২৮ আগস্ট ২০১৭, সোমবার, ১১:১৩

হানিফ ফ্লাইওভারের ওপরেও যানজট যন্ত্রণা

অসহ্য যন্ত্রণার নাম এখন মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার। রাজধানীর যানজট নিরসনে তৈরি এ ফ্লাইওভার এখন যেন যানজটের উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রায় দিনই যাত্রাবাড়ীর দিক থেকে উঠে ফ্লাইওভারের মাঝ বরাবর এসে থমকে যাচ্ছে গাড়ি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ গাড়ির লাইন দীর্ঘ থেকে হয় দীর্ঘতর। সন্ধ্যার পর এ দৃশ্য নিত্যদিনের। কখনো কখনো এর জের গিয়ে পড়ে শনিরআখড়া-রায়েরবাগ ছাড়িয়ে মাতুয়াইল পর্যন্ত। এতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে যাত্রীদের। অন্যদিকে পলাশী প্রান্তে দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টাই থাকে গাড়ির সারি। যানজটের এ অবস্থা দেখে মনে হয়, মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভার সে কারণে নির্মাণ করা হয়েছে সে উদ্দেশ্যই এখন ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। অবশ্য কর্তৃপক্ষ নিজস্ব লোকবল ফ্লাইওভারের উপরে নিয়োগ দিলেও এতে কাজ হচ্ছে না। এ অবস্থার জন্য যাত্রী সাধারণ বেশক’টি কারণ উল্লেখ করেছেন। শনিরআখড়া থেকে প্রতিদিন ফ্লাইওভার পাড়ি দিয়ে বসুন্ধরা শপিং মলে ব্যবসা কেন্দ্রে যান মোহাম্মদ আওলাদ হোসেন। তিনি বলেন, সকালে কর্মচারীরা দোকান খোলেন। আমি দুপুরের দিকে বের হই। প্রথম দিকে এমন না হলেও গত দুই-তিন মাস ধরে আর পারছি না। ফ্লাইওভারের মাঝ বরাবর থেকেই শুরু হয় যানজট। এ যানজট ঠেলে টোলবক্স পর্যন্ত যেতেই লেগে যায় কখনো আধঘণ্টা, কখনো একঘণ্টা। এর কারণ হিসাবে আওলাদ বলেন, গুলিস্তান হলের সামনে সিগন্যালে আটকে থাকে গাড়ি। এর জের গিয়ে পড়ে ফ্লাইওভারে। টোলবক্সের সামনে পর্যন্ত যানজট গিয়ে ঠেকে। ফলে টোলবক্স থাকে অকেজো। গাড়ি ছাড়ার জায়গা পায় না। এতে দশ মিনিটেই দেখা দেয় লম্বা লাইন। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে যানজটের দীর্ঘ লাইনও। যাত্রী ও চালকরা এ যানজটের কারণ হিসাবে লোকাল বাসগুলো যত্রতত্র পার্কিং করে যাত্রী উঠানো-নামানো, টোল আদায়ে ধীরগতি ও ট্রাফিক অব্যবস্থাপনার কারণকে দায়ী করেন। গতকাল বেলা ১১টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত হানিফ ফ্লাইওভারের বিভিন্ন লেনে গিয়ে দেখা যায় বিভিন্ন স্থান থেকে আগত শহরমুখী গাড়ি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফ্লাইওভারের উপর যানজটে আটকে আছে। দূর-দূরান্ত থেকে আসা অনেক যাত্রী ও চালকরা যানজটে বসে বিরক্তি প্রকাশ করছেন। নারায়ণগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা উৎসব পরিবহনের চালক মনির হোসেন বলেন, ফ্লাইওভার থেকে নামার গুলিস্তান অভিমুখে লোকাল বাসের চালকরা রাস্তা বন্ধ করে যাত্রী নামায়। এতে পেছনের গাড়িগুলো সামনে এগুতে পারে না। মঞ্জিল পরিবহনের চালক গিয়াস উদ্দিন জানান, বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা বাস ফ্লাইওভার থেকে নেমে ডানে ইউটার্ন নেয়। আর সেখানে হলো মাওয়া ইলিশ পরিবহনের টার্মিনাল। ফ্লাইওভারের ওই টার্মিনাল থেকে মিনিটে মিনিটে গাড়ি রাস্তা ব্লক করে থাকে। এছাড়া লোকাল বাসগুলো ইউটার্ণে দাঁড়িয়ে যাত্রী তুলে। ফলে পেছনে গাড়ির সাড়ি দীর্ঘ হতে থাকে, যা কখনো কখনো ফ্লাইওভার ছাড়িয়ে শেষ পর্যায়ে গিয়ে ঠেকে। এছাড়া গুলিস্তান হলের সামনে সিগন্যালে অনির্দিষ্ট সময় দাঁড় করিয়ে রাখা হয় ফ্লাইওভার থেকে নেমে আসা গাড়িগুলোকে। এ অবস্থায় জায়গা ফাঁকা না হলে ফ্লাইওভারের গাড়ি সামনে এগুতে পারে না। আর ফ্লাইওভার থেকে নেমে ডানে টার্ন নেয়ার স্থলে ট্রাফিক পুলিশ থাকে। তাদের দেখা যায়, বেশিরভাগ সময় বিভিন্ন গাড়ি থেকে টাকা নিতে। ফলে এখানে গাড়ি ব্রেক করতে হয়, যা যানজটকে আরো দীর্ঘ করে। হিমাচল পরিবহনের চালক রফিক বলেন, অনেক গাড়ি আছে যাদের শেষ সীমানা ফ্লাইওভারের শেষ প্রান্ত গুলিস্তান মোড়ে। এই বাসগুলো সবসময় এখানেই জটলা বাধায়। ট্রাফিককে টাকা দিয়ে অবৈধ ভাবে এলোমেলো ভাবে পার্কিং করে রাখে। গোপালগঞ্জ-টুঙ্গিপাড়া থেকে আগত ইমাদ এসি বাসের চালক ফারুক হোসেন বলেন গতকাল রাতে রওয়ানা দিয়েছি। পুরো রাস্তায় যানজটে ছিলাম। ফ্লাইওভারের উপর এসে প্রায় ৪০ মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে আছি। সামনের দিকে গাড়ি যাচ্ছে না। একদিকে যেমন টোল নিতে দেরি করে অন্যদিকে কিছু লোকাল বাস ফ্লাইওভারের উপর যাত্রী নামাচ্ছে। এলোমেলো ভাবে দাঁড়িয়ে থেকে রাস্তা বন্ধ করে দেয়। নারায়ণগঞ্জ থেকে গুলিস্তানগামী বন্ধন বাসের চালক হিমু মিয়া জানান, টোল আদায়কারীরা টাকা নিতে অনেক সময় নেয়। এছাড়া ফ্লাইওভার থেকে নামার পর সামনের মোড়ে ট্রাফিকরা সিগন্যাল দিয়ে গাড়ি আটকে দেয়। আর এই চাপটা ফ্লাইওভারের উপর থাকা গাড়ির উপর পড়ে। বন্ধন বাসের যাত্রী হুমায়ুন কবির জানান, প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে ফ্লাইওভারের উপরে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছি। পেশায় ব্যবসায়ী হওয়ায় প্রতিদিনই তিনি নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা আসেন। তিনি জানান, পুরো রাস্তা আসতে যেটুকু সময় লাগে হানিফ ফ্লাইওভার থেকে নামতে তার চেয়ে বেশি সময় লাগছে। কারণ হিসাবে তিনি জানান, টোল কর্তৃপক্ষ টোল নিতে সময় নেয়া এবং ফ্লাইওভার থেকে নামার সময় রাস্তা আটকে রাখে ট্রাফিকরা। গাউসিয়া থেকে আসা গ্লোরী বাসের যাত্রী আল আমিন জানান, ফ্লাইওভার থেকে যেসব রোডে গাড়ি যাবে সেসব সড়ক এখন হকারদের দখলে। সরজমিন দেখা যায়, হানিফ ফ্লাইওভারের চারটি লেন দিয়ে আসা গাড়িগুলো একটি লেন দিয়ে গুলিস্তান নামছে। নামার পর এসব গাড়ি বিভিন্ন দিকে সহজে যেতে পারছে না। কারণ সেখানে বামপাশ থেকে একটি সড়ক নবাবপুর, ফ্লাইওভার থেকে সোজা সড়কটি ফুলবাড়িয়া, ডানপাশের সড়কটি গুলিস্তান জিরো পয়েন্টের দিকে চলে গেছে। কিন্তু নবাবপুর, ফুলবাড়িয়া ও জিরো পয়েন্টের দিকে যাওয়ার রাস্তায় গাড়ির চাপ বেশি থাকায় এই যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। এছাড়া গুলিস্তান থেকে চিটাগাংগামী তারাব, গাউসিয়াগামী গ্লোরী, মদনপুরগামী শ্রাবণ, আদমজিগামী কোমল পরিবহন, ডেমরাগামী গ্রীণবাংলাসহ আরো একাধিক বাসের কাউন্টার ফ্লাইওভারের মুখে। এলোমেলো ভাবে বিভিন্ন গন্তব্যে ছেড়ে যাওয়া বাস যাত্রী উঠানোর জন্য দাঁড়িয়ে থাকে। কর্তব্য পালনরত একজন ট্রাফিক সার্জেন্ট বলেন, চারটি লেন দিয়ে আসা গাড়িগুলো একটি লেন দিয়ে নামছে। কিন্তু এই চাপ সামলানোর মতো পর্যাপ্ত জায়গা নেই। কারণ হিসাবে তিনি বলেন, জিরো পয়েন্টে গাড়ির চাপ বেশি থাকায় এদিকে চাপ বেড়ে যায়। ফ্লাইওভার দিয়ে আসা গাড়ি আটকে অন্য রোডের গাড়ির চাপ কমানোর জন্য ফ্লাইওভারে যানজট লাগছে। তিনি আরো বলেন, সামনে ঈদ। এসময় শহরের বাইরে থেকে গাড়ি আসছে। এছাড়া বিভিন্ন ডেলিভারি ভ্যানের সংখ্যা ঈদের সামনে রেখে বেড়ে যায়। যার কারণে যানজট বাড়ছে। ফ্লাইওভারের টোল প্লাজা পার হয়ে লোকাল বাসের চালকরা যাত্রী নামায় এমন অভিযোগ নিয়ে তিনি বলেন, লোকাল বাস এই কাজ করে থাকে। কিন্তু তাদের জন্য সমস্যা হচ্ছে না। ফ্লাইওভারের দীর্ঘ যানজটের কারণ জানতে চাইলে টোল কালেক্টর জয় দাস জানান, তিনি এ বিষয়ে কিছুই জানেন না। তার কাজ শুধু টোল আদায় করা। সেখানে অরিয়নের নিরাপত্তাকর্মী মোস্তফা জানান, তিনি এ নিয়ে কোনো কথা বলতে পারবেন না। তবে লোকাল বাসের চালকরা যত্রতত্র যাত্রী উঠা-নামানো করায় এলোমেলোভাবে গাড়ি পার্কিং করে রাস্তা বন্ধ করে দেয়। ঠিক তাদের কারণে যানজট লাগছে এমন অভিযোগ অধিকাংশ লোকাল বাসের চালক মানতে নারাজ। তারাব বাসের চালক হারুন মিয়া জানান, টোল কালেক্টররা টোল আদায়ে সময় বেশি নেয়। কোমল বাসের চালক জানান, কিছু কিছু লোকাল বাস ফ্লাইওভার থেকে নামার সময় মাঝপথে যাত্রী নামায়। কারণ টোল প্লাজার আগে ফ্লাইওভারের ডান পাশে পথচারী বের হয়ে যাবার দুটি রাস্তা করা হয়েছে। তাই চালকরা টোলপ্লাজার আগেই বাস থামিয়ে যাত্রী নামিয়ে দেয়। যার কারণে পেছনের গাড়ি সামনে এগুতে পারে না।

এদিকে হানিফ ফ্লাইওভারের আরেকটি ঢাল নেমেছে চাঁনখারপুল মোড়ে। সেই ফ্লাওভারেও দেখা যায় লাইন ধরে গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে। কারণ ফ্লাইওভারের নিচে সিটি করপোরেশন ও ঢাকা মেডিকেলের বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের নতুন ১৮তলা ভবন নির্মাণের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একুশে হল ও শহিদুল্লাহ হলের পাশের দুটি গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কুতুবখালী রাস্তায় সংস্কার কাজ চলায় নিচের গাড়ি এখন ফ্লাইওভারের উপর দিয়ে আসছে। ফলে গাড়ির চাপ বাড়ছে। চাঁনখারপুল মোড়ে কর্তব্যরত ট্রাফিক সার্জেন্ট বেলাল জানান, নাজিমউদ্দিন রোডে হাঁটু সমান পানি জমে আছে। এছাড়া দুটি রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে উন্নয়ন কাজ চলছে। আগে যে গাড়ি নিচের দুই রাস্তা দিয়ে চলাচল করতে পারতো। এখন চতুর্মুখী চাপটা সামাল দিতে ট্রাফিকরা হিমশিম খাচ্ছেন। এই রোড দিয়ে যাতায়াতকারী অনেক চালক-যাত্রীরা জানিয়েছেন তাদের ভোগান্তির কথা। গ্রামীণ শুভেচ্ছা বাসের যাত্রী নিলুফা ইয়াসমিন জানান, ফ্লাইওভারে যানজট থাকাটা অস্বাভাবিক। চরম অব্যবস্থাপনার কারণে যানজট লাগছে। একই বাসের চালক ফরিদ জানান, ফ্লাইওভার থেকে নামার রাস্তায় ট্রাফিক দাঁড়িয়ে থাকে। তারা এই রাস্তা আটকে রাখে। এজন্য ফ্লাইওভারে যানজট লাগে। সরজমিন দেখা গেছে, ফ্লাইওভারের যাত্রাবাড়ী অংশ থেকেও যানজটের দীর্ঘ সারি। কারণ হিসাবে যাত্রীরা বলেন, সড়কের নব্বই ভাগ ব্যবহার করছে ফ্লাইওভার কর্তৃপক্ষ। আর দশ ভাগ ব্যবহার হচ্ছে নিচে। এর পাঁচ ভাগ ডানে। পাঁচ ভাগ বামে। রাজধানীতে প্রবেশে চট্টগ্রাম সিলেট বিভাগ ছাড়াও নরসিংদী, কিশোরগঞ্জের বাস প্রবেশ করে এ পথ দিয়ে। যার অর্ধেক নিচ দিয়ে যাতায়াত করে। কিন্তু নিচ দিয়ে সরু রাস্তা হওয়ায় একটির বেশি বাস চলাচল করতে পারে না। ফলে সৃষ্টি হয় যানজট। সাধারণ যাত্রীদের কথা- ফ্লাইওভার করা হয়েছে যাত্রী সাধারণের স্বস্তির জন্য। এখন এই ফ্লাইওভারই যাত্রী সাধারণের অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=80827&cat=2/