২৭ আগস্ট ২০১৭, রবিবার, ১১:১০

'চা-পানি' ছাড়া জিডি হয় না

বুধবার, দুপুর ১২টা। বাড্ডা থানা থেকে বের হলেন দুই যুবক। তাদের একজনের হাতে একটি কাগজ, জিডির কপি। থানার চত্বর পেরিয়ে মূল সড়কে ওঠার পর তাদের সঙ্গে কথা হয়। থানায় আসার কারণ জানতে চাইলে একজন জানালেন, জিডি করতে এসেছিলেন। যিনি জিডি করেছেন, তার নাম খোরশেদ আলম রাকিব। পাওনা টাকা নিয়ে শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সঙ্গে তার ঝামেলা তৈরি হয়েছে। প্রতিকার চেয়ে আইনি সহায়তার জন্য থানায় এসেছেন। থানায় কী ধরনের সহায়তা পেলেন? জিডি করতে কি টাকা লেগেছে? এসব প্রশ্নের উত্তরে রাকিবের সহজ স্বীকারোক্তি, 'চা-পানি খাওয়ার জন্য তো কিছু টাকা দেওয়া লাগেই। ২০০ টাকা দিয়েছি।'

 

শুধু বাড্ডা থানা নয়, রাজধানীর অধিকাংশ থানায় জিডি করার জন্য ভুক্তভোগীদের টাকা দিতে হয়। কয়েকটি থানায় সরেজমিনে ঘুরে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। জিডি বা সাধারণ ডায়েরি করতে থানায় ঘুষ লেনদেনের টাকা পরিমাণে খুব বেশি না হলেও এতে বাহিনীর ইমেজ নষ্ট হচ্ছে বলে মনে করছেন পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। জিডি করতে আর্থিক লেনদেন বন্ধের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখেন পুলিশের নীতিনির্ধারকরা। প্রায়ই এসব বন্ধে দেওয়া হয় কঠোর নির্দেশনা। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের ডিসি মাসুদুর রহমান সমকালকে বলেন, জিডি করার জন্য কোনো পুলিশ সদস্য টাকা নিয়েছেন- এমন সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।


সর্বশেষ ২৩ জুলাই ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) জিডি ও মামলা দায়েরে হয়রানি বন্ধের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনাসহ একটি প্রজ্ঞাপন ডিএমপির সব অপরাধ বিভাগের ডিসি ও ৪৯ থানার ওসির দপ্তরে পাঠায়। তবে বাস্তবে তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই 'চা-পানি'র ব্যবস্থা ছাড়া জিডি করা সম্ভব হয় না। আবার অনেক ক্ষেত্রে জিডি করার পরও তার যথাযথ তদন্ত হয় না বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। কখনও কখনও আইনি প্রতিকার পাওয়ার বদলে বিপদে পড়ারও নজির রয়েছে। যে কারণে সাধারণ মানুষ নিতান্ত জরুরি প্রয়োজন ছাড়া শুধু জিডি করতে থানায় যেতে চান না।


শেরেবাংলা নগর থানা: বৃহস্পতিবার, দুপুর ১টা। শেরেবাংলা নগর থানা থেকে বের হন সাহাব উদ্দিন ও তার স্ত্রী নাজমা। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সাহাব উদ্দিন জাতীয় পরিচয়পত্র হারানোর ঘটনায় জিডি (নম্বর ১৬৮৮) করেছেন থানায়।


ঘটনাস্থলে সাহাব উদ্দিনের শ্বশুর আবদুস সালাম বলেন, জিডি করতে ২০০ টাকা লেগেছে। যিনি জিডি লিখেছেন, টাকা তিনিই নিয়েছেন। জিডি ফরমের খরচ লাগার কথা বলে টাকা নেওয়া হয়েছে।


বৃহস্পতিবার দুপুর সোয়া ১টার দিকে থানার সামনে সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে কথা হয় মিরপুর এলাকার লেগুনাচালক বিল্লালের সঙ্গে। তিনি জানান, গাড়ির কাগজ হারানোর বিষয়ে তিনি থানায় জিডি (নম্বর ১৬৯১) করে বের হয়েছেন। তার কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে ১০০ টাকা।


দুপুর ১টা ৪০ মিনিটের দিকে কথা হয় সামসুল হক নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে। তিনি জানান, তার বাবা জাভেদ আলীর জাতীয় পরিচয়পত্র হারানোর বিষয়ে জিডি (নম্বর ১৬৮১) করেছেন শেরেবাংলা নগর থানায়। জিডি করতে তার কাছ থেকে ৫০ টাকা নেওয়া হয়। তিনি বলেন, 'আমার কাছে বেশি টাকা ছিল না। ৫০ টাকা দেখে এক স্যার বলেন, বড় নোট বের কর। আমি বলি, স্যার, এ ছাড়া নেই। এর পর ওই ৫০ টাকাই নিল।'


দুপুর আড়াইটার দিকে থানার সামনের ফুটপাতে কথা হয় টুম্পা আক্তার নামের এক তরুণী ও তার মা পান্না বেগমের সঙ্গে। জাতীয় পরিচয়পত্র হারানোর বিষয়ে টুম্পা জিডি (নম্বর ১৬৯৫) করেছেন। তাদের কাছ থেকে ২০০ টাকা দাবি করা হলেও তারা টাকা দেননি বলে জানান।


শেরেবাংলা নগর থানায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওই দিন সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত ডিউটি অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এসআই নুরুল ইসলাম। জিডি করতে টাকা নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি দাবি করেন, কারও কাছ থেকে টাকা রাখা হয়নি। জিডি করার পর কেউ কেউ চা খাওয়াতে চেয়েছিল।


আদাবর থানা: বুধবার রাতে শ্লীলতাহানির অভিযোগে আদাবর বায়তুল আমান হাউজিং এলাকার এক নারী বাদী হয়ে আদাবর থানায় জিডি করেন। রাত ৯টার দিকে ওই নারী থানা থেকে বের হওয়ার পর কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি জানান, জিডি করার পর চা খাওয়ার জন্য ১০০ টাকা দিয়েছেন। টাকাটা কাকে দিয়েছেন- জানতে চাইলে বলেন, 'যে সিল মেরেছে, তাকে দিয়েছি।'


থানার সামনে আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জিডি করতে আসা সবার কাছ থেকে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্য টাকা চান না। পোশাক-পরিচ্ছদ দেখে বুঝেশুনে টাকা দাবি করা হয়। সাধারণত শিক্ষিত ও স্মার্ট ব্যক্তির কাছ থেকে টাকা দাবি করা হয় না। থানায় সেবাপ্রত্যাশী এক যুবক বলেন, 'থানায় তো লেখা আছে- জিডি করতে কোনো টাকা লাগে না। টাকা দেবো কেন?'


ডিএমপির নির্দেশনায় যা বলা আছে: ডিএমপির প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, জিডি ও মামলা দায়েরের ক্ষেত্রে সব ধরনের হয়রানি বন্ধ করতে হবে। কোনোভাবেই থানার ওয়্যারলেস অপারেটর জিডি লিখতে পারবেন না। এরই মধ্যে কেন্দ্রীয়ভাবে জিডি লেখা ফরম ডিএমপির সব থানায় সরবরাহ করা হয়েছে। জিডি দায়েরে হয়রানি বন্ধে সার্বক্ষণিক তদারকির ওপর জোর দেওয়া হয়। এ ছাড়া অর্থ আদায়ের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা হয়েছে।


কেন জিডি: জেনারেল ডায়েরি বা জিডি কোনো থানার নিজস্ব কার্যক্রম। থানার আওতাভুক্ত এলাকায় সংঘটিত ও পুলিশের নজরে আনা যাবতীয় ঘটনার একটি সরকারি দলিল হলো জিডি। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৫৪ ও ১৫৫ ধারা অনুযায়ী থানায় জিডি বই সংরক্ষণ করা বাধ্যতামূলক। জিডি বই লিখন ও সংরক্ষণ সম্পর্কে পুলিশ প্রবিধানের ৩৭৭ ধারায় বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। পাসপোর্ট, সার্টিফিকেট, দলিল, লাইসেন্স, মূল্যবান রসিদ, চেকবই, মোবাইল ফোনসেট, এটিএম বা ক্রেডিট কার্ড, স্বর্ণালঙ্কার ও নগদ অর্থ হারালে জিডি করা হয়। কোনো হুমকির মুখোমুখি হলে বা হুমকির আশঙ্কা থাকলে কিংবা কেউ নিখোঁজ হলেও জিডি করার সুযোগ রয়েছে। জিডির অভিযোগের ভিত্তিতে আমলযোগ্য অপরাধ হলে তদন্ত শেষে মামলা করার নিয়ম আছে। হত্যার হুমকি দেওয়ার ঘটনায় থানায় জিডি হলে দণ্ডবিধি ৫০৬ ধারা অনুযায়ী তা তদন্তে আদালতের অনুমতি চায় পুলিশ। জমিজমার বিরোধ নিয়ে কোনো পক্ষ জিডি করলে কার্যবিধি ১০৭ ও ১০৯ ধারায় পুলিশ সরাসরি তদন্ত শুরু করতে পারে। ডিএমপির একজন কর্মকর্তা বলেন, মামলার মতো জিডির সুনির্দিষ্ট হিসাব রাখা কষ্টসাধ্য। তবে গড়ে প্রতিবছর রাজধানীর ৪৯ থানায় পাঁচ লাখ জিডি হয়ে থাকে।


জিডির সঠিক তদন্ত হয় না: অভিযোগ আছে, অনেক ঘটনায় ভুক্তভোগীরা জিডি করলেও তার সঠিক তদন্ত হয় না। ফলে পরবর্তী সময়ে অনেক বড় ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটেছে। চলতি বছর কলাবাগানে ব্যাংক কর্মকর্তা আরিফুন নেছা আরিফাকে নৃশংসভাবে হত্যা করেন তার সাবেক স্বামী ফখরুল ইসলাম রবিন। ঘটনার ছয় মাস আগে রবিন ও আরিফার বিবাহবিচ্ছেদ হয়। এরপর নানাভাবে আরিফাকে উত্ত্যক্ত করতেন রবিন। একাধিকবার তাকে মেরে ফেলারও হুমকি দিয়েছিলেন। এ ঘটনায় কলাবাগান থানায় সাবেক স্বামীর বিরুদ্ধে জিডি করেও প্রতিকার পাননি আরিফা। শেষ পর্যন্ত সাবেক স্বামীর হাতে প্রাণ দিতে হয় তাকে।


এ ছাড়া শ্বশুর উত্ত্যক্ত করছেন- এমন অভিযোগে সম্প্রতি এক নারী মিরপুর থানায় জিডি করেন। তবে কোনো প্রতিকার না পেয়ে মামলা করতে চাইলে পুলিশ গড়িমসি করে। অনেক দেনদরবারের পর গত বৃহস্পতিবার মিরপুর থানা পুলিশ ওই নারীর মামলা নেয়। ২০১৫ সালে লালমাটিয়ায় জঙ্গিরা হামলা করে শুদ্ধস্বরের কর্ণধার আহমেদুর রশীদ টুটুলের ওপর। ওই ঘটনার আগেই তিনি থানায় হামলার আশঙ্কার কথা জানিয়ে জিডি করেছিলেন।


২০১২ সালের ৩০ এপ্রিল রাজধানীর উত্তর বাড্ডার নিজ বাড়িতে খুন হন শিল্পকলা একাডেমির সাবেক পরিচালক মো. নজরুল হক। হত্যাকাণ্ডের আগেই নিহতের স্বজনরা বাড্ডা থানায় পাঁচটি জিডি করেন। কিন্তু কোনো প্রতিকার পাননি। ২০১০ সালে গুলশানে ব্যবসায়ী সাদেকুর রহমান ও তার স্ত্রী রোমেনা নার্গিসকে বাসায় ঢুকে নৃশংসভাবে হত্যা করে বখাটে যুবক রুবেল। ঘটনার কিছুদিন আগে থেকেই সাদেকুরের স্কুলপড়ূয়া মেয়েকে বিয়ে করার জন্য চাপ দিয়ে আসছিল রুবেল। বিয়ে না দিলে তাদের হত্যা করা হবে বলে হুমকি দেয় সে। সাদেকুর গুলশান থানায় জিডি করেছিলেন। জিডির খবর শুনে রুবেল ক্ষিপ্ত হয়। এর কয়েক দিন পরই সে ওই দম্পতিকে হত্যা করে।


পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা জানান, জিডির ঘটনা যথাযথভাবে তদন্ত করতে ডিএমপির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা থানা পুলিশকে বিভিন্ন সময়ে কড়া নির্দেশ দেন। হয়রানি কমাতে অনলাইনে জিডি করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও তাতে তেমন সাড়া মেলেনি। তবে ভুক্তভোগীরা জানান, অনেক সময় জিডিই তাদের জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

http://bangla.samakal.net/2017/08/27/320570