২৮ আগস্ট ২০১৭, সোমবার, ১১:১৬

আরো বড় অভিযানের প্রস্তুতি

রাখাইন থেকে অমুসলিমদের সরানো হচ্ছে

রাখাইন রাজ্য থেকে অমুসলিম মিয়ানমার নাগরিকদের সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। উত্তর-পশ্চিম রাখাইনে চলমান সঙ্ঘাতের মধ্যে অমুসলিম অধ্যুষিত গ্রামগুলো থেকে এ পর্যন্ত চার হাজার মিয়ানমার নাগরিককে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এটি সংখ্যালঘু মুসলিম রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের ওপর বড় ধরনের দমন অভিযানের প্রস্তুতি কি নাÑ তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
এ দিকে রাখাইনে পুলিশ স্টেশন ও সেনাছাউনিতে সাম্প্রতিক হামলার পরিপ্রেক্ষিতে মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ সীমান্ত অভিমুখে স্রোত ঠেকানো, মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর কোনো উসকানিমূলক পদক্ষেপ মোকাবেলায় বাংলাদেশের প্রস্তুতিসহ সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনায় গতকাল রোববার রাজধানীর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে দীর্ঘ বৈঠক হয়েছে। পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হকের সভাপতিত্বে বৈঠকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ, গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধিসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।
রাখাইন রাজ্যে উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলায় বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত সিল করে দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবুল হোসেন। গতকাল বিকেলে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত এলাকা পর্যবেণ শেষে সাংবাদিকদের এ কথা জানান তিনি। বাংলাদেশ সীমান্ত সুরতি রাখতে বিজিবি সদা প্রস্তুত রয়েছে উল্লেখ করে বিজিবি মহাপরিচালক বলেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কোনো বিদেশী নাগরিককে অনুপ্রবেশ করতে দেয়া হবে না। অনুপ্রবেশ ঠেকাতে যেকোনো ধরনের পদপে নিতে প্রস্তুত রয়েছে বিজিবি। মিয়ানমার সীমান্তরী বাহিনীর কোনো গুলি বাংলাদেশ সীমান্তে এলে সমুচিত জবাব দেয়া হবে বলে তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন।
রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে মিয়ানমারের সমাজ কল্যাণ, ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী উইন মাইয়াতের উদ্ধৃতি দিয়ে জানানো হয়েছে, গত শনিবার অমুসলিম অধ্যুষিত গ্রামগুলো থেকে পালিয়ে আসা চার হাজার নাগরিককে নিরাপদে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। রাজ্য সরকার ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সাথে সহযোগিতাকারীদের খাদ্য দিয়ে সহায়তা দেয়া হচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশৃঙ্খল অবস্থা ও সঙ্ঘাতপূর্ণ এলাকায় প্রবেশের কড়াকড়িতে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা জটিল হয়ে পড়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সাম্প্রতিক আক্রমণ এত ব্যাপকভিত্তিক ছিল যে এটিকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হামলার চেয়ে আন্দোলন বা বিদ্রোহ বলাই শ্রেয়। একটি সেনাসূত্র জানায়, ‘সব গ্রামবাসী চরমপন্থীতে পরিণত হয়েছে। তারা যা করছে তা বিদ্রোহের শামিল। হামলাকারীরা মরবে কি বাঁচবে তা নিয়ে পরোয়া করছে না। আমরা বলতে পারছি না তাদের মধ্যে কারা বিচ্ছিন্নতাবাদী।’ পর্যবেক্ষকদের মতে, আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মির (এআরএসএ) নেতা আতাউল্লার নেতৃত্বে অনেক রোহিঙ্গাই সংগঠিত হচ্ছেন। ৩০টি পুলিশ স্টেশন ও একটি সেনাছাউনিতে একযোগে আক্রমণ রোহিঙ্গাদের ঘুরে দাঁড়ানো হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এআরএসএ এ হামলার দায় স্বীকার করেছে। এরপর মিয়ানমার সরকার এআরএসএকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। এআরএসএ-এর আগে হারাকাত আল-ইয়াকিন হিসেবে পরিচিত ছিল। সংগঠনটি গত বছর অক্টোবরে রাখাইনের তিনটি সীমান্ত চৌকিতে হামলা চালিয়ে ৯ নিরাপত্তা রক্ষীকে হত্যার দায় স্বীকার করেছিল। সাম্প্রতিক হামলায় ১২ জন নিরাপত্তা রক্ষীসহ শতাধিক ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছেন।
গত অক্টোবরে সীমান্ত চৌকিতে হামলার পর মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে রোহিঙ্গারা ব্যাপক দমন-পীড়ন, হত্যা-ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের শিকার হন। এরপর থেকে ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে চলে এসেছে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম)। বিজিবির কঠোর পর্যবেক্ষণের মধ্যেও শুক্রবার রাতের ঘটনার পর থেকে দুই হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে চলে আসতে সক্ষম হয়েছে বলে জানিয়েছে রয়টার্স।
রাখাইন রাজ্যের সঙ্কট নিরসনে মিয়ানমার সরকার গঠিত আনান কমিশনের প্রতিবেদনে অতিমাত্রায় শক্তি প্রয়োগ করলে রোহিঙ্গা চরমপন্থীদের উত্থান হওয়ার আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে। এতে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেয়া, তাদের চলাফেলার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন মানবিক সেবার অধিকার দেয়ার সুপারিশ করা হয়। গত বৃহস্পতিবার এ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। আর তার পর দিনই রাখাইনের পুলিশ স্টেশন ও সেনাছাউনিতে একযোগে আক্রমণ চালানো হয় বলে সরকারি কর্তৃপক্ষ অভিযোগ করছে।
এ দিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এখন পর্যন্ত রাখাইন পরিস্থিতিতে সতর্কতার সাথে প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে অথবা নীরবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। যুক্তরাষ্ট্র রাখাইনে মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর আক্রমণের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। তারা আক্রমণকারীদের বিচারের আওতায় আনতে আইনের শাসন, মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা অক্ষুণœ রাখা, কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা বজায় রাখা এবং উত্তেজনা বাড়িয়ে দেয়Ñ এমন কর্মকাণ্ড থেকে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছে। অন্য দিকে ব্রিটেন আনান কমিশনের সুপারিশকে স্বাগত জানিয়েছে। তারা মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে সব পক্ষকে সংযত থাকা এবং উত্তেজনা কমিয়ে আনতে সহায়ক ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়েছে।
রাখাইন পরিস্থিতিতে নীরবতা ভঙ্গ করতে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার ওপর স্থানীয়ভাবে চাপ বাড়ছে। মালয়েশিয়ান কনসালটেটিভ কাউন্সিল অব ইসলামিক অর্গানাইজেশনস (মাপিম) রোহিঙ্গাদের রক্ষায় আশিয়ানের প্রভাবশালী রাষ্ট্র মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়াকে সক্রিয় ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়েছে।
রাখাইন পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে গত শনিবার ঢাকায় মিয়ানমারের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্সকে (সিডিএ) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করা হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (এশিয়া ও প্যাসিফিক) মাহবুব উজ্জামান সিডিএকে জানান, গত বছরের ৯ অক্টোবর মিয়ানমার পুলিশের ওপর সন্ত্রাসী হামলার পর সেখানে সেনা অভিযান হয়েছিল, যার পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় ৮৫ হাজার মিয়ানমার নাগরিক বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। চলমান পরিস্থিতিতে রাখাইনের নারী, শিশু, বয়োজ্যেষ্ঠসহ হাজার হাজার নিরস্ত্র নাগরিক বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টায় সীমান্তে জড়ো হয়েছে। এটি অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। সচিব বলেন, এমনিতেই বাংলাদেশ বছরের পর বছর ধরে কয়েক লাখ মিয়ানমার নাগরিকের ভার বয়ে চলেছে, যারা বিভিন্ন ঘটনায় প্রাণ বাঁচতে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ মনে করে সাধারণ নাগরিকদের রায় মিয়ানমারের দায়িত্ব নেয়া জরুরি।
নিরস্ত্র নাগরিক, বিশেষত চরম ঝুঁকিতে থাকা নারী, শিশু ও বয়োজ্যেষ্ঠদের উপযুক্ত নিরাপত্তা এবং আশ্রয় নিশ্চিত করতে মিয়ানমার কর্তৃপরে প্রতি আহ্বান জানায় বাংলাদেশ।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/247722