২৭ আগস্ট ২০১৭, রবিবার, ১১:০৪

বন্যায় আমন চারার সংকট

এবারের বন্যায় উত্তরের জেলাগুলোতে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ধানই বন্যাকবলিত এলাকাগুলোর প্রধান ফসল। বন্যার সময় রোপা আমনের মৌসুম চলছিল। পানিতে বেশির ভাগ জমির ধানের চারা নষ্ট হয়েছে। বন্যার অল্প কিছুদিন আগে এসব চারা লাগানো হয়েছিল। কুড়িগ্রাম ও দিনাজপুর জেলার বানে ডোবা খেতগুলোতে দেখা গেছে, চারা পচে কালো হয়ে আছে।
কৃষকেরা জানিয়েছেন, যাঁরা জমিতে এক দফা সার দিয়েছিলেন, তাঁদের পুরো জমির চারাই পচে গেছে। যাঁরা সার দেননি এবং যেসব জমির পানি দ্রুত নেমে গেছে, সেখানে কিছু চারা রক্ষা পেয়েছে।

সরকারিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের কৃষি ত্রাণ হিসেবে আমনের চারা, দানাদার শস্যের বীজ ও সার বিতরণের কথা ঘোষণা করা হলেও মাঠপর্যায়ে কৃষকদের হাতে এখনো সেই সাহায্য এসে পৌঁছায়নি। বাজারে আমনের চারার তীব্র সংকট। অল্পস্বল্প যে চারা পাওয়া যাচ্ছে, তার দাম স্বাভাবিকের চেয়ে তিন–চার গুণ বেশি। তাই অধিকাংশ কৃষকের পক্ষেই নতুন করে চারা কিনে আবাদ করা সম্ভব হচ্ছে না।

সরকারি হিসাবে এ পর্যন্ত ৪০ জেলায় ৬ লাখ ৫২ হাজার ৬৫৪ হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এবার প্রতি হেক্টর জমি সাড়ে তিন টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। সেই হিসাবে তলিয়ে যাওয়া জমিতে অনাবাদি পড়ে থাকলে আমন মৌসুমে ২৩ লাখ টন চাল উৎপাদন কম হবে।
কুড়িগ্রামে চারার জন্য ছোটাছুটি
কুড়িগ্রামে রোপা আমন ও সবজিজাতীয় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। চারা ও বীজের সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। রোপা আমনের চারার জন্য কৃষকেরা জেলার বিভি
ন্ন জায়গায় ছুটছেন। কুড়িগ্রামের ৯ উপজেলায় রোপা আমন চাষ করা হয়েছিল ৯৯ হাজার ৮৭৭ হেক্টর জমিতে। এ ছাড়া বীজতলা করা হয়েছিল ১ হাজার ৯৩৯ হেক্টর এবং শাকসবজি ২ হাজার ৩১৫ হেক্টর জমিতে। বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে ৫০ হাজার ৩১ হেক্টর জমি।

গতকাল পাঁচগাছি ইউনিয়নে গিয়ে দেখা যায়, শত শত একর জমির রোপা আমন নষ্ট হয়ে গেছে। এসব জমি খালি পড়ে আছে। চারার অভাবে কৃষকেরা নতুন করে আবাদ করতে পারছেন না। চারার জন্য হাহাকার শুরু হয়ে গেছে। কৃষক আবদুল বাতেন বলেন, এখন পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সঙ্গে কেউ যোগাযোগ করেনি।
পাঁচগাছি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমরা এখনো ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ তৈরি করতে পারিনি। কৃষকদের এখন কৃষি ত্রাণ হিসেবে আমনের চারা এবং ডাল, ভুট্টা ও সবজির বীজ দেওয়া উচিত। তাহলে চাষাবাদ শুরু হলে মানুষ কাজ করে খেতে পারবে।’
দিনাজপুরে অসময়ে আবার বীজতলা
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর দিনাজপুর কার্যালয়ের দেওয়া তথ্যমতে, এ বছর বন্যার শুরুতে জেলায় ২ লাখ ২২ হাজার হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে যায়। এর মধ্যে ২৫ হাজার ৪০০ হেক্টর জমির ফসল সম্পূর্ণ নষ্ট হয়েছে।
ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়া কৃষকেরা বলেছেন, কৃষি বিভাগের কাছ থেকে এখন পর্যন্ত তাঁরা বীজ, সার, ওষুধের কোনো সহায়তাই পাননি। উল্টো চড়া দামে কিনতে হচ্ছে আমনের চারা ও বীজ।

চিরিরবন্দর উপজেলার সন্তোষপাড়া গ্রামের কৃষক মোকসেদ আলী বলেন, বন্যায় তাঁর চার একর জমির আমন আবাদ নষ্ট হয়ে গেছে। প্রতি বিঘায় খরচ হয়েছিল প্রায় ৮ হাজার টাকা। নতুন করে আবাদ করতে এখন প্রতি বিঘায় গড়ে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। চারা-বীজ পাওয়া যাচ্ছে না। দাম বেশি। একই কথা জানান আবদুলপুর গ্রামের জনাব আলী ও দেলোয়ার হোসেন। কৃষি বিভাগ থেকে তাঁদের নতুন করে বীজতলা তৈরির পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখন অসময়ে বীজতলা করে সেই চারা যখন জমিতে লাগানো হবে, তখন ফলন অনেক কম হবে। রোগবালাইয়ের প্রকোপ বাড়বে এবং পরে রবি মৌসুমের ফসল চাষের ক্ষেত্রেও তাঁরা পিছিয়ে পড়বেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর দিনাজপুর কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. গোলাম মোস্তফা গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, আগামী রোববার থেকে পর্যায়ক্রমে ১ হাজার কৃষককে আমনের চারা এবং ২০০ কৃষককে আমনের বীজ দেওয়া হবে।
তারাগঞ্জে চারার দাম দ্বিগুণের বেশি
রংপুর-দিনাজপুর মহাসড়কের পাশে তারাগঞ্জের ভেড়ভেড়ি মাঠে ধানের চারা রোপণ করছেন পাঁচজন কৃষক। গতকাল শনিবার সকাল সাড়ে ১০টায় তাঁদের একজন বালাপাড়া গ্রামের আবদুল ছালেক বললেন, চার দিন ধরে অনেক খুঁজে বেশি দামে অল্প কিছু চারা এনে রোপণ করেছেন।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, তারাগঞ্জ উপজেলায় বানে ডোবা খেত থেকে পানি নেমে গেছে। এরপরই কৃষকেরা নতুন চারা রোপণ করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। তবে অনেকেই নতুন করে রোপণের জন্য পর্যাপ্ত চারা পাচ্ছেন না। মধুরামপুর গ্রামের কৃষক আফজাল হোসেন ও দুলাল হোসেন বলেন, এক বিঘা জমিতে রোপণের জন্য চারা কিনতেই তাঁদের প্রায় ৩ হাজার ৪০০ থেকে ৩ হাজার ৫০০ টাকা লাগছে। বন্যার আগে খরচ পড়ত ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকা। কৃষকেরা জানান, এখন পর্যন্ত সরকারিভাবে চাষাবাদের জন্য কোনো সাহায্য পাননি।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা রেজাউল করিম বলেন, বন্যায় ১ হাজার ৬০০ হেক্টর আমন ধান, ১২০ হেক্টর সবজি, আদাখেত নষ্ট হয়েছে। এতে কৃষকের প্রায় ১৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কৃষকদের পুনর্বাসনের জন্য কোনো টাকা আসেনি। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকেরা নিজ উদ্যোগে চারা সংগ্রহ করে জমিতে ধান রোপণ করছেন। এ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত ৫০ শতাংশ কৃষক জমিতে ধানের চারা রোপণ করেছেন।
গাইবান্ধায় এখনো চারা বিতরণ শুরু হয়নি
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয় সূত্র জানায়, এবারের বন্যায় গাইবান্ধায় ২৭ হাজার ১৬৭ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। এর মধ্যে রোপা আমন ২৬ হাজার ৮৬৮ হেক্টর, আমন বীজতলা ১৫১ হেক্টর, শাকসবজি ১৪৮ হেক্টর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল ৯০ জনের মধ্যে কৃষি ত্রাণ হিসেবে চারা বিতরণ করেছেন। তবে জেলার ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মধ্যে কবে থেকে চারা বিতরণ শুরু হবে, তা এখনো ঠিক হয়নি।
গত শুক্রবার ফুলছড়ি উপজেলার উড়িয়া ইউনিয়নের রতনপুর গ্রামের কৃষক সিদ্দিক মিয়া প্রথমআলোকে বললেন, ‘হামার চার বিঘে জমির ৭৬ জাতের ধান ডুবি থাকি নসটো হচে। বেছন (বীজতলা) নসটো হচে। হামরা কিরষোক মানুষ। চাসাবাদ করি খাই। আবার ধান নাগামো ক্যামন করি? সোরকার থাকি কিচু দ্যায় নাই।’
কৃষকেরা জানান, এক বিঘা জমিতে রোপণের জন্য কেবল চারা কিনতেই ৪ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে।
লালমনিরহাটে চারা আসেনি
লালমনিরহাট সদর উপজেলার কুলাঘাটের চর শিবের কুটি গ্রামের কৃষক শাহ জামাল ও পূর্ব পাড়ের আবদুর রশিদ গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা সরকারি-বেসরকারি কোনো তরফ থেকেই কৃষি-সহায়তা পাননি।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা বলেন, জেলায় এবার ৮ হাজার ৭৯২ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। আর কৃষি ত্রাণ হিসেবে ৪০০ হেক্টরে আবাদের জন্য আমনের চারা বিতরণ করা হবে। ২৮ আগস্ট তাঁদের কাছে আমন ধানের চারা আসার কথা আছে। চারা এলে ২৯ আগস্ট বিতরণ করবেন। এসব চারা সদরে ও হাতীবান্ধা উপজেলায় ৩০০ হেক্টর এবং পাটগ্রামে ১০০ হেক্টরে আবাদের জন্য দেওয়া হবে।
জামালপুরে ক্ষতিগ্রস্তের তালিকা তৈরি হচ্ছে
জামালপুরের দক্ষিণ চিনাডুলী গ্রামের জিন্নাত আলী সরদার বলেন, তিনি সাত কেজি চাল ছাড়া কোনো ত্রাণ পাননি। বানে তাঁর খেতের রোপা আমন ডুবে গেছে। কোথাও চারা পাওয়া যাচ্ছে না। আর চারা কেনার মতো টাকাও তাঁর নেই।
জেলার সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলা ইসলামপুর। এখানে টানা দুই সপ্তাহ ১ লাখ ৪৬ হাজার ৭০০ জন পানিবন্দী ছিল। ফসলের মাঠ থেকে পানি কমলেও বীজতলার অভাবে কৃষকেরা চাষাবাদ শুরু করতে পারছেন না।
ইসলামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এ বি এম এহসানুল হক বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত ৫০০ কৃষকের মধ্যে আগামী ৩০ আগস্ট রোপা আমনের চারা (বীজতলা) বিতরণ করা হবে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা তৈরির কাজ শেষ হলে তাঁদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1303991