২৫ আগস্ট ২০১৭, শুক্রবার, ১১:০৮

ঢাকা

এ কেমন শহর!

এ কে এম জাকারিয়া

ঢাকা দুনিয়ার সবচেয়ে খারাপ শহরগুলোর একটির তকমা পেয়ে যাচ্ছেফেসবুকে আমার এক বন্ধু প্রশ্ন করেছেন, ‘এ কেমন শহর?’ এমন একটি ফেসবুক স্ট্যাটাস বা এ প্রশ্ন তিনি কেন করেছেন, তা অনুমান করতে কারও কষ্ট হচ্ছে না তো? গাড়িতে বা যানবাহনে এখন আমাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় পার করতে হয়। এ সময় ফেসবুকই অনেকের আশ্রয়। কিন্তু এরপরও ধৈর্য বলে তো একটা কথা আছে! আপনি তো আর গাড়িতে এমনি এমনি বসে নেই, কোথাও যাওয়ার জন্যই উঠেছেন। কখন পৌঁছাবেন তার হিসাবটিও তো আছে। ঢাকার যানজট আপনার মাথায় আছে, জানেন ১০ মিনিটের পথ ৩০ মিনিট লাগবে বা ৩০ মিনিটের পথ দেড় ঘণ্টা। কিন্তু এসব হিসাব-নিকাশও এখন আর মিলছে না। সবকিছু কি আমাদের অনুমান বা ধারণার বাইরে চলে যাচ্ছে না?

কী আর করা! গাড়িতে বসে ফেসবুক করা আর বিরক্তি ঝাড়া! গত দুই-তিন দিনে আমার কয়েকজন বন্ধু ফেসবুকে যেসব স্ট্যাটাস দিয়েছেন, তা পাঠকদের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে চাই। এক বন্ধু লিখেছেন, ‘ঢাকা ক্রমশ বসবাসের অযোগ্য নগরে পরিণত হচ্ছে। এত স্ট্রেস নিয়ে মানুষ বাঁচবে কীভাবে?’ আরেক বন্ধু তাঁর অভিজ্ঞতা জানাচ্ছেন এভাবে; ‘আধা ঘণ্টা, ৪৫ মিনিট পরপর ৫-৭ সেকেন্ডের মতো সময় গাড়ির চাকা ঘুরছে অ্যাট লিস্ট।’ আরেক বন্ধু লিখেছেন, ‘এমন যানজটের ঢাকা শহর লইয়া আমি কী করিব। র‍্যাডিসনের সামনে থেকে বনানীর পুরো রাস্তায় গাড়ির বহর থেমে আছে। কী যে এক অসহনীয় যন্ত্রণা।’

গত মঙ্গলবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে বেশ গভীর রাতে। সকালে অফিসে যাবেন কীভাবে, সেই ভেবে এক বন্ধু সম্ভবত তখনই অস্থির। গভীর রাতে ফেসবুক স্ট্যাটাসে তাঁর উদ্বেগ, ‘আজকেও কি পুরো শহর ডুবে যাবে বৃষ্টিতে?’ রাস্তার এই দশা নিয়ে বিরক্তির প্রকাশ আর কত করা যায়। অনেকে বেছে নেন ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের পথ। সারা দিন অফিস করে আমার সেই বন্ধু বেচারা সম্ভবত বাসায় ফিরছিলেন। অনুমান করি কোনো কারণে হয়তো তাঁর তাড়া ছিল। কিন্তু আটকে আছেন শত শত গাড়ির ভিড়ে। লিখেছেন, ‘আজ কি চাঁদরাত? সবাই কি চাঁদ খুঁজতে রাস্তায় নেমেছে?’ তাঁর আরেকটি স্ট্যাটাস, ‘সংসারের সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি নির্ভর করে শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থার ওপর।’প্রিয় ঢাকাবাসী পাঠক, আপনারা নিজেরা বা আপনাদের অনেক বন্ধুও নিশ্চয়ই এ ধরনের স্ট্যাটাস দেন। আর আপনাদের অভিজ্ঞতাই-বা কী বলে? এই ফেসবুক স্ট্যাটাসগুলোর মধ্যে আপনাদের মনের কথাগুলো শোনা যাচ্ছে কি?
আমরা সবাই দেখছি ঢাকা শহর অচল হয়ে যাচ্ছে। আর এটাও ভালোই বুঝতে পারছি যে এসব স্ট্যাটাস দিয়ে মনের ক্ষোভ-বিরক্তি ঝাড়া ছাড়া ঢাকার নাগরিকদের আসলে কিছুই করার নেই। ঢাকার যে এই অবস্থা, আমরা যে চলতে পারছি না, এটা আমরা কাকে জানাব? কার কাছে দাবি, অনুরোধ বা ক্ষোভ-বিক্ষোভের কথা জানাব? কাকে গিয়ে বলব, কিছু একটা করুন, প্লিজ! ঢাকার জন্য কেউ কি আছে? ঢাকা নিয়ে কথা উঠলে শুধু সমন্বয়হীনতার কথা শুনি। ঢাকা নিয়ে সেমিনার, কর্মশালা বা গোলটেবিল আলোচনা, যা-ই হোক, বলা হয়, ঢাকায় পঞ্চাশের বেশি সংস্থা কাজ করে। এর মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। এই একই কথা আর কত দিন শুনতে হবে? সমন্বয় করার দায়টি যার বা যাদের, তারা তাহলে করছে কী! এই দায় তো সরকারেরই হওয়ার কথা, তারা আসলে কোথায়? তারা কী নিয়ে ব্যস্ত? ‘উন্নয়ন’? আমরা ঢাকাবাসী আসলেই বুঝতে পারছি না যে এত ‘উন্নয়ন’ লইয়া আমরা কী করিব! ‘উন্নয়নের জোয়ার বইছে’—এই খুশিতে রাস্তাঘাটে বের না হয়ে ঘরে বসে মুড়ি-চানাচুর খাব?
ঢাকার অবস্থা এক দিনে এমন হয়নি। ঢাকা বছরে বছরে গতি হারিয়েছে, হারাচ্ছে এবং সামনে আরও হারাবে। এক সমীক্ষা বলছে, ২০০৪ সালে ঢাকায় যানবাহনের গতি ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার। এখন তা ৭ কিলোমিটারে এসে দাঁড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০২৫ সালে নাকি তা ৪ কিলোমিটারে দাঁড়াবে! মানুষের হাঁটার গতির মান হচ্ছে ঘণ্টায় পাঁচ কিলোমিটার। মানে আমাদের যানবাহনের গতি হাঁটার গতির চেয়েও কমে যাবে। ‘ঘোড়ায় চড়িয়া মর্দ হাঁটিয়া চলিল’—আমাদের দশা দাঁড়িয়েছে, গাড়িতে চড়িয়া আমরা হাঁটিয়া চলিলাম!
আসলে যানবাহনের হাঁটার গতির জন্য কি আমাদের ২০২৫ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে? নাকি এরই মধ্যে আমরা সেই জায়গায় পৌঁছে গেছি! বিশেষজ্ঞরা তথ্য-উপাত্ত বিবেচনায় নিয়ে গড় হিসাব করেছেন। কিন্তু এই বর্ষায় পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে ঠেকেছে? পাঠক, আপনাদের অভিজ্ঞতা কী বলে? ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট ঠায় দাঁড়িয়ে থাকার পর যদি ৫-৭ সেকেন্ডের জন্য গাড়ি নড়ে, তাহলে তো এই অবস্থাকে হাঁটার গতির সঙ্গেও তুলনা করা যায় না। ঢাকা শহরের বেশির ভাগ রাস্তাই এখন বিধ্বস্ত। কোনোটি চষা খেতের মতো। আবার অনেক রাস্তা এখন আর রাস্তা নেই, স্রেফ খানাখন্দে রূপ নিয়েছে। এসব রাস্তায় তো চলাচলেরই জো নেই, তার আবার গতি!
ঢাকার এই দুর্দশার পেছনে আরও একটি কারণের কথা বছরের পর বছর আমরা শুনে আসছি। পরিকল্পনাহীনতা। পরিকল্পনা করতে কত বছর লাগে? বর্তমান সরকার প্রায় টানা সাড়ে আট বছর ক্ষমতায় আছে, ঢাকার জন্য নানা প্রকল্প নেওয়া হয়েছে ও হচ্ছে, কিন্তু একটা সামগ্রিক পরিকল্পনা কোথায়? এখানেও সেই একই প্রশ্ন; পুরো ঢাকাকে ধরে একটি পরিকল্পনা করা ও তা বাস্তবায়নের কাজটি আসলে কার? রাজউকের? ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের, নাকি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের? এরা যে যার মতো বড় বড় প্রকল্প নেয়, তা পাসও হয় এবং কাজ শুরু হয়ে যায়। বড় বড় প্রকল্পের ব্যাপারে সবার কী যে আগ্রহ! প্রকল্প নেওয়ার পর কাজের সময় দফায় দফায় বাড়ে, খরচও বাড়ে একই তালে। এসব বানানোর পর তা ঢাকাবাসীর কতটুকু উপকারে লাগবে বা লাগল, তা খুব জরুরি বলে তো মনে হয় না। মগবাজার-মৌচাকে যে ফ্লাইওভার হচ্ছে, তা বাস-র‌্যাপিড ট্রানজিটের একটি রুটের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন তা বাতিল করা হয়েছে। গণপরিবহনের দিকে জোর দিতে হবে বলে বিশেষজ্ঞরা যতই মুখে ফেনা তুলে ফেলুন, সরকার এসবের ধারও ধারে না। এই ফ্লাইওভার প্রকল্প নেওয়ার সময় ওই বাসরুটের কথা কারও মাথায় ছিল না। ফ্লাইওভার কি এমন জিনিস যে চাইলেই সরানো যাবে! সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে গেছে। স্থায়ী সর্বনাশ। এই ফ্লাইওভারের নকশার ত্রুটির কথাও এখন শোনা যাচ্ছে। মৌচাক মোড়ে নাকি ফ্লাইওভারের ওপর ট্রাফিক সিগন্যাল ও ট্রাফিক বসাতে হবে। ফ্লাইওভারে হাত ওঠা-নামা করে ট্রাফিককে গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করতে কে কোথায় দেখেছেন? ঢাকায় তা-ই হতে যাচ্ছে। নানা ‘উন্নয়ন’ হচ্ছে, কিন্তু এর কোনো আগ-পিছ বিবেচনায় নেই।


ঢাকায় বড় বড় প্রকল্প হচ্ছে। যে ব্যয় ধরে তা শুরু হয়, শেষ পর্যন্ত তা বেড়ে যায় কয়েক গুণ। সময় বাড়ছে, মানুষের দুর্ভোগের সময় বাড়ছে। বাংলাদেশে রাস্তাঘাট, সেতু, ফ্লাইওভারের নির্মাণ খরচ এখন পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। কেন? এটা বুঝতে বিদ্যা-বুদ্ধির দরকার নেই। দুর্নীতি, পার্সেন্টেজ—এসব ব্যাপার দুনিয়ার অনেক দেশেই আছে, কিন্তু আমাদের দেশে তা মাত্রাছাড়া। ‘উন্নয়নের’ লক্ষ্য যদি ভিন্ন থাকে, তবে তার ফল পাওয়া আসলেই কঠিন। আগেই বলেছি, বর্তমান সরকার সাড়ে আট বছর ধরে ক্ষমতায় রয়েছে। এখন একটি প্রশ্ন করি, সাড়ে আট বছর আগে ঢাকার যে অবস্থা ছিল, সে তুলনায় ঢাকার এখনকার অবস্থা খারাপ হয়েছে, না ভালো হয়েছে? প্রিয় পাঠক, আপনার অভিজ্ঞতা কী বলে?
আমার হতাশ বন্ধু প্রশ্ন করেছেন, ‘এ কেমন শহর?’ আসলে প্রশ্নের চেয়ে বিস্ময়বোধক চিহ্নটাই সম্ভবত বেশি জুতসই হতো, এ কেমন শহর! বসবাসের জন্য কোন শহর কেমন তা নিয়ে প্রতিবছর একটি সূচক বের করে ইকোনমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ)। বেশ কয়েক বছর ধরে ঢাকার অবস্থান একদম শেষের দিকে। ২০১৩ সালে ঢাকা বসবাসের জন্য দুনিয়ার সবচেয়ে খারাপ শহরের ‘খেতাব’ পেয়েছিল। এই মাসে দেওয়া সর্বশেষ সূচকে ঢাকার জায়গা হয়েছে ৩ নম্বরে। ঢাকার অবস্থার কি তাহলে উন্নতি হলো? আসলে তা নয়। এবারের সূচকে ঢাকার চেয়ে খারাপ দুটি শহর হচ্ছে লিবিয়ার ত্রিপোলি ও সিরিয়ার দামেস্ক। যুদ্ধবিধ্বস্ত দুটি শহর। ওই দুটি  শহরের অবস্থা খারাপ হয়েছে বলে ঢাকার মান কিছুটা বাঁচল! এই যে বছর বছর ঢাকা দুনিয়ার সবচেয়ে খারাপ শহরগুলোর একটির তকমা পেয়ে যাচ্ছে, এ নিয়ে সরকারের তরফে কোনো প্রতিক্রিয়া শুনেছেন?
গানের দল ‘চিরকুট’-এর একটি গান আছে, ‘এই শহর, জাদুর শহর/ প্রাণের শহর ঢাকারে।’ ঢাকা সত্যিই এক ‘জাদুর শহর’, বিস্মিত হওয়ার মতোই এক শহর। কারণ, এ শহরকে দেখার আসলে কেউ নেই। এই শহর নিয়ে কারও কোনো দায়ও নেই। এরপরও আমাদের নাগরিকদের কাছে এটা এক ‘প্রাণের শহর’। এ-ও এক বড় বিস্ময়।
এ কে এম জাকারিয়া: সাংবাদিক।
akmzakaria@gmail.com

http://www.prothom-alo.com/opinion/article/1301181

http://www.prothom-alo.com/opinion/article/1301181