২৫ আগস্ট ২০১৭, শুক্রবার, ১১:৪২

বন্যাদুর্গত এলাকায় বাড়ছে রোগব্যাধি কৃষি খাতে শঙ্কা

বন্যাদুর্গতদের পাশে সর্বস্তরের মানুষ * পানির দরে বিক্রি গবাদি পশু * পানিতে ডুবে দুই শিশুর মৃত্যু * হাতীবান্ধায় ছাত্রদলের দু’পক্ষের হাতাহাতি * মুখ চিনে ত্রাণ বিতরণের অভিযোগ বিএনপির

উত্তরাঞ্চলে বন্যার পানি নামলেও এখন পর্যন্ত অনেক এলাকা পানির নিচে। যেসব স্থান থেকে পানি নামছে সেসব স্থানে দেখা দিয়েছে ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত রোগ। বন্যায় রাস্তা, ক্ষেত-খামার, মাঠঘাটের মারাত্মক ক্ষতি হওয়ায় মানুষের দুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করেছে। পশু খাদ্যের অভাব এবং নানা রোগ দেখা দেয়ায় গরু-ছাগল পানির দরে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন খামারিরা। এদিকে, বন্যাদুর্গতদের সহায়তায় এগিয়ে এসেছেন সর্বস্তরের মানুষ। স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা দুর্গতদের মাঝে সাধ্যমতো ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করছেন। তবে ত্রাণ বিতরণে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উঠেছে রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে। বন্যাকবলিতদের মুখ চিনে সরকারি ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে বলে বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে। এদিকে, লালমনিরহাটে ত্রাণ দিতে গিয়ে কেন্দ্রীয় নেতার সামনেই ছাত্রদলের দু’পক্ষের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটেছে। এবারের বন্যায় উত্তরাঞ্চলে কৃষি খাতে মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। আমন ধান রোপণ ও শাকসবজি বপনের সময় পেরিয়ে যাওয়ায় এ অঞ্চলে খাদ্যের অভাব দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরীতে বন্যার পানিতে ডুবে দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে।
উত্তরাঞ্চলের ব্রহ্মপুত্র-যমুনার পানি হ্রাস অব্যাহত থাকায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। গঙ্গা নদীর পানি হ্রাস পেতে শুরু করেছে। বর্তমানে ওই নদীর পানি বিভিন্ন পয়েন্টে বিপদসীমার ৪৯ সেন্টিমিটার থেকে ১০৮ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পদ্মা নদীর পানিও হ্রাস পাচ্ছে। মেঘনা অববাহিকায়ও বন্যার পানি কমছে। তবে ঢাকার আশপাশের নদীগুলোর কোনোটিতে পানি বাড়ছে আবার কোনোটিতে পানি ধীরে ধীরে কমছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের (এফএফডব্লিউসি) নির্বাহী প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ব্রহ্মপুত্র-যমুনার ভারতীয় অংশে আগামী ২৪-৩৬ ঘণ্টায় গড়ে প্রায় ১৬ সেমি. পানি হ্রাস পেতে পারে।

এফএফডব্লিউসির বুলেটিনে আরও বলা হয়, যমুনা-পদ্মাসহ ১৫ নদীর পানি এখনও বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে বিপদসীমার ওপরে থাকা ২২টি পয়েন্টের মধ্যে ২০টিতেই পানি কমছে। ঢাকার পাশে শীতলক্ষ্যার পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে এবং বালু ও তুরাগে পানি বাড়ছে। এর মধ্যে বালু ও তুরাগের পানি বিপদসীমার কাছাকাছি থাকায় রাজধানীর নিন্মাঞ্চল ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এতে বলা হয়, কুড়িগ্রাম, জামালপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জসহ দেশের উত্তর অঞ্চলের বর্তমান বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি অব্যাহত থাকবে। এ ছাড়া মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, মুন্সীগঞ্জ, শরীয়তপুরসহ দেশের দক্ষিণ-মধ্যাঞ্চল ও নিন্মাঞ্চলের বন্যার পানি হ্রাস অব্যাহত থাকবে।
সারা দেশ থেকে যুগান্তর ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-
রংপুর ও পীরগঞ্জ : ‘এবারের বন্যাত তাবোদ (সব) ধান চলি গেইছে। খাওয়াটাই এখন হামার সমস্যা। ঈদোত কি হামার আনন্দ আছে! ছোল-পোল গুলাক ঈদোত কিছুই কিনি দিবার পাবালাই। ট্যাকা আর ঘাস-পাতার অভাবে গরু-বকরিগুলাও (ছাগল) কম দামে বেচি জীবন বাঁচাওছি। আবাদের ক্ষতি এক বছরেও পোষে উঠপ্যার পারবালাই’- এভাবেই হতাশা প্রকাশ করেন উপজেলার চতরা ইউনিয়নের মাটিয়াল পাড়ার বানভাসি গোফফার মিয়া। বন্যার পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে জর-সর্দি, ডায়রিয়া ও চুলকানির পরিমাণ বাড়ছে। প্রায় ৩০টি গ্রামের রাস্তা পানির নিচে থাকায় নৌকা ছাড়া যাতায়াত করা যাচ্ছে না। বন্যাদুর্গতদের মাঝে শুকনো ও খিচুড়ি বিতরণ করা হচ্ছে। চতরা বিজ্ঞান ও কারিগরি কলেজ, এসএসসি ব্যাচ-৯৯, চক করিম সমাজকল্যাণ সংস্থা, চতরা ডিগ্রি কলেজসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণ সরবরাহ করা হয়। রংপুর বিভাগীয় সাংবাদিক সমিতি ঢাকার সভাপতি কেরামত উল্লাহ বিপ্লবের সহযোগিতায় উত্তরাঞ্চলের বন্যার্তদের অর্থ সহায়তা দেন কুয়েত প্রবাসী ব্যবসায়ী কাজী শহিদ ইসলাম পাপুল। বুধবার বিকালে মাটিয়াল পাড়ায় কুয়েত প্রবাসী ও লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলা সদরের কাজীবাড়ির কাজী পাপুল নিজস্ব তহবিল থেকে বন্যার্তদের জন্য ৫০ লাখ টাকা দেয়ার ঘোষণা দেন।

রাজশাহী : দুর্যোগে সরকারি ত্রাণ সহায়তা পাওয়া জনগণের সাংবিধানিক অধিকার হলেও উত্তরাঞ্চলের বানভাসিদের শাসক দলের জনপ্রতিনিধিরা মুখ চিনে চিনে ত্রাণ বিতরণ করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। বিএনপির রাজশাহী বিভাগীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক শাহীন শওকত এ অভিযোগ করেন। বৃহস্পতিবার রাজশাহী নগরীর একটি রেস্টুরেন্টে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, উত্তরাঞ্চলে বন্যা মহামারীর আকার নিয়েছে। ছড়িয়ে পড়ছে ডায়রিয়া। বানভাসি মানুষের আশ্রয় নেয়ার মতো জায়গা নেই। খাবারের সংকট আরও বেশি। অথচ সরকারি দলের এমপিরা এমন দুর্যোগেও জনগণের পাশে দাঁড়াচ্ছেন না।
নাগেশ্বরী (কুড়িগ্রাম) : নাগেশ্বরীর দুটি স্থানে বন্যার পানিতে ডুবে দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে। তারা হল : রায়গঞ্জ ইউনিয়নের পূর্ব সাপখাওয়া গ্রামের মশিয়ার রহমানের মেয়ে মুনতাহার আক্তার মুশফিকা (২) এবং বেরুবাড়ি ইউনিয়নের সর্দারটারি গ্রামের আতাউর রহমানের ছেলে নাহিদ হাসান মেহেদী (৬)। বন্যায় তলিয়ে যাওয়া বাড়ির পাশের পুকুরে বুধবার বিকালে পড়ে যায় মুশফিকা। অনেক খোঁজাখুঁজির পর সন্ধ্যায় পুকুর থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। অপরদিকে, মঙ্গলবার বিকালে নিখোঁজ হয় মেহেদী। একদিন পর বুধবার সন্ধ্যায় দুধকুমার নদের আয়নাল ঘাটের পাশে তার লাশ ভেসে ওঠে।

লালমনিরহাট : হাতীবান্ধায় ত্রাণ দেয়ার আগে কেন্দ্রীয় নেতাকে স্বাগত জানানো নিয়ে ছাত্রদলের দুই গ্রুপের নেতাদের মাঝে হাতাহাতির ঘটনা ঘটেছে। বুধবার রাত ৮টার দিকে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সম্পাদক আকরামুল হাসান মিঠুর উপস্থিতিতে এ ঘটনা ঘটে। উপজেলার সানিয়াজান ইউনিয়নের বাসিন্দা ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতা শাহিন আকন্দের আমন্ত্রণে ত্রাণ দিতে আসেন কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আকরাম হাসান মিঠু। রাত ৮টার দিকে মিঠুকে স্বাগত জানিয়ে মিছিল করা হয়। তবে মিছিলে উপজেলা ছাত্রদলের সহসম্পাদক আবদুল্লাহ আল নোমান ও টংভাঙ্গা ইউনিয়ন শাখার সদস্য সচিব জাহিদ হাসানের মাঝে বাকবিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে তাদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। নোমান জানান, জাহিদ তাকে মিছিলে প্রবেশে বাধা দেয়ার পাশাপাশি ধাক্কা দেন। অপরদিকে, জাহিদ জানান, মিঠু অনুষ্ঠানে আসার কয়েক মিনিট আগে নোমান বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করেন। মহির খান নামে ছাত্রদলের এক কর্মীকে নোমান ধাক্কা দিলে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। মিছিলে নোমান ও জাহিদের মাঝে হাতাহাতি হয়েছে বলে স্বীকার করেন উপজেলা ছাত্রদলের সভাপতি শরিফুল ইসলাম। লালমনিরহাট জেলার কৃষি খাতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৮৯ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এই বিপর্যয়কর পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে না পারলে এ অঞ্চলে খাদ্যাভাব দেখা দেয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ নিয়ে কৃষক পরিবারগুলোর মাঝে চরম উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। সদর উপজেলার কুলাঘাট ইউনিয়নের সাকোয়া এলাকার কৃষক মজিবর রহমান জানান, এবারের বন্যায় তার দুই বিঘা জমির আমন ক্ষেত সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। কোথাও আমন চারা পাওয়া যাচ্ছে না। রংপুরের পীরগাছা থেকে এক বিঘার জন্য ১৪০০ টাকা দিয়ে কিছু রোপা আমন চারা কিনেছেন। আরও চারার জন্য তিনি বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ নিচ্ছেন কিন্তু কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না।
চরভদ্রাসন (ফরিদপুর) : চরভদ্রাসন উপজেলার পদ্মার চরাঞ্চলে বন্যায় গবাদি পশু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন খামারিরা। প্রায় এক মাস ধরে গরু-ছাগল নিয়ে তারা উঁচু জায়গায় ও বিভিন্ন স্কুল প্রাঙ্গণে আশ্রয় নিয়েছেন। গো-খাদ্যের মাঠ ও ক্ষেতগুলো ডুবে যাওয়ায় গো-খাদ্যের অভাব দেখা দিয়েছে। খেতে না পেয়ে গরু-ছাগল শুকিয়ে যাচ্ছে। এতে তারা সেগুলোর সঠিক দাম পাচ্ছেন না। এ কারণে চরাঞ্চলের গরু লালন-পালনকারীরা বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়েছেন।

http://www.jugantor.com/last-page/2017/08/25/150807