২৬ আগস্ট ২০১৭, শনিবার, ৯:৪৫

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের আহাজারি

স্ত্রী-সন্তানদের দাবি ছিল সুন্দর ঘরের। ইট-বালু দিয়ে তৈরি দালান না হোক, অন্তত কাঠ, টিনে তৈরি একটি ঘর। অনেক কষ্টে গত বছর ধার-দেনা করে স্ত্রী-সন্তানদের স্বপ্ন পূরণ করেন নৌকার মাঝি মমিনুল ইসলাম। স্কুলপড়ুয়া তিন সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে বেশ সুখেই ছিলেন। কিন্তু সব সুখ কেড়ে নিয়েছে সর্বনাশা বন্যা। চোখের পলকেই মমিনুলের ঘর ভেসে গেছে। এর সঙ্গে ভেসে গেছে স্ত্রী-সন্তানদের স্বপ্ন। এভাবেই ভেসে-ভেঙে গেছে অগণিত মানুষের বসতি। ঘাম ঝরানো পরিশ্রমের টাকায় তৈরি করা ঘরের কয়েক টুকরো কাঠ, টিন হাতে নিয়ে কাঁদছিল মমিনুলের সন্তান মৌসুমী। ঘরের বর্ণনা

দিতে গিয়ে ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী মৌসুমী বলছিল ‘ম্যালা কষ্টে বাপে ঘরটা বানাইছে। সেই ঘর ছাইরা অহন আমরা রাস্তায়। আল্লাহ এইডা ক্যামন বিচার কইল্যা।’ ঘর হারানো মৌসুমী, মোর্শেদাদের কান্না থামছিলো না কিছুতেই। মৌসুমীর ছোট বোন মোর্শেদা জানায়, তাদের পাঠ্য বইও ভেসে গেছে বানের জলে। জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ির ডাকাতিয়া মান্দা ছেড়ে তারা এখন আশ্রয় নিয়েছেন তারাকান্দি বঙ্গবন্ধু সেতুতে। মমিনুল জানান, প্রায় ১৫ দিন আগের কথা। দ্রুত পানি বাড়ছে। বাড়ির ভিটে ছুঁই ছুঁই অবস্থা। ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করছিল যমুনা। দ্রুত ঘরের জিনিসপত্র সরানোর প্রস্তুতি নেন। নৌকা ঘাটে এনেছেন মাত্র অমনি বন্যার পানিতে ভেসে যায় ঘরবাড়ি। কোনোমতে নিজেদের রক্ষা করেন তারা। চোখের পলকেই তা ঘটে। পানির প্রবল আঘাতে শেষ পর্যন্ত ভেঙে যায় ঘরটিও। এখন রাস্তায় তাদের দিনাতিপাত। পলিথিন ও ভাঙা টিন দিয়ে কোনোভাবে আশ্রয় নিয়েছেন তারা। শ্রমিকদের কাজ জুটছে না। খাবার জুটছে না ঠিকমতো। ক্ষুধায় কান্না করে শিশুরা। মানুষের কষ্ট দেখে সহ্য করতে পারেন না ৮০ বছর বয়সী ইউপি মেম্বার সোহরাব আলী। নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করে তিনি বলেন, এই ওয়ার্ডে দেড় সহস্রাধিক ভোটার। সবাই বন্যার্ত। ঘর হারিয়ে নিরাশ্রয় তাদের অনেকে। কিন্তু সরকারি ত্রান সবাইকে দেয়া সম্ভব না। মাত্র ১৭৫ জনকে ত্রাণ দিতে পেরেছি। আমি নিরুপায়। জামালপুরের সরিষাবাড়ি, ইসলামপুর, মেলান্দহ, দেওয়ানগঞ্জ, বকশীগঞ্জ সর্বত্র একইচিত্র।
জমির ধান ও পাট বিক্রি করে মেয়েকে এবার বিয়ে দেয়ার ইচ্ছে ছিল সোলায়মান শেখের। ইসলামপুরের কটাপুর গ্রামের এই কৃষকের স্বপ্ন-সুখ কেড়ে নিয়েছে বন্যা। বন্যায় কি ক্ষতি হয়েছে জানতে চাইলে, দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে নিজের কষ্টের কথাগুলো জানান তিনি। জমানো টাকা দিয়ে বীজ-সার কিনে চাষ করেছিলেন ধান। তা গিলেছে সর্বনাশা বন্যা। বাড়ির পাশে পানিতে ছিল প্রায় লাখ টাকার পাটের জাগ। তাও ভেসে গেছে। ছোট-ছোট চার সন্তান নিয়ে দু’চোখে অন্ধকার দেখছেন এই কৃষক।
ইসলামপুরের উলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী লাকী ও তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী আঁখি। অনেকের মতো মলিনমুখে উলিয়া বাঁধে দাঁড়িয়ে যমুনার দিকে তাকিয়ে ছিল তারা দুই বোন। ত্রাণ অপেক্ষায় তারা। দুপুরে খেয়েছে কি-না জানতে চাইলে নির্বাক তাকিয়ে থাকে লাকি। এই শিশুকন্যার চোখ দিয়ে তখন পানি ঝরছিল। প্রতিবেশী বুধবার সকালে খাবার দিয়েছেন দুই বোনকে। দুপর পেরিয়ে বিকাল এলেও তখনও খাওয়া হয়নি। মা-বাবা কোথায় জানতে চাইলে লাকি জানায়, বন্যায় ঘরের জিনিসপত্র সব ভেসে গেছে। অল্প ধান-চাল ছিল তাও ভেসে গেছে পানিতে। জমানো কোনো টাকা নেই। খাবার নেই। বাধ্য হয়ে কাজের সন্ধানে মা-বাবা এখন ঢাকায়। দুই বোন একাই থাকেন বাড়িতে। নৌকাযোগে ইসলামপুরে যমুনা নদী দিয়ে যাওয়ার সময় তীরে জড়ো হতে থাকেন নতুনপাড়া গ্রামের লোকজন। অচেনা কাউকে দূর থেকে দেখে এভাবেই ত্রাণের জন্য ভিড় করেন তারা। তাদের মধ্যে একজন শরীফ উদ্দিন। নিজের ভাঙা ঘরটি দেখিয়ে তার জন্য কিছু করার অনুরোধ করেন। এই গ্রামের প্রায় প্রতিটি ঘর ডুবেছিল বন্যার পানিতে। চাল ছুঁই ছুঁই পানিতে ভেঙে গেছে অনেকের ঘর। শরীফ জানান, ঘর নির্মাণ করতে টাকার দরকার। অন্যদিকে ঘরে খাবার নেই। কাজও পাচ্ছেন না। কি করবেন- দুশ্চিন্তার শেষ নেই তার।

সরকারি হিসেবে বন্যায় জামালপুর জেলার পৌরসভাসহ সাতটি উপজেলার ২০২৫৭টি ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরমধ্যে অন্তত ৪০০ ঘর সম্পূর্ণ ভেসে গেছে। বন্যায় মারা গেছেন ১৪ জন। নানাভাবে ১০ লাখ ৪৪ হাজার ৬৪২ জন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। জামালপুরে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছে বিভিন্নস্থানে। একই সড়কে কখনও গাড়ি, কখনও নৌকা ব্যবহার করতে হচ্ছে। জামালপুর থেকে মাহমুদপুরের প্রায় ১২ কিলোমিটারের রাস্তায় বড় বড় অন্তত চারটি ভাঙন রয়েছে। প্রতিটি ভাঙ্গনে চালু হয়েছে খেয়া নৌকা। পুরো জেলায় ১১০৪ কিলোমিটার রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরমধ্যে ১৭ কিলোমিটার রাস্তা পুরোপুরি ধ্বংস হয়েছে। ৪৪টি ব্রিজ-কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১০টি।
জামালপুরের জেলা প্রশাসক আহমেদ কবীর বলেছেন, বন্যার্তদের ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে। পর্যায়ক্রমে তা বাস্তবায়ন করা হবে বলে জানান তিনি।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=80519