামের ১১ জনকে হত্যা করে। যা কিছু নড়াচড়া করছিল, এমন সব কিছুতেই তারা গুলি চালায়। এরপর কিছু সেনা ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। আজিজ খান বলেন, সেদিন নিহতদের মধ্যে নারী ও বৃদ্ধ রয়েছে। এমন কি ছোট্ট শিশুকেও তারা রেহাই দেয়নি।

ইউরোপভিত্তিক রোহিঙ্গা অ্যাকটিভিস্ট ও ব্লগার রো নাই স্যান লুইন জানান, সর্বশেষ সহিংসতায় ৫ হাজার থেকে ১০ হাজার রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হয়েছে। মসজিদ ও মাদ্রাসা জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। হাজার হাজার মুসলিম রোহিঙ্গা খাদ্য ও আশ্রয়ের সংকটে রয়েছে। তিনি আরও বলেন, সরকারি বাহিনী আমার চাচাদের পালাতে বাধ্য করেছে। বাড়িঘর ধ্বংস ও লুটপাট করলেও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের সাহায্য করা হচ্ছে না। খাদ্য নেই, আশ্রয় নেই। এমন অবস্থায় তারা আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে, কখন তাদের জীবন নিয়ে নেয়া হবে। বুথিডায়ুংয়ের এক বাসিন্দা মিন্ট লুইন বলেন, সব বাড়িতেই প্রাণ সংহারের আতঙ্ক। হোয়াটসঅ্যাপে লোকজন হত্যার ভিডিও শেয়ার করছে। হত্যার শিকার নারী ও শিশুদের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করা হচ্ছে। নিরপরাধ ব্যক্তিদেরও গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে। বাইরের কেউ হয়তো চিন্তাই করতে পারবে না, আমরা কতটা ভয়ের মধ্যে আছি। ঘরবাড়ি ছেড়ে ধানক্ষেত, গমক্ষেতে গিয়ে লুকাচ্ছে লোকজন।

২২০ রোহিঙ্গাকে ফেরত : উখিয়া ও টেকনাফ সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশের সময় ২২০ জন রোহিঙ্গাকে আটক করে পুনরায় ফেরত পাঠিয়েছে বিজিবি। এ সময় রোহিঙ্গাদের সহায়তাকারী দুই দালালকেও আটক করেছে পুলিশ। রোববার রাতে জল ও স্থল সীমান্ত অতিক্রম করে তারা বাংলাদেশে প্রবেশ করছিল। সোমবার ভোরে তাদের ফেরত পাঠানো হয় বলে জানিয়েছেন বিজিবির কক্সবাজার ৩৪ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মঞ্জুরুল হাসান খান ও টেকনাফ ২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল এসএম আরিফুল ইসলাম।

সম্ভ্রম বাঁচাতে পালিয়ে এসেছি : টেকনাফ (কক্সবাজার) প্রতিনিধি জানান, রাখাইন রাজ্যের দুই রোহিঙ্গা নারী কোলের সন্তান নিয়ে সম্ভ্রম বাঁচাতে পালিয়ে এসেছেন। সোমবার তারা আশ্রয় নিয়েছেন উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। একজন স্বামীকে ফেলে এলেও অপর রোহিঙ্গা নারীর সামনে হত্যা করা হয়েছে তার স্বামীকে।

মংডু জেলার মাছছিলা পাড়ার আজিজুল হকের স্ত্রী তসলিম ফাতেমা বলেন, ইজ্জত বাঁচাতে এ দেশে চলে এসেছি। তিনি জানান, বর্তমানে যেভাবে মগ সেনারা জুলুম, অত্যাচার, নির্যাতন, বাড়িঘরে আগুন দিয়ে, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে তাতে আরকান রাজ্য মুসলিমশূন্য হয়ে পড়বে।

অপর রোহিঙ্গা নারী রহমত উল্লাহর স্ত্রী আশেক আরা বলেন, আমার সামনে স্বামীকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। জীবন বাজি রেখে কোনো রকমে কোলের সন্তানকে বুকে জড়িয়ে অন্য রোহিঙ্গা নারীদের সঙ্গে এপারে চলে এসেছি।

সহিংসতার জন্য ত্রাণকর্মীদের দায়ী করলেন সুচি : মিয়ানমারের সহিংসতার জন্য এবার আন্তর্জাতিক ত্রাণকর্মীদের দায়ী করলেন অং সান সুচি। তিনি বলেছেন, এসব ত্রাণকর্মী মিয়ানমারের ‘সন্ত্রাসীদের’ সহায়তা করছে। অন্যদিকে রোহিঙ্গা বিদ্রোহী না লিখে তাদেরকে ‘টেরোরিস্ট’ (সন্ত্রাসী) বলে উল্লেখ করতে গণমাধ্যমকে নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। সুচির এ বক্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছে মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থাগুলো। তারা বলেছে, সুচিকে অবশ্যই দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো কথা বলা বন্ধ করতে হবে।

সীমান্তে মানবিক সহযোগিতা : সীমান্তে অবস্থান নেয়া রোহিঙ্গাদের মানবিক সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। অবস্থানকারীদের মধ্যে নারী-শিশুর সংখ্যাই বেশি। মিয়ানমারের ডেকুবনিয়া, ফকিরাবাজার, মিয়াবাজার, উত্তরপাড়া, তুমব্রু থেকে আসা ৫ শতাধিক নারী-শিশু, পুরুষের মাঝে খিচুড়ি, মুড়ি ও শুকনা খাবার বিতরণ করেছেন ঘুমধুম ইউপির প্যানেল চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন ও অন্যরা।

 

http://www.jugantor.com/first-page/2017/08/29/151905