২৬ আগস্ট ২০১৭, শনিবার, ৯:৫১

সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় চলছে শিল্প আগ্রাসন

খুলনা অফিস : উপকূলীয় এলাকার ভূমি ও পরিবেশ রক্ষায় ইকোলজিক্যাল ক্রিটিক্যাল জোন (ইসিএ) ঘোষণা করেছে সরকার। এসব এলাকায় মাটি, পানি, বায়ু ও শব্দ দূষণকারী শিল্প স্থাপনে রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু আইন থাকলেও তার প্রয়োগ নেই। গত কয়েক বছরে কেবল খুলনা ও বাগেরহাট এলাকায় ১০ হাজার হেক্টর কৃষি জমি কিনে নিয়েছে তিনশ’ শিল্প প্রতিষ্ঠান। সে সব স্থানে শোভা পাচ্ছে প্রস্তাবিত শিল্প প্রতিষ্ঠানের নাম। ইতিমধ্যেই অনেক কৃষি জমি ভরাট করে গঠে উঠেছে অবকাঠামো। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন আর অর্থনৈতিক সম্ভাবনা সৃষ্টি হওয়ার পর থেকেই বদলে যেতে শুরু করেছে দক্ষিণাঞ্চলের কৃষি জমির ব্যবহার। আগে যেখোনে কৃষি কাজ ও মৎস্য চাষ হতো এখন তা হাত বদল হয়ে চলে যাচ্ছে শিল্প উদ্যেক্তাদের দখলে। রয়েছে কৃষি ভূমি রক্ষা আইন, আছে শিল্প স্থাপন নীতিমালা।

কিন্তু শিল্পের জন্য কৃষি জমি ক্রয় ও শিল্প স্থাপনে কোন আইনই মানা হচ্ছে না। ফলে আইন ও নীতিমালা উপেক্ষা করে দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় জেলাগুলোতে গড়ে উঠছে একের পর এক শিল্প প্রতিষ্ঠান। কৃষি জমি হস্তান্তর বেড়েছে শিল্প উদ্যোক্তাদের অনুকূলে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক, ড. আতিকুল ইসলাম বলেন, এ বছর ৬ জুন মন্ত্রণালয় সুন্দরবনকে ঘিরে থাকা জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরগুনার ২৯৭টি মৌজাকে পরিবেশ সঙ্কটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করেছে। সেই অনুযায়ী সাতক্ষীরার ৫৫টি, খুলনার ১১৪টি, বাগেরহাটের ৭৪টি, পিরোজপুরের ১৯টি ও বরগুনার ৩৫টি মৌজায় এমন কোন শিল্প স্থাপন করা যাবে না যা পরিবেশ বিনষ্ট করে। কিন্তু শিল্প উদ্যোক্তরা এ আইন মানছে না। ফলে শিল্প বর্জ প্রতিনিয়ত পরিবেশ অর্থাৎ মাটি, পানি, বায়ু ও শব্দ দূষণ করেছে। যা খাদ্য কৃঙ্খলা দ্বংস করছে এবং নানাভাবে মানুষের দেহে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। কেবল মাত্র সুন্দরবন বেষ্টিত উপকূলের মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না, এর ফলে সারা দেশের মানুষই ক্ষতির মুখে পড়ছে। একবার পরিবেশের ক্ষতি হয়ে গেলে তা ফিরিয়ে আনা আর সম্ভব নয়। তিনি বলেন, আইনের সঠিক ব্যবহার করে এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থায় যোগ্য লোকের পদায়ন করে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। আর তা না হলে প্রকৃতিগতভাবে জটিল এই অঞ্চলে দূষণের মাত্রা আরও বেড়ে গেলে তা ভয়াবহ বিপর্যয়ে পরিণত হবে।
অপরদিকে অর্থীনীতিবিদরা বলছেন, দক্ষিণাঞ্চলে আগ্রাসী শিল্পায়নের পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। যা দক্ষিণ অঞ্চলের কৃষি নির্ভর অথনীতি ও বিশ্ব ঐহিত্য সুন্দরবনের জন্য দীর্ঘমেয়াদী বিরূপ প্রভাব ফেলবে। তাদের উদ্বেগ, চলতি বছর ৬ আগস্ট জাতীয় পরিবেশ কমিটি সুন্দরবন সংলগ্ন ৩২০টি শিল্পকারখানাকে নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে। যে গুলোর মধ্যে রয়েছে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) বোতলজাতকরণ কারখানা, সিমেন্ট, তামাক, তেল পরিশোধন, ইটভাটার মতো লাল তালিকাভূক্ত শিল্প।

সুন্দরবন একাডেমির পরিচারক ও অর্থনীতিবিদ আনোয়ারুল কাদির বলেন, অর্থনীতি কখনই অপরিকল্পিত উন্নয়নকে সমর্থন করে না। অপরিকল্পিত উন্নয়ন সাময়িক দৃষ্টিতে উন্নয়ন মনে হলেও তা দীর্ঘ মেয়াদে দেশ ও জাতির জন্য বোঝা হয়ে দাড়ায়। অর্থনৈতিতে কেবল মাত্র দৃশ্যমান আয়কে বিবেচনায় নেওয়া হয়না পরিবেশগত ক্ষতিকে বিবেচনায় নিতে হয়। ইতিমধ্যেই সুন্দরবন সংলগ্ন জেলাগুলোর ইকোলজিক্যাল ক্রিটিক্যাল জোন-ইসিএতে পরিবেশের জন্য মারতœক ক্ষতিকারক ১৮৬টি বড় ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। পরিবেশ অধিদপ্তর সম্প্রতি এই সব এলাকায় আরও ১১৮টি শিল্প প্রতিষ্ঠানের প্রাথমিক ছাড়পত্র দিয়েছে ও ১৬টি শিল্পকারখানার অনুমোদন দিয়েছে। এসব শিল্প স্থাপন হলে সুন্দরবন ও তৎসংলগ্ন মাটি, পানি, বায়ু ও শব্দ দূষণ হয়ে এ অঞ্চল তথা সুন্দরবনের জন্য সৃষ্টি হবে নতুন এক আপদ।

বাংলাদেশে নাগরিক অধিকার আন্দোলনের সমন্বয়কারী এডভোটেক কুদরত-ই খুদা বলেন, বাংলাদেশে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫ এর ৫ ধারার উপধারা -১ এর প্রদত্ত ক্ষমতা বলে ১৯৯৯ সালে সুন্দরবনের রিজার্ভ ফরেস্টের চারদিকের ১০ কিলোমিটার বিস্তত এলাকায় আইন অনুযায়ী পরিবেশ সঙ্কটাপন্ন এলাকা বা ইকোলজিক্যাল ক্রিটিক্যাল জোন -ইসিএ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে ২০১৫ সালের ১৩ জানুয়ারি সুন্দরবনের পরিবেশ সংকটাপন্ন এলাকার মৌজা নামে সন্নিবেশ করে প্রজ্ঞাপন জারী করা হয়। এই আইন অনুযায়ী এইসব এলাকায় ভারী কোন শিল্প স্থাপন করা নিষেধ। কিন্তু আইন প্রনয়ন পূর্ব ও পরবর্তীতে আইন অমান্য করে এই সব এলাকায় ভারী ও পরিবেশের জন্য মারতœক ক্ষতিকর শিল্প স্থাপন অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এখনো হচ্ছে। যে কান শিল্প স্থাপন করতে গেলে পরিবেশের ছাড়পত্র অত্যন্ত জরুরী। আইন দ্বারা পরিবেশ সঙ্কটাপন্ন এলাকায় শিল্প স্থাপন না করার কথা থাকলেও পরিবেশ অধিদপ্ত সম্প্রতি এই সব এলাকায় শিল্প স্থাপনের ছাড়পত্র দিয়েছে যা আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, পরিবেশ সরক্ষণে সরকার আইন প্রনয়ন করছে আবার সরকারেই তা লঙ্ঘন করছে, যা সংবিধান পরিপন্থি।

http://www.dailysangram.com/post/297600