২৭ আগস্ট ২০১৭, রবিবার, ১০:৪৩

নজরুল কেন অবহেলিত?

মাসুদ আহমেদ

বাংলা ভাষার কাব্যক্ষেত্রে কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাব না হলে আমাদের জাতীয় সত্তার পরিচয় থাকত না। বাঙালির জন্ম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের অনেক আগে। ভারতে ‘বাঙালি’ বলতে এখনো প্রধানত হিন্দুদের বোঝানো হয়। ইসলাম ধর্ম ভারতের বাইরে থেকে এসেছে বলে মুসলমানদের বিদেশী বা বহিরাগত মনে করা হয়। হিন্দু লেখকদের (পশ্চিম বাংলার লেখক) সাহিত্যে দেখা যায় ‘বাঙালি’ বলতে তারা মূলত হিন্দুদেরই বুঝে থাকেন। কাজী নজরুল ইসলামকে অনেক হিন্দু কবি-সাহিত্যিক মুসলমানদের একজন কবি বলতেন। তাকে ‘বাংলাসাহিত্যের একজন শ্রেষ্ঠতম কবি’ বলতে চাইতেন না। এ প্রসেঙ্গ কমরেড মুজফফর আহমদ রচিত ‘কাজী নজরুল ইসলাম : স্মৃতিকথা’ বইটির একটি উদ্ধৃতি দিচ্ছি। অসুস্থ নজরুলের পরিবারকে সাহায্য করার জন্য যে কমিটি গঠিত হয়েছিল, তার সেক্রেটারি হয়েছিলেন ‘শনিবারের চিঠি’ খ্যাত সজনীকান্ত দাশ। মুজফফর আহমদ লিখেছেন, ‘সজনীকান্ত আমায় বললেন, প্রথম মাসের টাকা তিনি নিজেই নজরুলের বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছেন। তখনো নজরুলের কিছু কিছু জ্ঞান ছিল। সজনীকান্তকে চিনতেও পেরেছিলেন। সজনীকান্ত বললেন, নজরুল সে দিন তাকে বলেছিলেন, ‘আমার কিছু হলো না।’ উত্তরে সজনীকান্ত বলেছিলেন, ‘কেন, তুমি মুসলমানদের ভেতরে সর্বশ্রেষ্ঠ কবি।’ সজনীকান্তের এই কথাটা আমার সে দিন ভালো লাগেনি’ (বাংলাদেশে দ্বিতীয় প্রকাশ : জুলাই ১৯৭৬ পৃঃ ৩৭০)।

নজরুল আমাদের জাতীয় সত্তার প্রতিনিধি- তা অনুধাবনের জন্য প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী, ভাওয়াইয়া গানের সম্রাট আব্বাস উদ্দীন আহমদ রচিত ‘আমার শিল্পী জীবনের কথা’ আত্মজীবনী থেকে একটি ঘটনা তুলে ধরা হলো। তিনি লিখেছেন, ‘এই সঙ্গীত-জগতে বেশি দিন হয়তো আমি টিকে থাকতে পারতাম না, যদি না কাজিদার একদিনের একটি কথায় আমার চমক ভাঙত। রিহার্সেল রুমের দোতলায় বসে আমি একদিন কৃষ্ণচন্দ্র দের একখানা কীর্তন গাইছিলাম ‘ছুঁয়ো না ছুঁয়ো না বঁধূ, ওইখানে থাকো গো’। কাজিদা কতক্ষণ হল দরজার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, খেয়াল করিনি। আমি কিন্তু কেষ্টবাবুর ‘ওই মহাসিন্ধুর ওপার হতে কী সঙ্গীত ভেসে আসে’, ‘ফিরে ফিরে চল আপন ঘরে’, ‘অন্ধকারের অন্তরেতে অশ্রুবাদল ঝরে’Ñ এই গানগুলো খুব গাইতাম আর গাইতাম অবিকল কেষ্টবাবুর গলার স্বর নকল করে।

কাজিদাকে হঠাৎ দেখে গান থামিয়ে দাঁড়িয়ে উঠলাম। মৃণাল, ধীরেন দাস এরা কাজিদাকে দেখে হেসে বললেন, ‘দেখুন কাজিদা, আব্বাস কি চমৎকার কৃষ্ণবাবুর নকল করেছে।’ কাজিদারও খুব খুশি হওয়ার কথা, কিন্তু তিনি বেশ গম্ভীর হয়ে বললেন, “আব্বাস চোখ তোমার অন্ধ হয়নি, বরং চশমা পর্যন্ত এখনো নেওনি। কাজেই সে দিক দিয়ে তুমি কানাকেষ্ট নও। তারপর ওঁর গলা নকল করে গান গাইলে জীবন ভরে তোমাকে এই অপবাদের বোঝা মাথায় নিয়ে বেড়াতে হবে যে, ‘আব্বাস, ওঃ সে তো কেষ্টবাবুর নকল’। কাজেই কেষ্টবাবু কেষ্টবাবুই, ধীরেন দাস ধীরেন দাসই, মৃণাল মৃণালই আর আব্বাস আব্বাসই থাকবে। কখনো নিজের স্বাতন্ত্র্য স্বাধীনতা, যাকে বলে অরিজিন্যালিটি, নষ্ট করবে না।”
সে দিন থেকে অন্যের কণ্ঠ নকল করে গাওয়ার অভ্যাস চিরদিনের মতো ছেড়ে দিয়েছি। (তৃতীয় সংস্করণ : জানুয়ারি ১৯৯১ পৃঃ ১১৭-১১৮)
তার সন্তান, সাহিত্য-সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব মুস্তাফা জামান আব্বাসী লিখেছেন, ‘কোনো স্কুলে, কোনো কলেজে, কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে নজরুল পঠিত নয়। পর্যবেক্ষণ করুন। কারণটা কী? (নয়া দিগন্ত, জুলাই ২, ২০১৭)
নজরুল ক্ষমতাসীনদের অন্যায়, অত্যাচার, নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। তার অগ্নিঝরা লেখা বিদ্রোহ শেখায়, বিপ্লব শেখায়, প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করতে শেখায়, সংগ্রামী হতে শেখায়। তখন ক্ষমতাসীনদের মসনদ কেঁপে ওঠে। তার কাব্যগ্রন্থে বিদ্রোহী রূপ পরিস্ফুট। পৌরুষ ও শক্তির চিত্তচাঞ্চল্যে, গণচেতনা ও নির্যাতিত মানুষের আকাক্সায়, স্বাধীনতার স্পৃহায় এবং মানবতা ও সাম্যবাদের বাণী বিন্যাসে তার কবিতা সমুজ্জ্বল। তার কাব্যে জীবনের কথা আছে, চিরন্তন বাণী সেখানে রূপায়িত। রুদ্রবীণার ঝংকারময় কবিতার পাশাপাশি তিনি কোমল-মধুর মানবিক প্রেমের কবিতাও রচনা করেছেন। প্রেমকে কবিতার উপজীব্য করেছেন।
নজরুল শ্যামাসঙ্গীত লিখেছেন। হিন্দু-মুসলমানদের সম্প্রীতির কথা বলেছেন।
‘মোরা এক বৃন্তে দু’টি কুসুম হিন্দু-মুসলমান।
মুসলিম তার নয়ন মণি, হিন্দু তার প্রাণ।’
তিনি ইসলামের বিষয় অবলম্বনে কবিতা রচনা করেছেন। মুসলমানদের জাগরণের জন্য তিনি কবিতা লিখেছেন। ‘জাগে না সে জোশ লয়ে আর মুসলমান, করিল জয় যে তেজ লয়ে দুনিয়া জাহান।’
মুস্তাফা জামান আব্বাসী আরো লিখেছেন, ‘নজরুল চিনেছিলেন ইসলামকে। চিনেছিলেন নবী সা:কে। ভালোবেসেছিলেন ইসলামকে। সে কারণেই নজরুলকে পরিত্যাগ করার বিরাট একটি নকশায় এরা অংশগ্রহণ করেছেন। বলা বাহুল্য, এটি টিকবে না।’ (প্রাগুক্ত)
নজরুল হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন, একদিন তাকে পরিত্যাগ করার নকশা রচিত হবে। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি পঠিত হবেন না। এ কারণেই তিনি লিখেছেন : ‘বর্তমানের কবি আমি ভাই, ভবিষ্যতের নই নবী, কবি ও অকবি যাহা বল মোরে, মুখ বুজে তাই সই সবি।’
নজরুলকে পরিত্যাগ করলে তা হবে জাতির জন্য আত্মঘাতী। নজরুলকে পরিত্যাগ করলে আমাদের জাতীয় সত্তার স্বতন্ত্র পরিচয় থাকবে না। সব শিক্ষায়তনে নজরুলকে অবশ্যই আনতে হবে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/247320