২৬ আগস্ট ২০১৭, শনিবার, ৯:৫২

হজ্বযাত্রীদের কান্না শুনছে না কেউ ॥ ৬৪ এজেন্সির বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ

# এখনো ১ হাজার যাত্রীর ফ্লাইট নিশ্চিত করতে পারেনি বিমান
মিয়া হোসেন : পবিত্র হজ্ব পালনের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হয়ে রাজধানীর হজ্ব ক্যাম্পে এসে হাজির হয়েছে হজ্বযাত্রীরা। কেউ ফ্লাইটে করে উড়ে যাচ্ছে মদিনার উদ্দেশে আর কেউ ফেলছে চোখের পানি। প্রতারণার শিকার হয়ে কয়েকশ’ হজ্বযাত্রী কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছে। কিন্তু তাদের এ কান্না কেউ শুনছে না। রাজধানীর আশকোনার হজ্ব ক্যাম্পে প্রতারণার শিকার হজ্বযাত্রীদের অভিযোগ আর অভিযোগ। অভিযোগের যেন কোন শেষ নেই। কোন কোন এজেন্সির মালিক ও মধ্যস্বত্বভোগী দালালরা তাদের টাকা নিয়ে পালিয়েছে। কারো ভিসা হয়েছে, টিকিট হয়নি, আবার কারো ভিসা টিকিট কোনোটিই হয়নি। এ পর্যন্ত হজ্ব ক্যাম্পে ৬৪টি এজেন্সীর বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দায়ের হয়েছে। আর মৌখিক অভিযোগের তো কোন অন্ত নেই। এসব অভিযোগের কোনই সুরাহা করছে না কেউ। এদিকে এখনো (এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত) প্রায় এক হাজার হজ্বযাত্রীর ফ্লাইট নিশ্চিত করতে পারেনি বাংলাদেশ বিমান।

সরেজমিনে দেখা গেছে, এবছর ভিসা হওয়ার পরও বিমানের টিকিট না পাওয়া হজ্বযাত্রীদের সংখ্যা বেশি। অনেকেই ভিসা নিয়ে গত ১০-১৫ দিন ধরে হজ্ব ক্যাম্পে সকলের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। আজ না, কাল। কাল না, পরশু। এভাবে অপেক্ষার প্রহর গুণে চরম ভোগান্তি ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন তারা। এখন শেষ দিকে অনেক এজেন্সির মালিক যাত্রীদের সাথে যোগাযোগ তো দূরে থাক অফিসে তালা দিয়ে পালিয়েছে। আবার অনেক এজেন্সির মালিক মাঝে মাঝে মোবাইল করে এসব হজ্বযাত্রীদের কাছে অতিরিক্ত টাকা দাবি করছে।

এদিকে, এসব ভুক্তভোগী হজ্বযাত্রীদের কোন মৌখিক অভিযোগ নিচ্ছে না হজ্ব অফিস। লিখিত অভিযোগ জমা নিলেও, অভিযোগের প্রেক্ষিতে এখন পর্যন্ত সমস্য সমাধানে কোন ধরনের ব্যবস্থা নেয়নি তারা।
গতকাল শুক্রবার রাজধানীর আশকোনার হজ্ব¡ ক্যাম্পে সরেজমিনে হজ্ব¡যাত্রীদের আহাজারি আর কান্নার চিত্র দেখা গেছে। এখন পর্যন্ত ৬৪টি হজ্ব এজেন্সির বিরুদ্ধে গাফিলতি ও প্রতারণার অভিযোগ পাওয়া গেছে বলে হজ্ব অফিস থেকে জানানো হয়েছে। এদের মধ্যে অন্যতম হলো- আল বালাদ ওভারসীজ, সাইদ এয়ার ইন্টারন্যাশনাল, সাদমান এয়ার ইন্টারন্যাশনাল, আবকর হজ্ব গ্রুপ, সাউথ এশিয়া ওভারসীজ, এম. এম. ট্রাভেলস, গুলশান এ মুহাম্মদিয়া ইন্টারন্যাশনাল, সানজিদ ট্রাভেলস ইন্টারন্যাশনাল, হাসান ওভারসীজ, নিবিড় হজ্ব ওমরাহ এন্ড টুরিজম, এম সিও ট্রাভেলস এন্ড টুরিজম।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আল বালাদ ওভারসীজ, সাইদ এয়ার ইন্টারন্যাশনাল, সাদমান এয়ার ইন্টারন্যাশনাল এই তিনটি এজেন্সির মালিক হলো মো. সালাম, আবু সাইদ, মো. সায়েম ও মাহবুবুর রহমান টিটু। এরা চার জনই আপন ভাই। এরা বিভিন্ন এজেন্সির নামে যাত্রী সংগ্রহ করে। প্রতিবছরই যাত্রীদের সাথে এমন প্রতারণা করে। এবারও কয়েকশ যাত্রী ক্যাম্পে রেখে সবাই পলাতক। মোবাইল ফোনে একাধিক বার যোগাযোগ করেও তাদের কাউকে পাওয়া যায়নি। ভুক্তভোগী হজ্বযাত্রীদের অনেকেই তাদের অফিসে গিয়ে তালাবন্ধ অবস্থায় পেয়েছে।

ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে মো. আবু মালেক মৃধা তার স্ত্রীকে নিয়ে গত ৬ দিন ধরে হজ্ব ক্যাম্পে সকলের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। লিখিত অভিযোগও জমা দিয়েছেন গত বৃহস্পতিবার। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাদের কোন সমস্যারই সমাধান হয়েনি। তাদের ভিসা করিয়েছে সাইদ এয়ার ইন্টারন্যাশনাল নামের হজ্ব এজেন্সি। এই এজেন্সির আরো ২০ জন হজ্বযাত্রী ভিসা পেয়েও বিমানের টিকিট না পেয়ে হজ্ব অফিসের কর্মকর্তাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন।
মো. আবু মালেক মৃধা বলেন, এজেন্সি থেকে আমাদের ফোন করে হজ্ব ক্যাম্পে আসতে বলেছে। হজ্ব ক্যাম্পে আসার পর তারা আর যোগাযোগ করছে না। বলছে আপনাদের টাকা আমরা পাইনি। আপনারা যেভাবে পারেন চলে যান। আমরা কিছু জানি না। আমরা এখন কি করবো। আমরা তো এখন হজে যেতে না পারলে মানুষের কাছে মুখ দেখাতে পারবো না।
বগুড়া থেকে গত ৭ দিন আগে হজ্ব ক্যাম্পে এসেছে আব্দুল আজিজ, মোশারফ হোসেন, আব্দুল কাইয়ুমসহ মোট ৮২ জন। এরা সবাই আকবর হজ্ব গ্রুপের যাত্রী। এদের সবারই ভিসা হয়েছে কিন্তু বিমানের টিকিট হয়নি। কয়েকদিন ধরে এজেন্সির মালিক আর তাদের সাথে যোগাযোগ করছে না।
আব্দুল আজিজ বলেন, ‘আমরা বগুড়া থেকে ৮২ জন একসাথে এখানে এসেছি। এখন আমাদেরকে রেখে এজেন্সির মালিক পালিয়েছে। আমরা এখন কী করবো। বাবা যে ভাবেই হোক আমাদের হজে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। না হলে মরা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না।
শুধু এরাই নয়, এদের মত অসংখ্য ভুক্তভোগী হজ্বযাত্রীদের কান্না আর আহাজারিত অনেকটা ভারি হয়ে উঠেছে হজ্ব ক্যাম্প।
এদিকে আগামী ২৭ ও ২৮ আগস্ট হজ্ব ফ্লাইট পরিচালনার জন্য এখনো অনুমতি পায়নি বিমান। এ দু‘দিন ফ্লাইট পরিচালনার জন্য যাত্রী প্রতি ১ হাজার রিয়াল দিতে হবে। অতিরিক্ত এ অর্থ মওকূফ করার চেষ্টায় রয়েছে বিমান। এতে করে প্রায় ১ হাজার হজ্বযাত্রীর ফ্লাইট এখনো অনিশ্চিত রয়েছে। তবে শীঘ্রই তার সমাধান হবে বলে আশা প্রকাশ করছে হাব মহাসচিব এম শাহাদাত হোসাইন তছলিম।
তিনি বলেন, আশা করছি অতিরিক্ত চার্জ ছাড়াই ফ্লাইটের অনুমতি পাওয়া যাবে। আর অভিযুক্ত এজেন্সীদের সাথে সালিশ করে সমস্যার সমাধান করা হচ্ছে। তবে যে সকল এজেন্সী প্রতারণা করেছে তাদের বিষয়ে সরকার ব্যবস্থা গ্রহন করবে। এক্ষেত্রে হাবের আইনগতভাবে করনীয় নেই।
হজ্বযাত্রীদের এতো অভিযোগ, তেমন কোন সমাধানের উদ্যোগ নেই কেন এ বিষয়ে জানতে চাইলে ধর্ম মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি বজলুল হক হারুন বলেন, আমরা অভিযোগ জমা নিচ্ছি। আজও অনেক অভিযোগ জমা পড়েছে। আমরা অভিযোগকারীদের বিষয়ে বৈঠকে বসবো। তাদের সকলের সমস্যা সমাধান করা হবে।
তিনি আরো বলেন, এখন ৬৪ এজেন্সির বিরুদ্ধে আমরা প্রতারণার অভিযোগ পেয়েছি। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ও কঠিন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে। কাউকে ছাড় দেয়া হবে। আমরা কি শাস্তির ব্যবস্থা করি তা আপনারাই দেখতে পারবেন। তবে দেশে ১৪’শ হজ্ব এজেন্সির কোন প্রয়োজন আছে কি না তা ভেবে দেখার সময় এসেছে।

http://www.dailysangram.com/post/297505