ঈদ উপলক্ষে রাজধানীর গাবতলী পশুর হাটে আসতে শুরু করেছে বড় বড় ষাঁড়। এই ষাঁড়টির দাম হাঁকা হচ্ছে ১৫ লাখ টাকা
২৬ আগস্ট ২০১৭, শনিবার, ৯:৫৩

ভারতীয় ১০ লাখ গরু কুরবানির হাটে

ভারতীয় প্রায় ১০ লাখ গরু বাংলাদেশের কুরবানির হাটে। দুশ্চিন্তায় কপালে ভাজ দেশীয় খামারিদের। ভারত থেকে আসে গরু, যায় কাঁচা চামড়া বিনিময়ে দিতে হয় ৩০ হাজার টাকা। সিন্ডিকেট চক্রের এমন কৌশলে বিপাকে দেশীয় খামারিরা। সারা বছর পশু পালন করে দেশীয় খামারিরা কুরবানির প্রস্তুতি নিলেও ঠিক ঈদের দু’মাস আগে থেকে বৈধ-অবৈধ পথে সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে অবাধে আসে গরু। সীমান্তে কড়া নজরদারি থাকলেও চামড়ার দাম কম হওয়াতে পাচারের আশঙ্কা বাড়ছে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ জানান, গত বছর কোরবানির ঈদে ১ কোটি ৪ লাখ পশু কোরবানি করা হয়েছিল। এ বছর এখন পর্যন্ত ১ কোটি ১৫ লাখ ৫৭ হাজার পশু প্রস্তুত আছে। আইনগত বিষয় ঠিক থাকলে এবার ভারতীয় গরু আনা প্রয়োজন হবে না। ১ হাজার কেজি ওজনের বাহামা জাতের গরু উৎপাদনে খামারিদের উৎসাহিত করেন প্রতিমন্ত্রী।
এজন্য দেশের পশু খামারিরা ব্যস্ত কুরবানির পশু প্রস্তুত নিয়ে। দেশে এবার পশুর কোনো সঙ্কট নেই। কিন্তু ষড়যন্ত্রমূলকভাবে সরকারের ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা একটি মহলের সহযোগিতায় হঠাৎ করেই ভারত থেকে গরু আসা শুরু হয়েছে। এতে করে শঙ্কায় পড়েছে দেশীয় পশু ব্যবসায়ীরা। ২০১৬ সালে কুরবানির ঈদের আগে জুলাই ও আগস্ট মাসে একমাত্র চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত পথে ১২ হাজার ৭৯৮টি গরু এসেছিলো। অথচ এবছর শুধু জুলাই মাসেই গরু এসেছে ৬৮ হাজার ৫০১টি। যা গত বছরের চেয়ে ৪/৫গুণ বেশি। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চলতি ২০১৭ সালের জুলাই পর্যন্ত ৪ লাখ ১৭ হাজার গরু এসেছে। ঈদ যতই ঘনিয়ে আসছে, গরু আসার পরিমাণ ততই বাড়ছে।

সরকারি হিসাব মতে, এখন পর্যন্ত সীমান্ত দিয়ে বৈধভাবে মাসুল দিয়ে ভারত থেকে গরু এসেছে ১ লাখ ৩২ হাজার। আর অবৈধভাবে গরু এসেছে সাড়ে আট লাখের বেশি। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী হাটগুলোতে ভারতীয় গরুতে সয়লাব।
বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব রবিউল আলম দৈনিক সংগ্রামকে বলেন, বৈধভাবে ভারত থেকে গরু এসেছে প্রায় দেড় লাখ। বাকি প্রায় সাড়ে ৮ লাখ গরু এসেছে অবৈধভাবে। এতে করে আমাদের খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। টানা চার বছর ধরেই দেশীয় খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছ্ েকিন্তু সরকার ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হচ্ছে। আর এ কারনেই সীমান্ত সিন্ডিকেট কোন আইনের তোয়াক্কা না করে অবৈধভাবে গরু আনছে।

তিনি আরও বলেন, যদি চামড়ার ব্যবসায়ীরা বাকি টাকা না পায় তাহলে তারা চামড়া কিনবেন কি দিয়ে। এখনও প্রায় ৩ শ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে ট্যানারি মালিকদের কাছে। তারা উন্নয়ন কাজ করছেন। তাই এবার তারা কাচা চামড়া কিনবেন না। তাহলে এত চামড়া কিনার ক্ষমতা লোকাল চামড়া ব্যবসায়ীদের নাই। তাই চামড়া পাচারের আশঙ্কা বেশি।
উল্লেখ্য, গত ২ বছর ধরে দেশী গরুতেই স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। ভারত থেকে গরু না এলে বাংলাদেশে কুরবানি দেয়া যাবে না এমন প্রচার চালিয়ে এই সিন্ডিকেট বৈধ-অবৈধভাবে গরু ভারত থেকে আনছে। বর্তমানে দেশে ৫ লাখের মতো খামার গড়ে উঠেছে। দেশের প্রতিটি উপজেলায় গড়ে ৬০-৭০টি ছোট খামারও গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশে ২৮ লাখ পরিবার সরাসরি গবাদি পশু পালনের সঙ্গে জড়িত।

বাংলাদেশ বর্তমানে গরুতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করায় দেশবিরোধী কুচক্রী বর্তমান কুরবানির গরুর বাজারে ভারতের গরু ঢোকানোর চেষ্টা করছে। যার পরিণতি অনেক ভয়াবহ। কারণ যদি হঠাৎ করে কুরবানির মাত্র কিছুদিন আগে ভারতীয় লাখ লাখ গরু বাংলাদেশে ঢোকে, তাহলে দেশীয় গরুর বাজারে ধ্বস নামবে। আর এক্ষেত্রে তাই সরকারের উচিত হবে- অবিলম্বে সীমান্ত দিয়ে বিশেষ করে কুরবানির পশুর মওসুমে ভারতীয় গরু আসা বন্ধে শক্ত অবস্থান নেয়া। দেশে ইয়াবা ও ফেন্সিডিলের মতো ভারতীয় গরু আমদানিও নিষিদ্ধ করতে হবে। এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সীমান্তবর্তী বিভিন্ন অসৎ গরু ব্যবসায়ী কিছু দুর্নীতিবাজ বিজিবি সদস্যের সহযোগিতায় বাংলাদেশে এই ঈদের মওসুমে ভারতীয় গরু আমদানি করছে।
এদিকে কোরবানীর ঈদ যতোই ঘনিয়ে আসছে ততই ভারতীয় গরুতে সয়লাব হয়ে উঠছে সীমান্তবর্তী এলাকার হাটগুলোতে। সিলেট, গোলাপগঞ্জ, যশোর, সাতক্ষীরা, চট্টগ্রাম নোয়াখালীর হাটগুলোতে অধিকাংশ গরু ভারতীয়। এসব গরুতে গোস্ত যেমন বেশি হয় তেমনি দামও অনেক কম। এতে বাধ্য হয়ে ভারতীয় গরু কিনেন ক্রেতারা।
জানা গেছে এসব গরু দিয়ে হাল চাষ করার পরে নাম মাত্র মূল্যে বিক্রি করেন তারা। তা না হলে এসব গরু তাদের গোসালায় দিয়ে দিতে হয়। গোসালায় গরু দিয়ে রাজ্যের পক্ষে চাপ থাকলেও গরীব চাষীরা জীবনের জূকি নিয়ে হলেও তা চোরাই পথে বিক্রি করতে বাধ্য হন। তবে তারা কম দামে বিক্রি করলেও সিন্ডিকেট চক্র প্রতিটি গরুর মূল্য হিসেবে নিয়ে থাকেন ৩০ হাজার টাকা।

তাদের সাতে পাচারকারিদের যুক্ত হলো গরু দেয়া হবে বিনিময়ে চামড়া দিতে হবে বিনিময়ে ৩০ হাজার টাকা দিতে হবে। যে পথে গরু আসে সে পথেই চামড়া পাচার হয়ে থাকে। এই সিন্ডিকেট চক্র চামড়া কিনতে মোটা অংকের টাকার ভারতীয় ট্যানারি মালিকদের থেকে এনে থাকেন। সমিান্তবর্তী এলাকার চামড়ার ব্যবসায়ীরা এ কাজে বেশি জড়িত। তাদের মতে দেশে চামড়া বিক্রি করলে টাকা পাওয়া যায় না। টাকা এক বছর বাকি থাকে। আর পাচারকারিরা নিলে নগদ টাকা পাওয়া যায়।
সাতক্ষীরার পশু ক্রেতা আব্দুল আজিজ বলেন, ভারতীয় গরুর দাম কম গোস্তও অনেক বেশি তাই বিদেশী গরু কিনেছি। তিনি বলেন, ৫০ হাজার টাকা দিয়ে একটি ভারতীয় গরু কিনেছি। এতে গোস্ত হবে প্রায় তিন মন। এ গরু দেশী হলে তার দাম হতো প্রায় ৮০ হাজার টাকা।
তিনি আরও বলেন, বাজারে দেশী গরুর পরিমান খুবই কম। সবই ভারতীয় গরু। সীমান্বর্তী হাটগুলোতে দেশীয় গরু নেই বললেই চলে। অনেকে বাধ্য হয়েও ভারতীয় গরু কিনে থাকেন।
গোলাপগঞ্জের বিভিন্ন বাজার ও ভাম্যমান বাজার ঢাকা দক্ষিণ, পুরকায়স্থ বাজার, গোলাপগঞ্জ বাজার, ডেপুটি (রাওকার) বাজারসহ উপজেলার বড় বড় বাজারগুলো ভারতীয় গরুতে সয়লাব দেখা গেছে। তবে ভারতীয় গরুর প্রতি সাধারণ ক্রেতাদের আকর্ষণ কম বলে অনেকে জানান। তারা দেশী গরুর দাম বেশি বা কম হোক সেদিকেই ঝুঁকে পড়ছেন। তবে স্বাদ আর সাধ্যের মধ্যে মিলাতে গিয়ে শেষে ভারতীয় গরু কিনতে হচ্ছে।
এদিকে সাভারের ট্যানারি পল্লীর কাজ এখনও শেষ না হওয়াতে চিন্তিত সারা দেশের চামড়ার ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন আমরা চামড়া কিনবো কি দিয়ে। ট্যানারি মালিকরা আমাদের আগের বকেয়া টাকাই পরিশোধ করেননি।
বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, ট্যানারির বর্তমান যে অবস্থা সেটি শতভাগ চামড়া প্রক্রিয়াকরণের জন্য পর্যাপ্ত নয়। এখনও অনেক কিছু ঘাটতি আছে। সেগুলো সম্পন্ন হওয়ার পর বলা যাবে শতভাগ চামড়া প্রক্রিয়াকরণে কতটা সময় লাগবে। এছাড়া এ বছরই প্রথম চামড়া প্রক্রিয়াকরণের জন্য সাভারের ট্যানারি পল্লী ব্যবহার করা হবে।
শিল্পনগরীতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পরামর্শ বাস্তবায়নে দায়িত্বপ্রাপ্ত তদারক কর্মকর্তা আবদুল কাইয়্যুম বলেন, সাভারে ট্যানারি পল্লীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজ যত দ্রুত সম্ভব সম্পন্ন করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এ জন্য একটি কমিটি গঠন করা হচ্ছে। বিসিক, পরিবেশ অধিদফতর, ট্যানারি মালিক, বুয়েট প্রকৌশলীসহ বিদেশী বিশেষজ্ঞরা এর সদস্য হিসেবে থাকবেন।
উল্লেখ্য, ২০০৩ সালে কাজ শুরু হয়ে ২০০৬ সালে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও গত ১৪ বছরের কাজ শেষ হয়নি। পুরো কাজ শেষ হতো আরও সময় লাগবে কয়েক বছর। অথচ মিথ্যা রিপোর্টের ওপর আদালতের রায়ে গ্যাস, বিদ্যুৎ পানির লাইন বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হলো। এর আগে রায় না মানার কারনে আদালন জরিমানাও করে ট্যানারি মালিকদের। এখন দেখা যাচ্ছে কাজ শেষ হয়নি এক তৃতীয়াংশও। এতে করে কোটি কোটি টাকার রফতানি অর্ডার হারালো ট্যানারি মালিকরা। বেকার হলো কয়েক লাখ শ্রমিক। কিন্তু কার স্বার্থে এ শিল্প ধ্বংস করা হলো তা এখনও অজানা।
সিইটিপি আর ডাম্পিং স্টেশনের কাজও বাকি অনেক। তাই উৎপাদন বন্ধ, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে রপ্তানী। এখন ঈদকে সামনে রেখে শ্রমিক অসন্তোষের আশংকা করছেন ট্যানারি মালিকরা। এক সময় দিন রাত কাজ চলতো এসব ট্যানারিতে। এখন নিস্তব্ধ আর পরিত্যাক্ত হয়ে পরে আছে সব কিছু।
সাভারে স্তানান্তরের জন্য গেলো মে মাসের ৮ তারিখ হাজারিবাগে গ্যাস, বিদ্যুৎ আর পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার পর এখন চরম বিপাকে এই শিল্প। হাজারিবাগে সব কাজ বন্ধ, আবার সাভারের আধুনিক চামড়া শিল্প নগরী পুরোপুরি প্রস্তুত না হওয়ায় সেখানে শুরু করা যাচ্ছেনা কাজ।
ইউসুফ ট্যানারির মালিক ইউসুফ আলী বলেন, সবাই এখন স্বাভাবিক পরিমাণের কাজ তুলতেই চাপের মধ্যে পড়ছে। তখন তো অনেক বেশি চামড়া আসবে। এ অল্পসংখ্যক রেডি ট্যানারিতে এতো চামড়া কীভাবে প্রক্রিয়াকরণ হবে? এ কারণে এবার ব্যবসায়ীরা কোরবানির চামড়ার প্রতি আগ্রহ হারাবে। এতে চামড়ার দাম এবারও কম যাবে।
সীমান্ত পথে চামড়া ভারতে পাচারের কোনো শঙ্কা আছে কিনা- জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ আশঙ্কা এ বছর আরও বেড়েছে। এবার বড় সঙ্কট হলো অর্থ। চামড়ার প্রকৃত মূল্য না পেলে তা পাচার হবেই। কোনভাবেই তা ঠেকানো যাবে না। অর্থ সংকটের কারনে ভারতীয় টাকা এবার চামড়া কিনতে হবে। এবং তা পাচার হবে বাধ্য। জানিনা এ বছর কি হবে। আজ দাম নির্ধারনী বৈঠক।

http://www.dailysangram.com/post/297498