২৬ আগস্ট ২০১৭, শনিবার, ৯:০০

সর্বোচ্চ আদালতের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধ’

আশিকুল হামিদ : গত ১ আগস্ট ঘোষিত হওয়ার পর থেকে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায় নিয়ে প্রতিক্রিয়ার নামে যে বিতর্কের শুরু হয়েছিল, তার এখনো অবসান হয়নি। পরিবর্তে বরং রীতিমতো ‘যুদ্ধ পরিস্থিতির’ সৃষ্টি করা হয়েছে! স্মরণ করা দরকার, ৭৯৯ পৃষ্ঠার সুদীর্ঘ রায়টিতে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে শুরু করে গণতন্ত্র, রাজনীতি, নির্বাচন, জাতীয় সংসদ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, সংসদ ও বিচার বিভাগের সম্পর্ক, মাননীয় বিচারপতিদের জবাবদিহিতা, আচরণবিধি ও অপসারণ, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল, নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন এবং সামরিক শাসন পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সকল বিষয়েই সর্বোচ্চ আদালতের পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে। রায়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে সংবিধান এবং সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন। রায়টিতে অতীতের বিভিন্ন ভুল সম্পর্কেও সুস্পষ্ট পর্যবেক্ষণ রয়েছে। সব মিলিয়েই রায়টি বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য দিকনির্দেশনাদানকারী একটি আইনি দলিলের অবস্থান ও মর্যাদা অর্জন করেছে।

উল্লেখ্য, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের একটি নিন্দিত ও বিতর্কিত পদক্ষেপের কারণেই সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী সংক্রান্ত রায় দিতে হয়েছে সর্বোচ্চ আদালতকে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের নামে হাস্যকর কিন্তু ভয়ংকর পন্থায় বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসেছিল। ওই নির্বাচনে তিনশ’ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে ১৫৪ জনই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘নির্বাচিত’ বলে ঘোষিত হয়েছিলেন। প্রথম কিছুদিন পর্যন্ত ‘সাংবিধানিক নিয়ম রক্ষার নির্বাচন’ বলে প্রচারণা চালানো হলেও এমনভাবেই সরকার গঠন করা হয়েছিল যেন ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ভোটার জনগণ সত্যিই আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিল! অথচ অনেক চেষ্টা ও চাতুরি করেও সরকার এবং নির্বাচন কমিশন পাঁচ শতাংশের বেশি ভোটারের উপস্থিতি ও অংশগ্রহণের তথ্য প্রমাণ করতে পারেনি। সে কারণে একমাত্র ‘বন্ধুরাষ্ট্র’ ভারত ছাড়া বিশ্বের কোনো দেশও নির্বাচনটিকে গ্রহণ বা সমর্থন করেনি। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার গঠন করে ছেড়েছিলেন। অমন অবস্থায় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি সাধারণ মানুষের দৃষ্টিও দেশের সর্বোচ্চ আদালতের দিকে নিবদ্ধ হয়েছিল। এর পেছনে ছিল সঙ্গত বিশেষ কারণ। সে কারণ সর্বোচ্চ আদালতের সাংবিধানিক ক্ষমতা ও মর্যাদা। সংবিধান সুপ্রিম কোর্টকে সংবিধানের ‘অভিভাবক’ বানিয়েছে। জাতীয় সংসদে পাস করা সংবিধানের যে কোনো ধারা-উপধারার এবং সকল আইন ও সংশোধনীর ব্যাখ্যা দেয়ার পাশাপাশি সেগুলো বাতিল করার ক্ষমতাও সংবিধান সুপ্রিম কোর্টকেই দিয়ে রেখেছে। সংবিধানের দেয়া এই ক্ষমতা ও মর্যাদার মধ্যেই ক্ষমতাসীনরা তাদের বিপদের সম্ভাবনা আবিষ্কার করেছিলেন। কারণ, ৫ জানুয়ারির পর থেকে সরকারের বৈধতা নিয়ে শুধু নিন্দা-সমালোচনাই হয়নি, কোনো কোনো মহল বিষয়টিতে হস্তক্ষেপ করার জন্য সুপ্রিম কোর্টের প্রতি আহবানও জানিয়েছিলেন।

তীব্র সমালোচনার মুখে সরকার প্রথমে ভেবেছিল, মাননীয় প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে হয়তো তার পূর্বসুরী এবিএম খায়রুল হকের মতো যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করা যাবে। বিচারপতি সিনহা হয়তো অনুরোধ ও পরামর্শের আড়ালে দেয়া ক্ষমতাসীনদের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করবেন। অন্যদিকে মাননীয় প্রধান বিচারপতি সিনহা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, তার কাছে সংবিধান এবং সর্বোচ্চ আদালতের মর্যাদা অনেক বিরাট ব্যাপার। তিনি তাই সংবিধান এবং সর্বোচ্চ আদালতের মর্যাদা রক্ষার প্রশ্নে কঠিন ও বলিষ্ঠ অবস্থান নিয়েছিলেন। এখানেই শুরু হয়েছিল আসল সংকটের। উল্লেখ্য, বিচারপতি সিনহার পূর্বসুরী এবিএম খায়রুল হকের বিরুদ্ধে সরকারের কাছ থেকে নগদে লাখ লাখ টাকা ‘ত্রাণ’ নেয়াসহ ব্যক্তিগত বেশ কিছু অপকীর্তির অভিযোগ রয়েছে। বলা হয়েছে, ২০১১ সালের ১৬ মে বিদায় বা অবসর নেয়ার আগে প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক সরকারের সঙ্গে গোপন যোগসাজশ ও সমঝোতা করে কয়েকটি রায় দিয়ে গেছেন। এসবের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নিন্দিত হয়েছিলেন তিনি পঞ্চদশ সংশোধনীর ব্যাপারে। অভিযোগ রয়েছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে আনা সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর কোথায় কোন শব্দ ও বাক্য বসাতে হবে সেসব বিষয়েও বিচারপতি খায়রুল হক সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করেছিলেন। এর প্রমাণ দেয়ার জন্য বলা হয়েছে, সংসদীয় কমিটির পরামর্শে ২০১১ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি আইন মন্ত্রণালয় যেভাবে সংবিধান পুনর্মুদ্রণ করেছিল ঠিক সেভাবেই ১০ মে রায় দিয়েছিলেন বিচারপতি খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ। অর্থাৎ আগে পুনর্মুদ্রিত সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাদ দেয়া হয়েছে, তারও তিন মাস পর ব্যবস্থাটিকে বাতিল ঘোষণা করেছে পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ।

প্রধান বিচারপতির মাত্র সেদিনের এই নিন্দনীয় ভূমিকার কারণে ক্ষমতাসীনরা বর্তমান প্রধান বিচারপতির কাছে যা কিছু আশা করেছিলেন তার কোনো একটির ব্যাপারেই সম্মত হননি বিচারপতি এস কে সিনহা। সে কারণেই রীতিমতো ‘যুদ্ধ পরিস্থিতির’ সৃষ্টি করা হয়েছে। মুখে না বললেও ক্ষমতাসীনরা আসলে দেশের বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হলো, এই যুদ্ধে ‘প্রধান সেনাপতি’কে সব সময় সামনে দেখা যাচ্ছে না। পরিবর্তে অন্তরালে দেয়া তার নির্দেশে একের পর এক দৃশ্যপটে আসছেন অন্যরা। নাটকীয়তাও তারা যথেষ্টই করে চলেছেন। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাসহ আপিল বিভাগের মাননীয় বিচারপতিদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানানোর পাশাপাশি আদালত অবমাননার মতো অশোভন ও আপত্তিকর বক্তব্য রেখে চলেছেন তারা। শুরুতে মনে হয়েছিল, যুদ্ধের নেতৃত্ব সম্ভবত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতই দেবেন। কারণ, সুপ্রিম কোর্ট এবং মাননীয় বিচারপতিদের তুলোধুনা করে সিলেটের এক অনুষ্ঠানে তিনি ঘোষণা করেছিলেন, বিচারপতিরা যতবার ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে রায় দেবেন ততবার তারা অর্থাৎ আওয়ামী লীগ সরকার নতুন করে সংশোধনীটি পাস করবে। মিস্টার মুহিত চ্যালেঞ্জ দিয়ে আরো বলেছিলেন, দেখি কতবার তারা অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্ট এবং মাননীয় বিচারপতিরা সংশোধনীটি বাতিল করতে পারেন!

অর্থমন্ত্রীর পরপর দৃশ্যপটে এসেছিলেন এককালের জাঁদরেল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বাকশাল সরকারের প্রধানমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর সুপুত্র মোহাম্মদ নাসিম। বর্তমান সরকারের কম গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্যমন্ত্রী হলেও তিনি ঘোষণা করেছিলেন, আদালতের হাত কত ‘লম্বা’ তা তারা ‘দেখে’ ছাড়বেন! মোহাম্মদ নাসিমের এই হুংকার বাতাসে মিলিয়ে যাওয়ার আগেই দৃশ্যপটে লাফিয়ে এসেছিলেন খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম। মাত্র কিছুদিন আগে গম কেলেংকারি এবং আদালত অবমাননার দায়ে দন্ডিত হয়ে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা দেয়ার কারণে ব্যাপকভাবে নিন্দিত এই মন্ত্রী শুধু ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেয়া রায় বাতিল করার দাবি জানিয়ে থেমে পড়েননি, প্রধান বিচারপতির পদ থেকে বিচারপতি এস কে সিনহাকে সরিয়ে দেয়ারও দাবি জানিয়েছেন। ‘আইনের মানুষ’ এবং একজন দন্ডিত ব্যক্তি হয়েও অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম কিভাবে এ ধরনের দাবি জানাতে পারলেন- সে প্রশ্ন তো উঠেছেই, রাজনৈতিক অঙ্গনের আলোচনায় একথাও বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গেই বলা হয়েছে যে, ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেয়া রায়টির সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করার কোনো সুযোগ নেই। কারণ, খাদ্যমন্ত্রীর মাধ্যমে ক্ষমতাসীনরা বুঝিয়ে দিয়েছেন, সংশোধনীটি বহাল রাখা হলে এবং মাননীয় বিচারপতিদের ইম্পিচমেন্ট ও অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে দেয়া হলে কামরুল ইসলামের মতো লোকজন কতটা ন্যক্কারজনভাবে বিচারপতিদের অসম্মানিত করার ‘সাংবিধানিক’ ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন। বলা হয়েছে, একজন দন্ডিত ব্যক্তি হিসেবে খাদ্যমন্ত্রীর নিজের যেখানে লজ্জায় সরে যাওয়া উচিত ছিল, সেখানে উল্টো তিনিই মাননীয় প্রধান বিচারপতিকে তাড়িয়ে দেয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন!
ঘটনাপ্রবাহের ওই বিশেষ পর্যায়ে স্তম্ভিত জনগণকে ক্ষুব্ধ করতে হঠাতই দৃশ্যপটে এসে হাজির হয়েছিলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক। আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে ডাকা এক সংবাদ সম্মেলনে ৯ আগস্ট তিনি মাননীয় প্রধান বিচারপতিসহ সর্বোচ্চ আদালতের বিরুদ্ধে রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণার ঢঙে তীব্র বিষোদ্গার করেছেন। মূলকথায় বলেছেন, রায়টি নাকি ‘পূর্বধারণা প্রসূত’ অর্থাৎ আগে থেকে করে রাখা চিন্তাভাবনার ফসল! এতে নাকি অপ্রাসঙ্গিক বিভিন্ন বিষয়ে এত বেশি পর্যবেক্ষণ রয়েছে যার ফলে মূল ইস্যুটাই হারিয়ে গেছে! নিজের প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে মূলকথায় খায়রুল হক বলেছেন, ‘জনগণের নয়, আমরা বিচারকদের প্রজাতন্ত্রে বসবাস করছি!’

মন্ত্রীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আরো অনেক কথাও বলেছেন সাবেক এ প্রধান বিচারপতি। সব মিলিয়ে বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, আবারও তিনি ক্ষমতাসীনদের সেবাদাসগিরি করতেই দৃশ্যপটে হাজির হয়েছেন। এমন মন্তব্যের কারণ, সংবিধানের ৯৯ অনুচ্ছেদে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসর পরবর্তী জীবনে কোনো লাভজনক পদে নিযুক্তি নেয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অন্যদিকে খায়রুল হক রীতিমতো বেতন-ভাতাসহ আইন কমিশনের চেয়ারম্যানের পদে চাকরি করছেন। এটা আইনত তিনি পারেন না বলে মত প্রকাশ করেছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞরা। সাবেক এ প্রধান বিচারপতি সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করার পেছনে প্রধান একটি কারণ হলো, ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেয়া রায়ে এমন অনেক পর্যবেক্ষণ রয়েছে বাস্তবে যেগুলো খায়রুল হকের বিরুদ্ধে গেছে। যেমন এবিএম খায়রুল হক প্রধান বিচারপতি থাকাকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দেয়া যে রায়ের অজুহাত দেখিয়ে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করা হয়েছিল, সে রায়ের পর্যালোচনা করতে গিয়ে বেঞ্চের সাত বিচারপতিই বলেছেন, রায়টিতে একথাও বলা হয়েছিল যে, ‘দেশের শান্তি স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার স্বার্থে’ পরবর্তী দুটি সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে। তাছাড়া রায়ের নামে প্রথমে যা ঘোষণা করা হয়েছিল তা আসলে ছিল একটি ‘সংক্ষিপ্ত আদেশ’, পূর্ণাঙ্গ রায় নয়। পূর্ণাঙ্গ রায় না দেখে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর কোনো সাংবিধানিক বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার চেষ্টা সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা সে পদক্ষেপই নিয়েছিলেন। এ পর্যন্ত এসেই ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেয়া রায়ে নিজের গভীর বিস্ময়ের কথা প্রকাশ করেছেন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা। বলেছেন, ‘দেশের শান্তি স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার স্বার্থে’ ক্ষমতাসীনদের উচিত ছিল পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠান করা। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা কেবল নিজেদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার ব্যাপারেই তৎপর থেকেছেন। তারা তাই পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাই বাতিল করে দিয়েছেন।
ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেয়া রায়ে অন্য কিছু বিষয়ের মধ্যে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে এসেছে মাননীয় বিচারপতিদের অপসারণ ও সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের প্রসঙ্গ। মাননীয় প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বে গঠিত বেঞ্চের সাতজন মাননীয় বিচারপতিই একমত হয়ে ঘোষণা করেছেন, সামরিক শাসক হিসেবে পরিচিত প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান কোনো ফরমানের মাধ্যমে সংসদের ক্ষমতা খর্ব করে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত করেছিলেন বলে যে প্রচারণা চালানো হয় সেটা সঠিক নয়। বাস্তবে সংসদের কাছ থেকে কেড়ে এই ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে দেয়া হয়েছিল ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে, সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে। সে সংশোধনীর পেছনে প্রধান ভূমিকা রেখেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান- যিনি বাকশালের একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করে রাষ্ট্রপতির পদে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। সুতরাং জেনারেল জিয়াউর রহমানকে দায়ী করার সুযোগ থাকতে পারে না। বেঞ্চের সদস্য মাননীয় বিচারপতি আবদুল ওয়াহাব এ প্রসঙ্গে নিজের অভিমত জানাতে গিয়ে লিখেছেন, ‘সংসদ সদস্যদের নজরে এটাও আনা হয়নি যে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু নিজেই চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদ কর্তৃক সুপ্রিম কোর্টের বিচারক অভিসংশনের ক্ষমতা রহিত করেছিলেন। তিনি (শেখ মুজিব) ওই ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির কাছে ন্যস্ত করেছিলেন।’

বাকশাল এবং চতুর্থ সংশোধনী প্রসঙ্গে বেঞ্চের আরেক সদস্য মাননীয় বিচারপতি মো. ইমান আলী লিখেছেন, ‘আর ঘটনাক্রমে সেই সংসদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।’ বিচারপতি মো. ইমান আলী তার পর্যবেক্ষণে আরো লিখেছেন, ‘সরকার পদ্ধতি পরিবর্তন করে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে স্পষ্টতই সংবিধানের মৌলিক কাঠামো পরিবর্তন করা হয়েছিল। এটা কৌতূহলোদ্দীপক যে, ‘৭২-এর সংবিধানে রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতির কাছে শপথ নিতেন। অথচ চতুর্থ সংশোধনীতে বিধান করা হলো, রাষ্ট্রপতি স্পিকারের কাছে শপথ নেবেন। এরপর সামরিক ফরমান দ্বারা পুনরায় বিধান করা হলো যে, রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতির কাছেই শপথ নেবেন। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আবার শপথ নেয়ার বিধান স্পিকারের কাছেই ফিরিয়ে নেয়া হয়।’ এমন বিধানের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বিচারপতি মো. ইমান আলী লিখেছেন, ‘এর মানে, ‘৭২-এর সংবিধানে নয়, তারা (অর্থাৎ আওয়ামী লীগের বর্তমান ক্ষমতাসীনরা) ফিরে গেছেন চতুর্থ সংশোধনীতে। অন্যদিকে সংসদের উদ্দেশ্য যদি ‘৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়া হয় তাহলে প্রধান বিচারপতিরই উচিত রাষ্ট্রপতির শপথ পড়ানো।’
বর্তমান নিবন্ধের সমাপ্তি টানার আগে তিনটি বিশেষ প্রসঙ্গের পুনরুল্লেখ করা দরকার। প্রথমত, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সুচিন্তিত পরিকল্পনার ভিত্তিতে এই বলে প্রচারণা চালানো হয় যে, বিচারপতিদের ইম্পিচমেন্ট বা অভিসংশন ও অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছ থেকে কেড়ে রাষ্ট্রপতির হাতে দিয়েছিলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। এটা তিনি করেছিলেন এক সামরিক ফরমানের বলে। অন্যদিকে আলোচ্য রায়ে সাত বিচারপতিই বলেছেন, বাস্তবে সংসদের কাছ থেকে কেড়ে বিচারপতিদের সম্পর্কিত এই ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে দিয়েছিলেন বাকশাল সরকারের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে এটা করেছিলেন তিনি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে। কিন্তু বর্তমান ক্ষমতাসীনরা এ বিষয়ে সংসদকে তো বটেই, দলীয় নেতা-কর্মীদের পাশাপাশি জনগণকেও কিছুই জানতে দিচ্ছেন না। এই পর্যবেক্ষণের আলোকে বলা দরকার, মাননীয় বিচারপতিদের অভিসংশন ও অপসারণের বিষয়ে জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীনদের প্রচারণার পেছনে কোনো সত্যতা নেই।

দ্বিতীয়ত, রাষ্ট্রপতির শপথ পাঠ করানোর ব্যাপারেও নতুন বিধান প্রবর্তন করেছিলেন একই নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। স্পিকারের কাছে শপথ পাঠের বিধানে পরিবর্তন এনেছিলেন জিয়াউর রহমান। তার সময় থেকে প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতিকে শপথ পাঠ করাতেন। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বিধানটিতে পরিবর্তন ঘটিয়েছে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু এ ব্যাপারেও ক্ষমতাসীনরা প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন। তারা এমনভাবে প্রচারণা চালাচ্ছেন যেন এর মাধ্যমে ১৯৭২ সালের প্রথম সংবিধানে ফিরে যাওয়া হয়েছে। অন্যদিকে ৭৯৯ পৃষ্ঠার রায়ে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগের বর্তমান ক্ষমতাসীনরা আসলে ফিরে গেছেন চতুর্থ সংশোধনীতে। বাকশালের বিধানে।

ক্ষমতাসীনরা যে সর্বোচ্চ আদালতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন এবং সে যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন- এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই দেশের কোনো মহলে। একই সঙ্গে সাধারণভাবে বলা হচ্ছে, ষোড়শ সংশোধনীতে কোনো ‘পাওয়ার কন্টেস্ট’ ছিল না এবং বিচার বিভাগের সঙ্গে সরকার তথা নির্বাহী বিভাগ ‘মুখোমুখি’ হয়নি ধরনের বাগাড়ম্বর করা হলেও বাস্তবে ক্ষমতাসীনরা কিন্তু নিজেদের উদ্দেশ্য আড়াল করতে পারেননি। তেমন সদিচ্ছাও সম্ভবত নেই তাদের। বলা দরকার, কোনো ‘পাওয়ার কন্টেস্ট’ ছিল না কথাটা আদৌ সত্য হলে ক্ষমতাসীনদের উচিত ছিল আপিল বিভাগের রায় বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নেয়া এবং সর্বোচ্চ আদালতের প্রতি সম্মান দেখানো। কারণ, রায়টিতে মাননীয় বিচারপতিদের ইম্পিচমেন্ট ও অপসারণের ক্ষমতা ‘অকার্যকর’ সংসদের ‘ইম্যাচিওর্ড’ সদস্যদের হাতে দেয়ার বিধান বাতিল করা হয়েছে। ক্ষমতা হাতে পেলে ক্ষমতাসীনরা কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠতেন এবং মাননীয় বিচারপতিদের বিরুদ্ধে কতটা ন্যক্কারজনকভাবে ব্যবস্থা নিতেন- এ সব বিষয়ে তো ‘যতবার-ততবার’ এবং ‘আদালতের হাত কত লম্বা তা দেখে নেয়ার’ মতো হুংকার থেকেই বোঝা গেছে।একই কারণে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি জনগণও সর্বোচ্চ আদালতের সমর্থনে এগিয়ে এসেছে। তাই বলে একথা মনে করা উচিত নয় যে, আওয়ামী লীগের ক্ষমতাসীনরা সহজে ও স্বল্প সময়ের মধ্যে তাদের ঘোষিত যুদ্ধ থেকে সরে আসবেন। তারা বরং সকল পন্থায় যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার এবং ঘোষিত রায়টি বাতিল করানোর জন্যই ব্যস্ত থাকবেন বলে মনে করা হচ্ছে।

http://www.dailysangram.com/post/297554