২৫ আগস্ট ২০১৭, শুক্রবার, ১১:৪৪

বন্যা রেখে গেছে ক্ষতের চিহ্ন

বন্যার প্রবল স্রোত। উজানের অথৈ পানি। ক্ষত-বিক্ষত জনপদ। লণ্ডভণ্ড লোকালয়। শুধু ঘরবাড়ি, স্কুল-কলেজ, কমিউনিটি ক্লিনিক কিংবা মসজিদ-মাদরাসা নয়। বিলীন হয়ে গেছে রাস্তাঘাটও। ভেঙে গেছে সেতু-কালভার্ট। বাদ যায়নি রেল লাইনও।
কুড়িগ্রামের বিভিন্ন উপজেলাসহ বন্যাকবলিত জেলাগুলোতে ব্যাপকভাবে ভেঙে পড়েছে গ্রামীণ অবকাঠামো। এখনো সড়ক মহাসড়কের সেই গভীর ক্ষত সারেনি। ফলে বিভিন্ন জেলার সঙ্গে উপজেলার সড়ক যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন রয়েছে। ত্রাণ পৌঁছাতে পড়তে হচ্ছে বিড়ম্বনায়। ফলে যাতায়াত ও পরিবহনসহ নানা ভোগান্তিতে রয়েছে বন্যাকবলিত এলাকার মানুষ।

সরজমিনে দেখা গেছে, সীমান্ত জেলা কুড়িগ্রামের সঙ্গে এর তিন উপজেলা নাগেশ্বরী, ভূরুঙ্গামারী ও ফুলবাড়ীকে সংযুক্ত
করেছে সোনাহাট স্থলবন্দর সড়ক। জেলা ও তিন উপজেলার এই একমাত্র সড়কটির চার স্থান বড় পরিসরে বিলীন হয়ে গেছে। কোনো কোনো অংশে পরিণত হয়েছে ১৫ থেকে ২০ ফুট গভীর খাদ। ১৮ ফুট চওড়া পিচের তৈরি এই জেলা সড়কটির পাটেশ্বরী বাস স্টেশন সংলগ্ন মাধবরাম এলাকায় পর পর দুটি স্থানে ২০ ও ৩০ ফুট দীর্ঘ রাস্তা ভেঙে গেছে। আরও কিছুটা এগিয়ে পাটেশ্বরী বাজার এলাকায় রাস্তা কয়েকশ ফুট ভেঙে দু’জায়গায় বিশাল অংশ খালের সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে। এই চার ভাঙনে জেলার সঙ্গে তিন উপজেলার সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।

কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ভোগডাঙ্গা ইউনিয়নের মাধবরাম গ্রামে বাসিন্দা আশরাফ আলী বলেন, বন্যার পর থেকে সড়ক বিভাগের লোকজন কেবল আসা-যাওয়া ও মাপামাপি করছে। কাজ এখনো শুরু করেনি। তাই অন্তত হেঁটে পার হওয়ার জন্য স্থানীয় উদ্যোগে কিছু অংশ ভরাট ও বাকিটাতে সাঁকো বসিয়েছি। তবে এরপরের দু’টি বড় ভাঙনে নৌকা দিয়ে পথচারীরা পারাপার হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ওই এলাকার বাসিন্দা শহীদুল ও আনু।
এছাড়া সদর উপজেলার জোতগর্বধন গ্রামের যাওয়ার কালভার্টটির দু’পাশের মাটি সরে গিয়ে খালের মাঝে পড়ে আছে। এতে গ্রামের চলাচলের একমাত্র পথটি বন্ধ রয়েছে। বন্যার পানিতে সদর উপজেলার আরো বহু রাস্তায় খানাখন্দের সৃষ্টি হয়েছে। সদরের হলোখানা ইউনিয়নের মণ্ডলপাড়া বাঁধের দু’টি স্থানে বিশাল গর্ত সৃষ্টি হওয়ায় উপর দিয়ে চলাচল বন্ধ রয়েছে।
এদিকে রাজারহাট উপজেলার ছিনাই ইউনিয়নের চরকালুয়া এলাকা বন্যা প্লাবিত হয় দু’টি বাঁধ ও রাস্তা বিলীন হয়ে। গড়েরবাজারের কাছে কালুয়া কমিউনিটি ক্লিনিকের কাছের বাঁধটি একেবারে বিলীন হয়ে গেছে। অবশিষ্ট নেই অস্তিত্বের কোনো আলামত। এখন ড্রামের উপর বাঁশের বেড়া বিছিয়ে ঝুঁকি নিয়ে স্থানীয়দের চলাচল করতে দেখা গেছে। ওই ইউনিয়নের বিভিন্ন পাকা, আধাপাকা ও কাঁচা সড়ক চলাচল অযোগ্য হয়ে পড়েছে।

ফুলবাড়ী উপজেলার পাকা সড়কের কয়েক স্থানে গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। উপজেলা সদরের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন রয়েছে চারটি ইউনিয়নের সড়ক যোগাযোগ। এলাকাবাসী নিজ উদ্যোগে কলাগাছের ভেলা তৈরি করে বন্যাকবলিত জনগণকে পারাপার করছে। কোথাও কোথাও বাঁশ, গাছের গুঁড়ি ও কলাগাছ দিয়ে সাঁকোর ব্যবস্থা করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে।
উপজেলার ব্র্যাক মোড় থেকে নির্মাণাধীন ধরলা সেতু পর্যন্ত তিন কিলোমিটার পাকা সড়কের কবির মামুদ এলাকায় খাদের সৃষ্টি হয়েছে। একই অবস্থা ফুলবাড়ী-বালারহাট সড়কে বানিয়াটারী এলাকায়। শাহবাজার-কাউয়াহাগা ঘাট পর্যন্ত দশ কিলোমিটার পাকা সড়কের বড়ভিটা সাত-আট জায়গায়, খড়িবাড়ী জোসনার মোড় থেকে হাতুর-বাটাল ব্রিজ পর্যন্ত দুই কিলোমিটার সড়কের চার-পাঁচ জায়গায়, জোসনার মোড় থেকে ভাঙামোড় ইউনিয়ন পরিষদ হয়ে খোঁচাবাড়ী বাজার পর্যন্ত ছয় কিলোমিটার সড়কের বিভিন্ন জায়গায় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। খোঁচাবাড়ী ও তালতলা ব্রিজ দুইটি একেবারে অকেজো হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে শাহবাজার থেকে ধনিরাম আবাসন পর্যন্ত তিন কিলোমিটার, শিমুলবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদ থেকে আছিয়ার বাজার এক কিলোমিটার, স্থানীয় খামারের থেকে নির্মাণাধীন ধরলা ব্রিজ পর্যন্ত তিন কিলোমিটার, গেটের বাজার পর্যন্ত এক কিলোমিটার, নাওডাঙ্গা ইউনিয়নের বালারহাট বাজার থেকে গোরকমণ্ডল আবাসন পর্যন্ত চার কিলোমিটার, নাওডাঙ্গা স্কুল এন্ড কলেজ পর্যন্ত দুই কিলোমিটার পাকা রাস্তায় বন্যার পানির প্রবল স্রোতে উপরের কার্পেটিংসহ ইটের খোয়া উঠে গেছে। তাতে চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। এ সকল রাস্তার অর্ধশতাধিক কালভার্ট, ইউড্রেন ভেঙে গিয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বন্যার কবলে বিধ্বস্ত হয়েছে উপজেলার গোরকমণ্ডল এবং সোনাইকাজী ও রামপ্রসাদ গ্রামের সংযোগ স্থলের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ। এছাড়াও উপজেলার সর্বত্রই অসংখ্য কাঁচা রাস্তার উপরের মাটি বন্যার পানির তোড়ে সরে গিয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে গ্রামীণ অবকাঠামো।
গ্রামীণ অবকাঠামোর এমন ক্ষয়ক্ষতি ভূরুঙ্গামারী, নাগেশ্বরী, রৌমারি, রাজীবপুর, উলিপুরসহ সব উপজেলার। সড়কের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রেল লাইন। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রেলসেতুও। কুড়িগ্রামের সদর উপজেলার কাঁঠালবাড়ি ইউনিয়নের জিয়াখালের বড়পুলে রেলসেতুর পিলারই ভাসিয়ে নিয়েছে করাল স্রোত।

বাংলাদেশ প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক সমাজের কুড়িগ্রাম জেলা শাখার সভাপতি ও জোতগোর্বধন এলাকার বাসিন্দা মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ১২ই আগস্ট ফজরের নামাজের পর আমার সামনেই জিয়া খালের বড়পুলের পাশের রেলসেতুটির একটি পিলার প্রবল স্রোতে উপড়ে যায়। পাশের অপর একটি পিলার দেবে গেছে। তাতে কিছুটা ভেঙে ও দেবে গেছে রেলসেতুটি। তারপর থেকে চিলমারী-কুড়িগ্রাম-রংপুর পাবর্তীপুরের রুটের রেল যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে।
বন্যায় নদীগর্ভে শত শত ঘরবাড়ি ও দোকানপাটের সঙ্গে বিলীন হয়ে গেছে বহু স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, কমিউনিটি ক্লিনিক। অনেক প্রতিষ্ঠান দুমড়ে-মুচড়ে গেছে। ধরলার গর্ভের বিলীন হওয়ার পথে কুড়িগ্রাম উপজেলা সদরের সর্দারপাড়ার ফ্রেন্ডশিপ মাধ্যমিক বিদ্যালয়। স্রোতের তোড়ে বিলীন হয়ে গেছে চরমাধবরামের এক ফোরকানিয়া মাদরাসা। ব্রহ্মপুরের মনতোলাচরে ভেঙেচুরে গেছে মনতোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। রাজারহাট উপজেলার ছিনাই ইউনিয়নের কালই কমিউনিটি ক্লিনিকের পাকা ভবনটি এখন খালের মাঝখানে চলে গেছে।

কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, কুড়িগ্রামের ৭৩ ইউনিয়নের মধ্যে ৬২টিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পুরো জেলায় ১ লাখ ২৬ হাজার ১০৫টি ঘরবাড়ি নদীভাঙনে ক্ষতির শিকার, জলমগ্ন ও পানিবন্দি হয়। জেলার ১৪০ কিলোমিটার কাঁচা ও প্রায় ২৫ কিলোমিটার পাকা রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তো সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৬৮৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ৫০ হাজার হেক্টরের বেশি জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। এ বন্যায় কুড়িগ্রামে মারা গেছে ২৩ হতভাগা।
কুড়িগ্রাম সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী এবিএম খুরশিদ আলম মানবজমিনকে বলেন, এবারের বন্যায় ব্যাপক গ্রামীণ অবকাঠামোর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সওজের আওতাধীন সাত সড়কের বিভিন্ন অংশে ক্ষয়ক্ষতির মোট পরিমাণ ২৬ কিলোমিটারের বেশি। তিন উপজেলা তো এখনও বিচ্ছিন্ন। তবে আমরা কাজ শুরু করেছি।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=80371