২৬ আগস্ট ২০১৭, শনিবার, ৯:৪৭

মেমোরি কার্ডের বাজার নিয়ন্ত্রণহীন

নিয়ন্ত্রণহীনভাবে চলছে মেমোরিকার্ডের শত কোটি টাকার বাজার। নীতিমালা নেই, মনিটরিং নেই, নেই মান যাচাইয়ের ব্যবস্থাও। সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে বছরের পর বছর চলছে এর জমজমাট ব্যবসা। দেশে বছরে প্রায় ২০ কোটি পিস
মেমোরিকার্ডের চাহিদা রয়েছে। এর বেশিরভাগই আনা হয় চীন ও ভারত থেকে। ইউরোপের কয়েকটি দেশ থেকেও বর্তমানে এর আমদানি শুরু হয়েছে। ঢাকা ও চট্টগ্রামের দুটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হচ্ছে মেমোরিকার্ডের প্রবেশ চ্যানেল। মূলত লাগেজ পার্টি হিসেবে পরিচিতরাই এটা আমদানি করেন। কোনো নীতিমালা না থাকায় বিমানবন্দরের কর্মকর্তারা অনায়াসে এটা ছেড়ে দেন। এ সুযোগটি কাজে লাগাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। আর এতে প্রতারিত হচ্ছেন গ্রাহকরা। নিম্নমানের মেমোরিকার্ড ব্যবহার করে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তারা। তবে বিষয়টি নিয়ে কারও কোনো ধরনের জবাবদিহি নেই। ৫ থেকে ৬শ টাকা দাম হওয়ায় এ নিয়ে উচ্চবাচ্যও হয় কম। সব মিলিয়ে নীরবে-নিভৃতে চলছে মানহীন এ মেমোরিকার্ডের ব্যবসা। প্রতিটি ডিভাইসেই স্থায়ী ধারণক্ষমতা থাকে। অনেক ডিভাইসে আবার বাড়তি তথ্য রাখার সুবিধা দিতে ব্যবহার হয় মেমোরিকার্ড। এই মেমোরিকার্ড হচ্ছে এক ধরনের সেমিকন্ডাক্টরভিত্তিক প্রযুক্তিপণ্য। সেকেন্ডারি মেমোরি। মোবাইল ফোন, ট্যাবলেট কম্পিউটার, ক্যামেরা, টেলিভিশন, মিডিয়া প্লেয়ার ইত্যাদিতে মেমোরিকার্ড ব্যবহার করা যায়। সংশ্লিষ্টরা জানান, সম্প্রতি আন্তর্জাতিক বাজারে মেমোরিকার্ডের দাম বেড়েছে। আমাদের দেশে উল্টো এ কার্ডের দাম দিন দিন কমছে। হচ্ছে জনপ্রিয়। এর পেছনে রয়েছে বড় ধরণের প্রতারণা। বাজার থেকে কেউ ৩২ জিবির মেমোরিকার্ড কিনে আনছেন। পরে নিজের মোবাইলে তা পাচ্ছেন মাত্র ২ জিবি। ছোট-বড় মার্কেটের পাশাপাশি এখন সবচেয়ে বেশি মেমোরিকার্ড বিক্রি হচ্ছে ফুটপাতে। লাভজনক হওয়ায় ভ্র্যাম্যমাণ হকারদের কাছেও ব্যবসাটি এখন জনপ্রিয়। অনুসন্ধানে জানা যায়, বাংলাদেশে প্রায় ৯ কোটি গ্রাহকের হাতে রয়েছে মোবাইল হ্যান্ডসেট। প্রায় প্রতিটি হ্যান্ডসেটে রয়েছে একটি করে মেমোরিকার্ড। নিম্নমানের হওয়ায় এসব মেমোরিকার্ড ছয় মাসের বেশি টেকসই হয় না। ওই হিসাবে প্রতি বছর গ্রাহকদের ব্যবহার করতে হয় দুটি করে মেমোরিকার্ড। এছাড়া ল্যাপটপ, বিভিন্ন ধরনের ক্যামেরা, স্মার্ট টেলিভিশন, ট্যাবসহ আরও বেশ কিছু যন্ত্রাংশে এখন ব্যবহার হচ্ছে মেমোরিকার্ড। প্রতিটি মেমোরিকার্ডের গড়মূল্য ৫শ টাকা ধরলে এর বাজার হয় শত-কোটি টাকার। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দীন আহমেদ মানবজমিনকে বলেন, এ ব্যবসার আসলে কোনো মা-বাপ নেই। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি অনেক আগে থেকে বলে আসছে বিষয়টি নিয়ে নীতিমালা তৈরি করবে। আজ পর্যন্ত সেটা হয়নি। মনিটরিংও নেই। বর্তমানে বিপুল পরিমাণে মেমোরিকার্ড অবৈধভাবে দেশে ঢুকছে। এসবের বেশিরভাগই ভাইরাসযুক্ত মানহীন। তিনি বলেন, আমাদের গ্রাহকরা যেন এ নিয়ে প্রতারণার শিকার না হন সেটাই আমাদের চাওয়া। এসবের জন্য প্রথমেই প্রয়োজন নীতিমালা ও যথাযথ মনিটরিং। প্রয়োজনে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমেও পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। তিনি বলেন, সরকার এই শত-কোটি টাকার বাজার থেকে বছরে অন্তত ৩৪ কোটি টাকা রাজস্ব আয় করতে পারতো। কিন্তু নিয়ন্ত্রণ না থাকায় সেটা সম্ভব হচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশে বৈধভাবে যে পরিমাণ এক্সেসরিজ আমদানি হয়, অবৈধভাবে হয় তার তিন গুণেরও বেশি। বর্তমানে এক্সেসরিজ বাজার প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার। কিন্তু এক্সেসরিজ আমদানি বা বাজারজাত করার জন্য আজ পর্যন্ত কোন নীতিমালা তৈরি হয়নি। ফলে রাষ্ট্র এ খাত থেকে যেমন বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে তেমনি এ খাতের গ্রাহকগণ নিম্নমানের এক্সেসরিজ কিনে হচ্ছেন প্রতারিত। রাজধানীর গুলিস্তান, পল্টন, বাড্ডা, ফার্মগেট, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, কাওরান বাজার এলাকায় প্রতি ৫ গজ অন্তর অন্তর টেবিল বসিয়ে সাউন্ড বক্স লাগিয়ে চটকদার কথা বলে যাচ্ছে হকাররা। ৩২ জিবি মেমোরিকার্ড ৩০০ টাকা, ১৬ জিবি মেমোরিকার্ড ২০০ টাকা ডাকে সগরম থাকে এসব এলাকা। এ রকম সারা ঢাকায় প্রায় ১ হাজার হকার মুড়িমুড়কির মতো বিক্রি করে যাচ্ছে। আসল মেমোরিকার্ড মার্কেটে ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা। সেখানে কম দামে পাওয়ায় গ্রাহক লুফে নিচ্ছে এসব মেমোরিকার্ড। বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, এধরনের ৩২ জিবি বা ১৬ জিবি মেমোরিকার্ড আসলে ২ জিবি বা ৪ জিবির। আবার ভাইরাস থাকার সম্ভাবনা ৯০ ভাগ। নিম্নমানের এসব মেমোরিকার্ড দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। হকাররা গুলিস্তানের সুন্দরবন মার্কেট বা পাতাল মার্কেট থেকে ৭০-৮০ টাকায় এসব কার্ড কিনে বিক্রি করছে। কেনার পর প্রতারিত হয়ে ক্রেতারা এ মেমোরিকার্ড ফেরত দিতে গেলে হকাররা তো ফেরত নেয় না উল্টো সংঘবদ্ধ হকার চক্রের দ্বারা গ্রাহকদের লাঞ্ছিত হতে হয়। প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা ও গ্রাহকদের অসচেতনতার ফলে দিনের পর দিন চলছে এই প্রতারণা। সম্প্রতি কম্পিউটার সোর্সের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ঈদ সামনে রেখে দেশের প্রযুক্তি বাজারে নকল মেমোরিকার্ড বিক্রি হচ্ছে। এসব মেমোরিকার্ড কিনে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন ক্রেতারা। কার্ডের গায়ে ১৬ জিবি লেখা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে এর তথ্য ধারণক্ষমতা কম দেখাচ্ছে। মেমোরিকার্ডে কোনো ওয়ারেন্টিও থাকছে না। স্যামসাং বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বাংলাদেশে স্যামসাং পরিবেশিত কোনো মেমোরিকার্ড নেই। বাংলাদেশের বাজারে শুধু স্যামসাং-এর মেমোরিকার্ডই নকল বাজারজাত হচ্ছে তা নয়, বিগত কয়েক বছর ধরে স্যানডিস্ক কিংবা টুইনমোসের মতো কোম্পানির নকল মেমোরিকার্ডে সয়লাব হয়ে গিয়েছে প্রযুক্তি পণ্য বাজার। সংশ্লিষ্টরা জানান, মেমোরিকার্ডের মান সাধারণত নির্ভর করে এর গতির ওপর। গতির দিক থেকে মেমোরিকার্ডগুলোকে সাধারণত ছয় ভাগে ভাগ করা হয়েছে- ক্লাস ২, ক্লাস ৪, ক্লাস ৬, ক্লাস ১০, ইউএইচএস ১ ও ইউএইচএস ৩। কার্ডের ওপর ক্লাস স্পিড রেট গোল করে উল্লেখ করা থাকে। কার্ড স্পিড রেট যত বেশি, কার্ডটি তত দ্রুতগতিতে তথ্য সরবরাহ করতে পারে। যেমন ক্লাস ৬ কার্ড সেকেন্ডে ৬ মেগাবাইটস গতিতে কাজ করতে পারে। তেমনিভাবে ক্লাস ১০ মেমোরিকার্ড ১০ মেগাবাইটস পার সেকেন্ড গতির হয়। আর ইউএইচএস কার্ডের গতি সেকেন্ডে ৩২০ মেগাবাইটস পর্যন্ত।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=80535