২৭ আগস্ট ২০১৭, রবিবার, ১০:৫৭

বিচারবিভাগকে নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা ও সংসদের ‘নৈতিক মান’ প্রশ্নœবিদ্ধ হওয়ায় যতো ক্ষোভ

বহুল আলোচিত ‘ষোড়শ সংশোধনী বিল’ উচ্চ আদালতে বাতিল হওয়ার রায় এবং এর পর্যবেক্ষণে প্রকাশিত বিচারপতিদের অভিমত ক্ষমতাসীনদের মনে যে ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে- তা অজ্ঞতাপ্রসূত বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। এসব যেমন বিচারবিভাগের প্রতি প্রবল অবজ্ঞা ও অবমাননাকর, তেমনই বিশ^জুড়ে আইনের অঙ্গনে তা এক বিরূপ নজির সৃষ্টি করছে।
বিশ্লেষকদের মতে, মূলত বিচারপতিদের নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা কব্জায় নিতে না পারার ব্যর্থতা এবং বিচারবিভাগীয় ক্ষেত্র থেকে বর্তমান সংসদের ‘নৈতিক মান’ প্রশ্নœবিদ্ধ হয়ে পড়ায় ক্ষমতাসীনদের ভেতরে এই ক্ষোভ দেখা দিয়েছে বলেও মনে করা হচ্ছে। অন্যদিকে প্রকাশিত রায় না পড়ে বা ভালোভাবে না পড়ে, না বুঝেই মন্ত্রী থেকে শুরু করে ছোট-বড় যে কেউ এই সমালোচনায় শরীক হচ্ছেন। যা বিচারবিভাগের মর্যাদাকে সমানে ভূলুণ্ঠিত করে চলেছে। এই সমালোচনায় যা দাবি করা হচ্ছে- সে অনুযায়ী সংবিধানে সংসদকে ‘সার্বভৌম’ বলে উল্লেখ করা হয়নি। বরং ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক ‘জনগণ’ এর পক্ষে ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর’ বলে উল্লেখ রয়েছে। আবার, ‘সংবিধানের বিধানাবলী সাপেক্ষে প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারক বিচারকার্য-পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন’- একথা জানান দিয়েছে সংবিধান। এসব নিয়ে আদালতের চৌহদ্দির বাইরে যে অনভিপ্রেত বিতর্ক- এটা সাংবিধানিক কাঠামোতে কল্পনাই করা যায় না বলে অভিমত দিয়েছেন সংবিধান প্রণেতাদের অন্যতম ড. কামাল হোসেন।

বিচারপতিদের নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা : ক্ষমতাসীন সরকার সংসদে ‘ষোড়শ সংশোধনী বিল’ পাসের মাধ্যমে কার্যত বিচারপতিদের নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা সংসদের অধীনে নিতে চেয়েছিলো। কিন্তু এই সংশোধনী হাইকোর্ট ও সুুপ্রিম কোর্ট- উভয় আদালতেই বাতিল হয়ে যায়। গত ৩ জুলাই প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের আপিল বেঞ্চ ‘বিচারপতি অপসারণ’ সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে দেয়া হাইকোর্টের রায় বহালের পক্ষে মত দেন। এরপর ১ আগস্ট ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় কয়েকটি বিষয়ে পর্যবেক্ষণসহ প্রকাশ করা হয়। যে কারণ দেখিয়ে এই বিল বাতিল করা হয় তাতে উল্লেখ করা হয়, ‘সংসদ যদি যথেষ্ট পরিণত না হয় তাহলে সংসদকে উচ্চতর বিচারিক ব্যবস্থার বিচারক অপসারণের ক্ষমতা দেয়া হবে আত্মঘাতী চেষ্টা। বিচার ব্যবস্থাকে সংসদের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য করা উচিত নয়। আরো বলা হয় যে, আমাদের সংসদীয় গণতন্ত্র অপরিণত এবং পরিণতি অর্জন করতে হলে কমপক্ষে টানা ৪/৫ মেয়াদ সংসদীয় গণতন্ত্র চর্চা করা প্রয়োজন। রাজনৈতিক দলগুলোকে জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী নির্বাচনের ক্ষেত্রে সতর্ক হওয়া উচিত। বিচার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার পরিবর্তে নির্বাহীরা এখন তা খোঁড়া করে দেয়ার চেষ্টা করছে। আর সেটা যদি হয় তাহলে পরিণতি হতে পারে ভয়াবহ। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য অধঃস্তন আদালতকেও স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ হতে হবে।’ এসব পর্যবেক্ষণে ‘সংসদীয় গণতন্ত্র অপরিণত’ এবং বিচারক অপসারণের ক্ষমতা দেয়াকে ‘আত্মঘাতী’ বলায় সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। বর্তমান সংসদে পাস হওয়া একটি বিল বিচারে গিয়ে বাতিল হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি এসব বক্তব্য-মন্তব্য বলতে গেলে সরকারের ‘ইগো’তে আঘাত করে। এর প্রতিক্রিয়ায় বিরোধীদের সরকারের পদত্যাগ চাওয়ায় তাদের আরো ক্ষুব্ধ করে তোলে। রায়ের কিছু পর্যবেক্ষণ ও অভিমতও তাদের কাছে অসহনীয় মনে হয়। ফলে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েই এর বিরুদ্ধে মাঠ গরম করতে শুরু করে।
সংসদের নৈতিক মান প্রশ্নœবিদ্ধ : আপিল বিভাগের রায় ও তার পর্যবেক্ষণে বর্তমান সংসদের নৈতিক মানও প্রবলভাবে প্রশ্নœবিদ্ধ হয়ে পড়ে। অভিমতে বিচারপতিগণ উল্লেখ করেন, ‘নিরপেক্ষ ও হস্তক্ষেপমুক্ত স্বাধীন নির্বাচন ছাড়া গণতন্ত্র বিকশিত হতে পারে না। আর বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন ছাড়া বিশ্বাসযোগ্য সংসদ প্রতিষ্ঠা হতে পারে না।’ তার মানে দাঁড়ায়, বিগত নির্বাচনটি ‘নিরপেক্ষ’ ও ‘হস্তক্ষেপমুক্ত’ হয়নি। এর ফলে বর্তমান সংসদও ‘বিশ্বাসযোগ্য’ নয়। যদিও আইনগতভাবে এই নির্বাচনকে বৈধতার সিল দেয়া হয়েছে, কিন্তু নৈতিকতার বিচারে তা গ্রহণযোগ্য হয়নি। আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ‘আদালত এমনটা ভেবেছিল যে, অবাধ ও সুষ্ঠু সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় সকল ক্ষমতা দিয়ে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করবে সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের শূন্যপদগুলো সরকারের হস্তক্ষেপ ছাড়াই স্বয়ংক্রিয়ভাবে পূরণ হবে। এক্ষেত্রে কোনো সরকারই পদক্ষেপ নেয়নি। এমনকি রাজনৈতিক বিরোধী দলগুলোও সংসদে বা অন্য কোনো ফোরামে এ ইস্যুটি উত্থাপন করেনি। এর ফলে নির্বাচন কমিশন এখনো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি।’ এই অভিমতের মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশন যে ‘সরকারের হস্তক্ষেপমুক্ত’ নয়- এই ধারণা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। রায়ের পর্যবেক্ষণে আরো বলা হয়, ‘অভিজ্ঞতা এটা দেখাচ্ছে যে, সংসদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের ফৌজদারি অপরাধের রেকর্ড রয়েছে। তারা দেওয়ানি মামলাগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত। কিন্তু ষোড়শ সংশোধনীর কারণে সংসদ সদস্যরা বিচারকদের কার্যত ‘বস’-এ (কর্তৃত্ব অর্থে) পরিণত হয়েছেন, যা উচ্চ আদালতের বিচারকদের স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনে হুমকি সৃষ্টি করেছে। সংবাদপত্রের রিপোর্ট অনুযায়ী সংসদের ৭০ শতাংশ সদস্য ব্যবসায়ী। অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত সংসদীয় বিতর্কে তারা কম আগ্রহী। এর পরিণাম হল, আজকের দিনে সংসদে পাস করা বেশিরভাগ আইন ‘ত্রুটিযুক্ত’। অসম্পূর্ণ এবং ‘নীচুমানের’ আইন প্রণয়নে তাদের দায়িত্ব উত্তমরূপে পালনের চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণের প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত হতে তারা বেশি আগ্রহী হয়ে পড়েছেন। বিচারকদের অসদাচরণ বা অসামর্থ্যের বিচার করা আইনপ্রণেতাদের কাজ নয়।’ এসব বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সংসদ সদস্যদের উল্লেখযোগ্য অংশকে নৈতিকতার কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে। যেখানে পুরো জাতিকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে জোর-জবরদস্তির মুখে সংসদ নির্বাচন করা হলো, এখন তাকে সর্বোচ্চ আদালতেও প্রশ্নের মুখে দাঁড়াতে হওয়ার বিষয়টি হজম করতে পারছেন না সরকার সমর্থকরা।

সংবিধানের সার্বভৌমত্ব : কোন কোন মহল থেকে সংসদকে ‘সার্বভৌম’ হিসেবে বর্ণনা করে সেখানকার বিল পাসসহ বিভিন্ন কার্যক্রম সম্পর্কে আপিল বিভাগের সমালোচনার বিরোধিতা করা হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চম ভাগের প্রথম পরিচ্ছেদে বর্ণিত সংসদের বিধানাবলীতে তা বলা হয়নি। পরিচ্ছেদে মোট ২৮টি অনুচ্ছেদ রয়েছে। এগুলোর কোনটিতেই সংসদকে ‘সার্বভৌম’ বলে উল্লেখ করা হয়নি। বরং বিপরীতে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭-এ উল্লেখ করা হয়েছে, ‘(১) প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে এবং (২) জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোন আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসমঞ্জস হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে।’ অর্থাৎ এখানে সংবিধানের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত রয়েছে।

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে : সরকার সমর্থক কোন কোন বুদ্ধিজীবী বলার চেষ্টা করছেন যে, বিচার বিভাগ কখনো স্বাধীন সত্ত্বা হিসেবে চলতে পারে না। যেমন, গত ২৪ আগস্ট রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের এক আলোচনা সভায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর হারুন-অর-রশিদ বলেন, ‘একটি দেশের তিনটি প্রধান অঙ্গ- আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ। এই তিনটি বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য, সমন্বয় এবং সহযোগিতা থাকা দরকার। এই তিনটি বিভাগের একটি কখনো স্বাধীন সত্ত্বা হিসেবে চলতে পারে না।’ তিনি আরো বলেন, ‘সংবিধানের ৭ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা আছে, প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ। আর জনগণের প্রতিনিধি হলো মাননীয় সংসদ সদস্য। তার শিক্ষাগত যোগ্যতা থাক বা না থাক, তিনি জনগণের প্রতিনিধি। সংসদ যদি বিচার বিভাগের জন্য অর্থ বরাদ্দ না দেয় তাহলে বিচার বিভাগ কি চলবে?’ তিনি এই ব্যাখ্যা দিয়ে বিচার বিভাগকে ‘শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকা বা না থাকা জনপ্রতিনিধি’দের অধীন করতে চেয়েছেন। অথচ সংবিধান ঘোষণা দিয়েছে যে, বিচারকগণ তাদের কাজে স্বাধীন। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৪ (৪) এ উল্লেখ করা হয়েছে, ‘এই সংবিধানের বিধানাবলী-সাপেক্ষে প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারক বিচারকার্য-পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন।’ তেমনই সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১০৫ এ বলা হয়েছে, ‘আইনের বিধানাবলী সাপেক্ষে আর আপিল বিভাগ কর্তৃক প্রণীত বিধান মানিয়া আপিল বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত যেকোনো রায় পুনর্বিবেচনা করিবার এখতিয়ার উক্ত বিভাগের থাকিবে।’
আমিত্ব প্রসঙ্গ : সরকার সমর্থকগণ প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণের ‘এক ব্যক্তির দ্বারা দেশ স্বাধীন হয়নি’ শব্দসমূহকে বঙ্গবন্ধুর প্রতি ইঙ্গিত বলে অভিযোগের শোর তুলেছেন। কিন্তু সংবিধানের শুরুতেই প্রস্তাবনায় উল্লেখ করা হয়েছে, ‘আমরা, বাংলাদেশের জনগণ, ১৯৭১ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি।’ এ প্রসঙ্গে সংবিধান প্রণেতাদের অন্যতম ও আইন বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেন একটি সংবাদপত্রকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর সই করা সংবিধান কিন্তু ‘আমরা জনগণ’ দিয়ে শুরু হয়েছিল। প্রধান বিচারপতি সেই কথাকেই বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন।’ ভাষ্যকাররা বলছেন, বাংলাদেশের বর্তমান সময়ের প্রধান সমস্যা এই ‘আমিত্ব’। দেশের সংকটসমূহের পেছনেও এই আমিত্ব ধ্বংসকারী রোগ হিসেবে কাজ করছে। একনায়কতন্ত্র-দুঃশাসন, দুর্নীতি-অরাজকতার মূলেও এই আমিত্ব ক্রিয়াশীল বলে তারা মনে করেন। উচ্চ আদালতের পর্যবেক্ষণেও বিষয়টি অবতারণা করে বলা হয়েছে, ‘ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দাম্ভিকতা দেখানোর ক্ষেত্রে বাধা দেয়ার মতো কোনো নজরদারি বা তদারককারী প্রতিষ্ঠান নেই। এমন প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষারও ব্যবস্থা নেই। নির্বাহী দাম্ভিক নিয়ন্ত্রণহীন হওয়ায় আমলাতন্ত্র কখনোই দক্ষতা অর্জনে সচেষ্ট হবে না। আমরা এমন একটি পঙ্গু সমাজে আমরা আছি, যেখানে ভালো মানুষ আর ভালো স্বপ্ন দেখে না, কিন্তু খারাপ লোকেরা আরো লুটপাটের জন্য বেপরোয়া।’
পাকিস্তানের উদাহরণ প্রসঙ্গ : প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা তার এক বক্তব্যে রায়ের সমালোচনা প্রসঙ্গে পাকিস্তানের উদাহরণ দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি যা বলতে চেয়েছিলেন তা হচ্ছে, সেখানে বিচারবিভাগ একজন প্রধানমন্ত্রীকে পর্যন্ত ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করলো। অথচ সেখানকার ক্ষমতাসীন দল বা তার নেতারা কোন প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করলো না। বিচারপতিদের বিরুদ্ধে তারা কোন আন্দোলন-কর্মসূচি দিলো না। অথচ বাংলাদেশে বিষয়গুলো না বুঝেই বাড়তি প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমাকে মিস কোট করবেন না। তাতে আমাকে নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়।’ গত ২৪ আগস্ট সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে আইনবিষয়ক একটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি সাংবাদিকদের আরো বলেন, ‘প্রেস কনফারেন্স করে কোনো কিছু বলা আমার পক্ষে সম্ভব না। বিচারক হিসেবে কোনো মামলার শুনানির সময় আইনজীবীকে একটা প্রশ্ন করতে পারি। এটি আমার স্বাধীনতা। প্রশ্নটা কী কারণে, কোন উদ্দেশ্যে, তা না বুঝে, কোট করলে অনেক সময় ভুলভ্রান্তি হতে পারে। এটা একটু খেয়াল করবেন।’

আদালতের বাইরে বিতর্ক : রায়ের পর্যবেক্ষণ নিয়ে বিরোধ সরকার সমর্থকরা আদালতের বাইরে সারা দেশে ছড়িয়ে দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে একটি সংবাদপত্রকে দেয়া সাক্ষাৎকারে আইনবিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘সর্বোচ্চ আদালতের রায় হোক কিংবা পর্যবেক্ষণ হোক, তা নিয়ে আদালতের চৌহদ্দির বাইরে অনভিপ্রেত বিতর্ক হবে, সেটা সাংবিধানিক কাঠামোতে কল্পনাই করা যায় না। কোনো ব্যাখ্যার দরকার হলে বা কোনো কারণে কেউ সংক্ষুব্ধ হলে যথাযথ ও প্রতিষ্ঠিত রীতিনীতি মেনে বিষয়টিকে সর্বোচ্চ আদালতেই নিয়ে যেতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে নির্দিষ্টভাবে সংবিধানে দুটি বিধান আছে। এই দুটি মেনে চলা সবার জন্য বাধ্যকর। আর সেটা হলো সংবিধানের ১১১ ও ১১২ অনুচ্ছেদ অনুসরণ করা। যার সারকথা হলো, সর্বোচ্চ আদালত যে রায় দিয়েছেন, তা রায় ঘোষণার দিন থেকে ‘ঘোষিত আইন’, যার প্রতি প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় সীমানার অন্তর্ভুক্ত সকল নির্বাহী ও বিচার বিভাগীয় কর্তৃপক্ষ সুপ্রিম কোর্টকে সহায়তা করবেন। এখন সাধারণ মানুষের কাছে যদি এতটকুও প্রতীয়মান হয় যে, এই সহায়তার পরিবর্তে যে অসহযোগিতা চলছে, তাহলে তা দুর্ভাগ্যজনক বলতে হবে। এই রায় প্রদানে সাতজন বিচারকই যে একমত হয়েছেন, সেটা অধিকতর তাৎপর্যপূর্ণ। সে কারণেও এই রায় একটি ঐতিহাসিক রায়। আমি বলব, আপিল বিভাগের ফুল কোর্টের একটি সর্বসম্মত রায়ের প্রতি সবার উচিত আরো বেশি শ্রদ্ধাশীল থাকা।’

http://www.dailysangram.com/post/297683