২৭ আগস্ট ২০১৭, রবিবার, ১০:৪০

দেশে খাদ্যসঙ্কট কি আসন্ন

চলতে ফিরতে দেখা

ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী :

বাংলাদেশে এখন ভয়াবহ বন্যা চলছে। কোনো কোনো অঞ্চলে পানি নামতে শুরু করেছে। এই বন্যার শিকার হয়েছেন কমপক্ষে ৭৫ লাখ মানুষ। তলিয়ে গেছে বাংলাদেশের নি¤œাঞ্চলের এক-তৃতীয়াংশ এলাকা। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) রিপোর্টে বলা হয়েছে, মারাত্মক বন্যার পরে ভয়াবহ খাদ্যাভাবে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ। ফলে দীর্ঘ মেয়াদে বন্যার্তদের কাছে খাদ্য সরবরাহ করাটাও ঝুঁকিতে পড়েছে। রিপোর্টে বলা হয়, বন্যার ধকল কাটিয়ে ওঠা বহু মানুষ সব কিছু হারিয়েছেন। এসব মানুষের এখনই খাদ্যের প্রয়োজন। দীর্ঘ মেয়াদে তাদের জন্য পূর্ণাঙ্গ খাদ্যনিরাপত্তা ভয়াবহ সঙ্কটের মুখে। সাধারণত মওসুমি বৃষ্টিপাত কৃষকদের জীবনদায়ক হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু অনেক বছরের মধ্যে এবারের বন্যা সবচেয়ে ভয়াবহ। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, কমপক্ষে ২৪ হাজার ৭১১ একর জমির ফসল পানিতে ভেসে চলে গেছে। নষ্ট হয়ে গেছে আরো ১৪ লাখ ৮২ হাজার ৬৩২ একর জমির ফসল। এ বছর তিন দফা বন্যায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ডব্লিউএফপি বলেছে, লাখ লাখ হেক্টর জমির ফসলহানির কারণে ভয়াবহ খাদ্যসঙ্কট হতে পারে বলে বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরাও মনে করছেন। বন্যায় লাখ লাখ মানুষ বাড়িঘর, সহায়সম্পদ, ফসল সব কিছু হারিয়েছেন। এসব মানুষের এখনই খাদ্যের প্রয়োজন।
গত দশ বছরে বাংলাদেশের কৃষিবিজ্ঞানীরা দেশের খাদ্য উৎপাদন বহুগুণে বাড়িয়েছেন। ফলে স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে যে খাদ্যসঙ্কট ছিল, তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছিল; কিন্তু এ বছরের বন্যায় কৃষিজমি একেবারে ভেসে গেছে। ফলে দেশ ভয়াবহ খাদ্যসঙ্কটের মুখোমুখি। বছরের শুরুর দিকে বন্যা ও পোকার আক্রমণে বিশ লাখ টন বোরো ধানের ক্ষতি হয়েছে। তারপর এসেছে বন্যা। ফলে ফসলহানি মারাত্মক রূপ নিয়েছে। এই অবস্থা গত দশ বছরেও দেখা যায়নি। এই পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য সরকার পাঁচ লাখ টন গমসহ ২০ লাখ টন খাদ্যশস্য আমদানির সিদ্ধান্তÍ নিয়েছে। মন্ত্রিসভার ক্রয় কমিটিতে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, খাদ্য মজুদের ঘাটতির কারণে এই আমদানি করা হচ্ছে। প্রথমে সরকার ঘোষণা করেছিল, তারা ১২ লাখ টন খাদ্যশস্য আমদানি করবেন। কিন্তু ফসল বোনার এই মওসুমে আমনেরও ক্ষতি হতে পারেÑ এই আশঙ্কার কথা মনে রেখে ২০ লাখ টন খাদ্যশস্য আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
পত্রিকার রিপোর্টে বলা হয়েছে, গত মার্চে আকস্মিক বন্যায় ছয়টি হাওর এলাকায় বোরো ফসলের বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে। উপরন্তু, পোকার আক্রমণে আরো ১১৯ জেলার ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কেন সরকার হাওরের ফসল রক্ষা করতে পারল না, কিংবা পোকা বা ফাঙ্গাসের হাত থেকে বিপুল শস্য বাঁচাতে পারল না? আজকের বাংলাদেশ ’৭০-এর দশকের বাংলাদেশ নয়। সে সময় বন্যানিয়ন্ত্রণ এবং ফসলের রোগবালাই নিয়ন্ত্রণ করার যথেষ্ট ব্যবস্থা ছিল না। এখন দেশে বন্যানিয়ন্ত্রণ এবং রোগবালাই নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যথেষ্ট বাজেট বরাদ্দ রয়েছে। এখানে মূলত অদক্ষতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কাজ করেছে। সরকারের হাতে যথেষ্ট বাজেট বরাদ্দ থাকলেও তারা ফসল রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের দক্ষতার বিষয়টি নির্ভর করে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সততার ওপর। কিন্তু এ ক্ষেত্রে দুর্নীতি সীমাহীন, অর্থের অপব্যবহার যথেচ্ছ আর আমলাতন্ত্রকে রাজনীতিকীকরণ করা হয়েছে। এর ফলে পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে। মোটকথা, আমলাতন্ত্র ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব বাঁধ ও সংশ্লিষ্ট প্রকল্প নির্মাণ ও বাস্তবায়নে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।
হাওরের বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধে ভাঙনের ফলে এই প্রশ্ন উঠেছে। কোথাও কোথাও বাঁধ নির্মাণ পর্যন্ত করা হয়নি। অথচ টাকা তুলে নেয়া হয়েছে। কোথাও কোথাও যতটুকু উঁচু করে বাঁধ দেয়ার কথা, বরাদ্দ চুরি করে তা দেয়া হয়নি। এর ফলে খুব সহজেই হাওর এলাকায় প্রবল বৃষ্টির পানি প্রবেশ করেছে। ঠিকমতো বাঁধ তৈরি না করায় সহজেই ভেঙে গেছে। এটা সত্য, বন্যা একটি বহুদেশীয় ব্যাপার। বন্যার পানি উজানের দেশ থেকে ভাটির দেশে নেমে আসে; কিন্তু এ পানি নিয়ন্ত্রণ করার সামর্থ্য ও অর্থ দুটিই সরকারের হাতে থাকা সত্ত্বেও হাওরের ফসল রক্ষা করা যায়নি।
সুনামগঞ্জে হাওর নিয়ে যে ব্যাপক দুর্নীতি হলো, তার বিবরণ পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড তথা বোর্ডের কর্মকর্তা ও কন্ট্রাক্টররা মিলে ব্যাপক দুর্নীতি করেছেন। কাজ শেষ হওয়ার আগেই পানি উন্নয়ন বোর্ড কন্ট্রাক্টরদের টাকা দিয়ে দিয়েছে। বড় বড় প্রকল্পের ভুয়া বিলও তারা অনুমোদন করেছে। দুর্নীতি দমন কমিশন তাদের অর্ধশতেরও বেশি কর্মকর্তা ও কন্ট্রাক্টরের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। কন্ট্রাক্টরদের সবাই কোনো না কোনোভাবে সরকারি দলের সাথে যুক্ত। তাদের একজন সিঙ্গাপুর পালিয়ে যাওয়ার সময় বিমানবন্দর থেকে আটক হয়েছেন। তিনি সুনামগঞ্জেরই যুবলীগ কর্মকর্তা, একই সঙ্গে ওই ব্যক্তি জেলা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতিও। প্রকল্প বাস্তবায়ন না করেই তিনি প্রকল্পের সমুদয় টাকা তুলে নিয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানাও ছিল। একই ধরনের পরোয়ানা আছে পাউবোর কয়েক ডজন কর্মকর্তা ও কন্ট্রাক্টরদের বিরুদ্ধে। এ থেকে প্রমাণ হয়, কোনো রকম দায়দায়িত্ব ছাড়াই সরকারি কর্মকর্তারা বন্যা নিয়ন্ত্রণের নামে বিপুল অর্থের অপব্যবহার করছেন। সরকারি দলের লোক, নেতাকর্মীÑ তারা আবার কন্ট্রাক্টরও। এ ছাড়া দলীয়করণকৃত কর্মকর্তারাও বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের নামে বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। এ থেকেই বোঝা যায়, কিভাবে হাওর এলাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধগুলো পানিতে ভেসে গেছে। কারণ বহু ক্ষেত্রে বাঁধ নির্মিতই হয়নিÑ এ দিকে বিল তুলে নেয়া হয়েছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ঘোষণা করেছিল, উন্নতমানের চাল রফতানি করা হয়েছে। যুক্তিসঙ্গত কারণেই বলা যায় যে, এত কম সময়ের মধ্যেই দেশে খাদ্যঘাটতি হওয়া সম্ভব নয়। ওয়াকিবহাল সূত্র মনে করে, এটা এই কারণে ঘটেছে যে, সরকার আকস্মিক বন্যা ও দুর্নীতির বিষয়ে পূর্বধারণা করতে পারেনি। ফলে দ্রুতই পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এতে আরো বোঝা যায়, সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থা কৃষি সুরক্ষা এবং খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়ে সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছে।
পত্রপত্রিকাগুলো আগে থেকেই সরকারকে সতর্ক করছিল যে, জরুরি পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য সরকারের গুদামে যথেষ্ট খাদ্যশস্য নেই। কিন্তু সরকার বলেছে, তাদের ভাণ্ডারে যথেষ্ট খাদ্য মজুদ রয়েছে, এটা নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। অনেকেই আশ্চর্য হয়েছেন যে, সরকার এতটা দায়িত্বহীন আত্মতৃপ্তি কিভাবে অনুভব করল? যা হোক, এখন সরকার খুব দ্রুত তুলনামূলকভাবে উচ্চমূল্যে বিশ্ববাজার থেকে চাল কিনছে। এতে আবারো নতুন করে কিছু লোকের দ্রুত টাকা বানানোর পথ প্রশস্ত হচ্ছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয় ২০১৪ সালে ব্রাজিল ও ফ্রান্স থেকে খাওয়ার অযোগ্য নি¤œমানের গম আমদানি করে বিরাট আলোড়ন তুলেছিল। সে বিষয়ে জাতীয় সংসদেও উত্তপ্ত আলোচনা হয়েছিল। সেখানে বিষয়টি তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু এটা যেন শুধু ফাঁকা আওয়াজই ছিল। পরে আর পদক্ষেপ নেয়নি। এ দিকে সরকারের গুদামে খাদ্য না থাকা এবং খোলাবাজারে চাল বিক্রি বন্ধ করে দেয়ার সুযোগ নিয়েছে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। খাদ্যসঙ্কটের সুযোগ নিয়ে মজুদদার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা সব ধরনের চালের দাম কেজিপ্রতি ১০ টাকা বা তারও বেশি বাড়িয়ে দিয়েছে। এখন বাজারে মোটা চালের সর্বনি¤œ দাম দাঁড়িয়েছে ৫০ টাকা। আর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ চালের দাম ও খাদ্যঘাটতি থেকে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি সরানোর জন্য সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে অহেতুক তুলকালাম কাণ্ড শুরু করেছে।
এ দিকে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেছেন, বিপুল পরিমাণ খাদ্য আমদানি হচ্ছে এবং তা দেশে আসতে শুরু করেছে। তবে এতে খাদ্যের দাম না-ও কমতে পারে। তার এই বক্তব্য অযৌক্তিক। সাধারণ মানুষ সঙ্গত কারণেই আশা করছে, তারা খাদ্য আমদানির সুফল পাবে। উপরন্তু সরকার খাদ্যশস্যের সহজলভ্যতার আশায় আমদানি শুল্কও ২৮ শতাংশ থেকে মাত্র ২ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। সুতরাং মন্ত্রীর বক্তব্যে কী চতুরতা আছে, বোঝা মুশকিল। তিনি আরো বলেছেন, চালের দাম জনগণের ক্রয়ক্ষমতার ‘ভেতরেই’ রয়েছে। তার এ বক্তব্য থেকেও বোঝা যায়, জনগণের ভোগান্তি ও কষ্টের ব্যাপারে তারা কতটা উদাসীন ও অজ্ঞ। আবার খাদ্যমন্ত্রীর এ কথার সূত্র ধরে ব্যবসায়ীরা বলতে শুরু করেছেন যে, ভারতেও চালের দাম বেড়েছে। অর্থাৎ আমদানি শুল্ক হ্রাসের সুবিধা যাতে সাধারণ মানুষ না পায়, তারা এর ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করে রাখছেন। ফলে ভয় হচ্ছে, খাদ্য আমদানিকারক ও সরকারের কিছু পদস্থ ব্যক্তির যোগসাজশে চালের দাম বাড়তিই থেকে যাবে কি না।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/247322