২৮ আগস্ট ২০১৭, সোমবার, ১১:০১

বহমান এই সময়ে

বিপর্যয়ের মুখে হাওর জনপদ

জি. মুনীর

এবারের বোরো ফসল ঘরে তোলার শুরুতেই হাওর এলাকায় হঠাৎ আসা বন্যায় ফসলের সাথে সাথে কৃষকের স্বপ্নও যেন ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। তখন বোরো ফসল-প্রধান হাওর এলাকার ছয় জেলাÑ সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সিলেট ও মৌলভীবাজারের প্রায় সব বোরো জমির ফসলই বন্যার পানিতে তলিয়ে যায়। চারদিকে ফসলহারা কৃষকের হাহাকারে হাওর এলকার বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। এ প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বন্যা পরিস্থিতি দেখার জন্য গত ৩০ এপ্রিল সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার হাওর এলাকা পরিদর্শনে যান। তিনি শাল্লায় এক জনসমাবেশে জানান, সরকার বন্যাকবলিত কৃষকদের শুধু ত্রাণ সরবরাহই করবে না, একই সাথে আগামী ফসলের আগ পর্যন্ত সরকার বিনামূল্যে সার ও বীজ সরবরাহ করবে। তিনি আরো বলেন, হাওর এলাকার জন্য ব্যাংকঋণের সুদ অর্ধেক করে দেয়া হয়েছে এবং ব্যাংকঋণ পরিশোধ স্থগিত করা হয়েছে।
কিন্তু বাস্তবে এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। এখন বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে খবর পাওয়া যাচ্ছে, ক্ষুদ্র্ঋণদাতারা হাওর এলাকার কৃষকদের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে তাদের ঋণের কিস্তি পরিশোধের জন্য। অথচ এখনো হাওর এলাকার ফসল হারিয়ে দিশেহারা এসব কৃষক নিজেদের খাবার পর্যন্ত জোগাড় করতে পারছেন না। গত ২৫ আগস্ট একটি জাতীয় ইংরেজি দৈনিকের খবরে জানা যায়Ñ বন্যায় হাওর এলাকার উল্লিখিত ছয় জেলায় ৪৬২৫ কোটি টাকার ফসল ক্ষতি হয়েছে। এসব জেলার হাজার হাজার কৃষকের জন্য জরুরি প্রয়োজন খাদ্য জোগাড় করা। এসব জেলার কৃষকেরা একমাত্র বোরো ফসলের ওপর নির্ভর করে সারা বছরের জীবিকা নির্বাহ করে। হঠাৎ আসা বন্যা ও অবিরাম বৃষ্টি এসব কৃষকের জীবনযাপনকে তছনছ করে দিয়েছে। সহযোগী দৈনিকটির খবর মতে, এসব জেলার ১২ লাখেরও বেশি কৃষক-পরিবার আগামী দিনে ভয়াবহ ধরনের খাদ্যসঙ্কটে পড়বে। বন্যা ও অবিরাম বৃষ্টির কারণে এই খাদ্যাভাবের আশঙ্কা করছে স্থানীয় জনগণ। তারা বলছে, এক দিকে খাদ্যাভাব অন্য দিকে নিত্যপণ্যের দাম অব্যাহতভাবে বেড়ে চলার ফলে এখন খাদ্যাভাব পরিস্থিতির মতো একটি পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
এ দিকে প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ অসময়ে আসা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হাওর জেলাগুলোর বিদ্যমান পরিস্থিতিতে তার গভীর উদ্বেগের কথা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘হাওর এলাকার একজন অধিবাসী ও একজন কৃষক-সন্তান হিসেবে এই পরিস্থিতি নিয়ে আমি খুবই উদ্বিগ্ন। এখন প্রয়োজন এর একটি স্থায়ী সমাধান। আগামী বোরো মওসুম পর্যন্ত কৃষকদের সহায়তা জোগাতে হবে।’ প্রেসিডেন্ট সুনামগঞ্জ জেলা পরিষদ মিলনায়তনে স্থানীয় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, জ্যেষ্ঠ নাগরিক, পেশাজীবী, শিক্ষাবিদ, মুক্তিযোদ্ধা সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে মতবিনিময়ের সময় এ কথা বলেন।
ঋণ আদায় স্থগিত রাখার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও ক্ষুদ্রঋণদাতারা অব্যাহতভাবে ঋণের কিস্তি পরিশোধের জন্য কৃষকদের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৩০ এপ্রিল এনজিও, ক্ষুদ্রঋণদাতা ও ব্যাংকগুলোর প্রতি সুনির্দিষ্টভাবে আহ্বান জানান আগামী ফসল কাটার মওসুমের আগ পর্যন্ত ঋণের কিস্তি আদায় বন্ধ রাখতে। সেই সাথে তিনি এ কথাও বলেন, তারা যেন প্রয়োজনে কৃষকদের নতুন ঋণ সরবরাহ করে। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, ঋণগ্রহীতা কৃষকদের ওপর ঋণদাতারা বিভিন্নভাবে মানসিক চাপ সৃষ্টির বাইরে কৃষকদের এমন হুমকিও দেয়া হচ্ছে যে, তাদেরকে ভবিষ্যতে আর কোনো ঋণ দেয়া হবে না, যদি না এরা ঋণের কিস্তি সময় মতো পরিশোধ করেন। যদিও ক্ষুদ্রঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো, যেমন ব্র্যাক, আশা ও গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকর্তারা ঋণের কিস্তি পরিশোধের জন্য উল্লিখিত চাপ সৃষ্টির কথা অস্বীকার করছেন, বাস্তবে দেখা গেছে প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষকেরা এ ধরনের চাপের মুখোমুখি হচ্ছেন। কয়েকটি জাতীয় দৈনিকের সরেজমিন প্রতিবেদনে এরই প্রতিফলন রয়েছে।
সুনামগঞ্জ জেলার বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার আধুখালি দক্ষিণহাটি গ্রামের প্রভাত দেবনাথ জানিয়েছেন, গত মার্চের বন্যা তার ফসল তলিয়ে নিয়েছে। তাকে গত এপ্রিল মাসে দু’টি ছাগল বিক্রি করতে হয়েছে তার সাপ্তাহিক ঋণের কিস্তি পরিশোধ করার জন্য। তিনি গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ৪০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন গত বন্যার সময়, কথা ছিল তিনি সপ্তাহে ১৫০০ টাকা করে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করবেন। কিন্তু তার পক্ষে এই কিস্তি পরিশোধ করা একেবারেই অসম্ভব বলে জানিয়েছেন প্রভাত দেবনাথ। তিনি আরো বলেন, ‘আমার বসবাসের ঘরের খড়ের বেড়া সাম্প্রতিক বন্যায় ধ্বংস হয়ে গেছে, আমি এটি মেরামত করতে পারছি না চরম অর্থাভাবে।’ কিন্তু গ্রামীণ ব্যাংকের মাঠকর্মীরা আরো শত শত কৃষকের মতো তার ওপরও যেকোনো উপায়েই ঋণের কিস্তি পরিশোরে জন্য চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছেন বলে তিনি অভিযোগ করেন।
একই গ্রামের গোপেন দেবনাথ একটি ইংরেজি দৈনিকের প্রতিনিধিকে জানান, বর্ষার মওসুমে মাছধরা ছাড়া আর কোনো আয়ের উৎস নেই। এ বছর মাছ খুবই অপ্রতুল। কারণ, গত মধ্য-এপিলে আগাম বন্যার পর আধা-ডুবা বোরো ধানের গাছের বিষাক্ত গ্যাসে পানিদূষণে মাছের মড়ক দেখা দিয়েছিল। তিনি বলেন, আমি ব্র্যাক থেকে ঋণ নিয়েছি ২০ হাজার টাকা।
শাল্লা উপজেলার বাহারা ইউনিয়নের কলাকান্দি গ্রামের হারাধন ঋষির স্ত্রী সতীবালা ঋষি বলেনÑ ‘আমার পরিবারের সদস্যদের অর্ধাহারে রেখে আমাকে প্রতি সপ্তাহে ৫৫০ টাকার সাপ্তাহিক ঋণকিস্তি পরিশোধ করতে হয়। আমাকে ব্র্যাক কর্মকর্তারা হুমকি দিয়েছেন, ঋণের কিস্তি নিয়মিত পরিশোধ না করলে ভবিষ্যতে আমাকে আর কোনো ঋণ দেয়া হবে না। নতুন কোনো ঋণ না নিলে আমার পক্ষে আগামী মওসুমে বোরো চাষ করা কঠিন হয়ে পড়বে। অতএব ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে তা আমার জন্য নতুন সমস্যার সৃষ্টি করবে।’ তিনি ওই দৈনিকের প্রতিনিধিকে জানান, তার পরিবার ব্র্যাক থেকে ২৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিল। এরই মধ্যে এর প্রায় ৭০ শতাংশই পরিশোধ হয়ে গেছে। এ দিকে স্থানীয় ইউনিয়ন কাউন্সিলের ২ নম্বর ওয়ার্ডের সংরক্ষিত মহিলা আসনের মেম্বার আভারানী ঋষি জানান, তার এলাকার গ্রামগুলোর প্রতিটি পরিবার কমপক্ষে একটি এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছে। কেউ কেউ একাধিক সংগঠন থেকেও ঋণ নিয়েছেন। তিনি বলেন,‘যারা শস্যঋণ নিয়েছেন, তারা এ বছর চরম মুশকিলে পড়েছেন। কারণ, আগাম বন্যা তাদের ফসল ধ্বংস করে ফেলেছে।’
সুনামগঞ্জ জেলার জামালগঞ্জ উপজেলার বিন্নাজুরি গ্রামের সমির আলী নামে এক বর্গাচাষি জানিয়েছেন, তার মতো জেলার হতদরিদ্রদের বেশির ভাগই ঋণ পরিশোধ না করার কারণে ঋণদাতাদের হাতে অপমানিত হওয়ার ভয়ে ভীত। তিনি এনজিও ‘আশা’র কাছ থেকে ১৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। কিন্তু গত মে মাস থেকে ঋণের কোনো কিস্তি পরিশোধ করতে পারেননি। মাঠকর্মীরা নিয়মিত তার বাড়িতে এসে ঋণকিস্তি পরিশোধের তাগাদা দিচ্ছেন। এ দিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে মাঠকর্মীরা সহযোগী গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের জানিয়েছেন, কর্মকর্তারা মাঠকর্মীদের নির্দেশ দিয়েছেন নিয়মিত ঋণের কিস্তি আদায় করার জন্য। তারা মাঠকর্মীদের আরো নির্দেশ দিয়েছেন, শারীরিক হামলা ছাড়া বাকি সব ধরনের কৌশল প্রয়োগ করে ঋণের কিস্তি নিয়মিত আদায় করতে। তবে ঋণদাতা সংস্থা ‘আশা’র জেলা ব্যবস্থাপক সমীরণচন্দ্র রায় মাঠকর্মীদের এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন। বরং তিনি বলেছেন, তাদের কর্মীদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে গ্রাহকদের ওপর কোনো ধরনের চাপ সৃষ্টি না করার জন্য। অবশ্য গ্রামীণ ব্যাংকের এরিয়া ম্যানেজার জহিরুল ইসলাম এ ব্যাপারে গণমাধ্যম প্রতিনিধির কাছে কোনো ধরনের মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। কারণটা নিশ্চয় অবোধগম্য নয়।
এ দিকে সাম্প্রতিক চলমান বন্যায় অন্যান্য অঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলোর অসহায় কৃষকেরা একই ধরনের বিপত্তির মধ্যে পড়েছেন। গত শনিবারে নয়া দিগন্তে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, দিনাজপুর শহরের সুইহারী ড্রাইভারপাড়া এলাকায় প্রায় প্রতিটি বাড়িতে বন্যার পানি উঠেছে। ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে খেয়ে না খেয়ে জীবন পার করছে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো। এমনি পরিস্থিতিতে ঋণের কিস্তির টাকার তাগাদা নিয়ে তাদের কাছে হাজির হচ্ছেন একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মীরা। যারা কিস্তির টাকা দিতে পারছেন না, তাদের গরু-ছাগল জোর করে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ প্রসঙ্গে একজন ভুক্তভোগী ঋণগ্রহীতা নয়া দিগন্ত প্রতিনিধির কাছে বলেছেন, ‘ঋণ আদায়কর্মীরা এক-একটা দানবের মতো আচরণ করছে। তাদের কাছে মানবতা বলে কিছু নেই। আমরা মরলাম কি বাঁচলাম, তা এরা দেখে না। তাদের কিস্তির টাকা দিতেই হবে। তাদের ব্যাংক থেকে ১০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলাম। সপ্তাহে ৫০০ টাকার কিস্তি পরিশোধ করতে হয়। বন্যায় কামাই-রোজগার না থাকায় কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে পারিনি। অনেক অনুরোধের পর বলেছে, আগামী সপ্তাহে এক সাথে দুই সপ্তাহের কিস্তি দিতে হবে।’
সারা দেশেই কার্যত এবার বন্যার প্রকোপ। বন্যাকবলিত এলাকার কৃষকদের ঋণকিস্তি আদায় বন্ধ থাকার সরকারি নির্দেশনা, এমনকি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা কেউ মানছে না। ফলে ঋণগ্রস্ত কৃষকেরা আজ দিশেহারা। এ দিকে ঋণের কিস্তি আদায়ে ঋণদাতা সংস্থা, এনজিও ও ব্যাংকগুলোর অমানবিক আচরণে দিশেহারা কার্যত গোটা দেশের কৃষক সমাজ। অপর দিকে বিভিন্ন মহল থেকে সাবধানবাণী উচ্চারণ করে এসব এলাকায় খাদ্যসঙ্কট সৃষ্টির সম্ভাবনার কথাও জানানো হচ্ছে। সরকারকে তাই এসব ব্যাপারে এখন থেকেই সচেতন না থাকলে বিপর্যয়কর অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। উপর্যুপরি বন্যা হাওর এলাকার গোটা কৃষক সমাজকে চরম দরিদ্র জনগোষ্ঠীতে পরিণত করতে যাচ্ছে, সে আভাসও স্পষ্ট। সে উপলব্ধি থেকেই হয়তো রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেছেন, এর একটি স্থায়ী সমাধান হওয়া দরকার। রাষ্ট্রপতির এই উপলব্ধি যথাযথ। যদি তাই হয়, তবে প্রথমেই নিশ্চিত করতে হবে বছর বছর আগাম বন্যা যেন ফসল ভাসিয়ে নিতে না পারে। আর আপাতত দরকার, বন্যাকবলিত কৃষকদের ওপর ঋণদাতাদের অমানবিক আচরণের শিকার হওয়া থেকে রক্ষা করার কার্যকর ব্যবস্থা। সেই সাথে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা।
ভুললে চলবে না, হাওর এলাকার কৃষক সমাজ এক সময় ছিল সচ্ছল জনগোষ্ঠী। এখন আর সে অবস্থায় নেই। ‘গোলা ভরা ধান আর হাওর ভরা মাছ’ প্রবাদটি এক সময় প্রচলিত ছিল এই হাওর জনপদে। এখন সেই হাওর এলাকা পরিণত হতে যাচ্ছে দেশের দরিদ্র এক জনগোষ্ঠীতে। এবার আগাম বন্যা তাদের সবচেয়ে বেশি নাজুক করে তুলেছে। এবার বন্যার পর হাওর এলাকার প্রায় অর্ধেক মানুষ এলাকা ছেড়ে রুটি-রুজির সন্ধানে রাজধানীতে চলে এসেছে বলে স্থানীয় অনেকের অভিমত। সন্দেহ নেই, এবারের বন্যা আগামী বছরের কৃষির ওপর ভযাবহ নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। কারণ, অনেক কৃষকই উপায়ন্তর না পেয়ে হালের বলদ পর্যন্ত বিক্রি করে এলাকাছাড়া হয়েছেন। এরা এলাকায় ফিরবেন বা ফিরবেন না, কিংবা কী হালে ফিরবেন, তা নির্ভর করছে সরকারের পুনর্বাসন প্রক্রিয়া কেমন হবে, তার ওপর। কিন্তু এ ব্যাপারে সরকারের তরফ থেকে এখনো তেমন কোনো সুসংবাদ নেই।
শুধু হাওর এলাকাই বা বলি কেন, সারা দেশের গ্রামীণ দারিদ্র্য পরিস্থিতি সুখকর নয়। আবহওয়ার বিরূপ প্রতিক্রিয়া ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং এর সাথে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিবেশে প্রক্রিয়ার আন্তঃক্রিয়া গ্রামীণ দারিদ্র্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করছে। সম্পদের অভাবের দেশ বাংলাদেশের দারিদ্র্য দমন যেন এখন হয়ে উঠেছে অদম্য। এটি প্রথমত একটি ‘গ্রামীণ প্রপঞ্চ’। দেশের ৫৩ শতাংশ গ্রামীণ জনগোষ্ঠী দরিদ্র শ্রেণিভুক্ত। এদের কিভাবে দারিদ্র্যের বৃত্ত থেকে বের করে আনা যায় সে এক স্বতন্ত্র চিন্তা। সে চিন্তা-ভাবনা সরকারি মহলে কতটুকু আছে তা বোধগম্য নয়। তবে প্রচারসর্বস্ব উন্নয়নের জারিজুরি কার্যত জাতীয় উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে। লোক দেখানো উন্নয়ন উদ্যোগ থেকে সরকার যতদিন বের হয়ে এসে সত্যিকারের উন্নয়ন উদ্যোগে মনোনিবেশ করবে, ততদিন গ্রামীণ দারিদ্র্যের তীব্রতা শুধু বাড়তেই থাকবে। আর এর পরিণতি জাতিকে বহন করতেই হবে।
সবশেষে আবারো বলছি, হাওর এলাকার মানুষ এখন দুর্বিষহ বিপর্যয়ের মধ্যে আছে। এরা আমাদের কৃষি অর্থনীতির মেরুদণ্ড। এদের বিনাশ একদিন জাতীয় অর্থনীতিকে বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে নিয়ে দাঁড় করালে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। তাই এবারের বন্যাপরবর্তী সময়ে হাওর এলাকার পুনর্বাসনে শুধু নেতানেত্রীদের বক্তব্য-বিবৃতিকেন্দ্রিক প্রতিশ্রুতি ঘোষণাই যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন রাজনৈতিক স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে বাস্তবসম্মত কার্যকর পরিকল্পনা নিয়ে দ্রুত মাঠে নামা। এবার দেখার পালা, সরকার সে দায়িত্ব পালনে কতটা আন্তরিক, না বরাবরের মতো এবারো চলবে সেই পুরনো লিপ সার্ভিসের খেলা।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/247702